Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

জেটলির কাছে মুকুল, খোয়ালেন পদ

দুপুরে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে দেখা করলেন তিনি। চেষ্টা করলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করার। আর রাতেই তাঁকে সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। তৃণমূলে আরও অর্থহীন হয়ে পড়লেন মুকুল রায়। দলে কার্যত প্রান্তিক স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া মুকুল কবে ট্রেন বদল করবেন, তা নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে।

দিল্লির সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে মুকুল রায়।—নিজস্ব চিত্র।

দিল্লির সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে মুকুল রায়।—নিজস্ব চিত্র।

অগ্নি রায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪০
Share: Save:

দুপুরে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে দেখা করলেন তিনি। চেষ্টা করলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করার। আর রাতেই তাঁকে সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল।

তৃণমূলে আরও অর্থহীন হয়ে পড়লেন মুকুল রায়।

দলে কার্যত প্রান্তিক স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া মুকুল কবে ট্রেন বদল করবেন, তা নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে। সেই জল্পনা উস্কে আজ রেল বাজেট নিয়ে যখন সংসদ সরগরম, তখন জেটলির ঘরে যান মুকুল। সঙ্গী ছিলেন বিজেপি সাংসদ চন্দন মিত্র। বাজেট ব্যস্ততার মধ্যেও জেটলি তাঁকে সময় দেওয়ায় মুকুলের দলবদল নিয়ে জল্পনা আরও বেড়েছে। মিনিট দশেকের বৈঠক সেরে বেরনোর পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মুকুল অবশ্য বলেন, “ব্যক্তিগত কাজে দেখা করেছি।” তার পরেই খানিকটা হাল্কা সুরে মুখে ‘কুলুপ আঁটার’ পরামর্শ দিয়ে মুকুলকে নিয়ে চলে যান চন্দন!

শুধু জেটলির সঙ্গে দেখা করা নয়, মুকুল আজ নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টায় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়েও গিয়েছিলেন বলে তৃণমূল সূত্রে খবর। এর পরে আর দেরি করেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাতেই মুকুলকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর জায়গায় নিয়ে আসা হয় ডেরেক ও’ব্রায়েনকে।

এই পদচ্যুতির পরে মুকুুল কী করবেন সেটা দেখার। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁর অবস্থানে খুব একটা খুশি নন বিজেপি নেতৃত্ব। তাঁকে বলা হয়েছে, বিজেপিতে যোগ দিতে চাইলে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের রাজনীতি করলে চলবে না। মমতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে হবে।

বস্তুত, তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব চরম সীমায় চলে গেলেও এখনও পর্যন্ত দলবিরোধী কোনও কথা বলেননি মুকুল। তাঁর ছেলে শুভ্রাংশু সরাসরি দলনেত্রীকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার পরেও মুকুল কৌশলেই ছেলের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আজও বিজেপির দাবি মেনে রেল বাজেটের ভূয়সী প্রশংসা তিনি করেননি। শুধু যাত্রিভাড়া না-বাড়ার প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, এটা সুখবর। পাশাপাশি এ-ও বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রকল্প যেগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেশ ত্রিবেদী এবং আমার সময়ে শুরু করা হয়েছিল সেগুলি থমকে গিয়েছে পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের আমলে। সেগুলিকে অবিলম্বে চালু করা দরকার।”

মুকুল ধীরে পা-ফেললেও তাঁর অনুগামীদের ডানা ছাঁটার কাজ কিন্তু চালিয়ে যাচ্ছে তৃণমূল। গত কালই পরিষদীয় সচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যারাকপুরের বিধায়ক শীলভদ্র দত্তকে। আজ ছ’বছরের জন্য দল থেকে বের করে দেওয়া হল মুর্শিদাবাদ জেলার কার্যকরী তৃণমূল সভাপতি হুমায়ুন কবীরকে। মুকুলের হাত ধরে কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে আসা হুমায়ুনকে দলবিরোধী কাজের জন্য গত কাল শো-কজ করা হয়েছিল। সুর নরম করা দূরস্থান, ‘ভাইপোকে রাজা করার সাধ মিটবে না’ মন্তব্য করে খোদ দলনেত্রীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছিলেন তিনি। মুকুল অবশ্য হুমায়ুনের বিতাড়ন নিয়ে মুখ খোলেননি। তিনি বলেন, “কোনও জায়গায় যদি মনে হয় অশান্তি হচ্ছে, তা হলে তৃণমূলে যথেষ্ট যোগ্য ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁরা সমস্যার মোকাবিলা করতে পারবেন।”

কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক চুকেবুকে যাওয়ার পালা আসন্ন বুঝে মুকুল-ঘনিষ্ঠরা যে ভিতরে ভিতরে ঘর গোছাতে শুরু করেছেন, তার ইঙ্গিত আজ মিলেছে কৃষ্ণনগরে। এ দিন দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ শহরের জনবহুল এলাকায় পুুরসভার সামনে ও কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের সামনে ‘মুকুল রায় জিন্দাবাদ’ লেখা ফ্লেক্স টাঙিয়ে দেওয়া হয়। গত শনিবার বারাসতের ডাকবাংলো মোড়েও ব্যানার ঝুলিয়ে ছিলেন মুকুল অনুগামীরা। তাতে লেখা ছিল, ‘মুকুল রায় তুমি এগিয়ে চলো। আমরা তোমার সাথে আছি।’

মুকুল-পন্থীদের সঙ্গে তৃণমূলের দ্বন্দ্বের জল কোন দিকে গড়ায়, সে দিকে নজর রাখছে বিজেপি। দলীয় সূত্র বলছে, এখনই বিজেপিতে যোগ দিতে ইচ্ছুক মুকুলের পক্ষ থেকে বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, তাঁর সঙ্গে আরও অনেক নেতাই দল ছাড়তে পারেন। এই তালিকার এক জন দীনেশ ত্রিবেদী বলে তৃণমূল শিবিরে জল্পনা। সম্প্রতি একাধিক বার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসা ও মমতার নিন্দা করেছেন তিনি। এর পরেই দীনেশকে কাছে টানতে দলে সহ-সভাপতির পদ তৈরি করে তাঁকে নিয়োগ করেন মমতা। আজ দলের লাইন মেনে রেল বাজেটের নিন্দা করেন দীনেশ। তাতে কিছুটা অখুশি বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব।

এই পরিস্থিতিতে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে বিজেপি-ও। অরুণ জেটলি আজ যেমন মুকুলের সঙ্গে দেখা করছেন, তেমন গত কালই ফোনে কথা বলেছেন মমতার সঙ্গে। কেন? বিজেপি সূত্র বলছে, এক দিকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্রের একটা সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই বলেছিলেন, রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকবে, প্রশাসন পরিচালনা তার জায়গায়। এখনও পর্যন্ত সেই নীতি মেনেই এগোচ্ছে সরকার। এই দায়বদ্ধতার বাইরে রাজ্যসভায় বিল পাশ করানোর জন্য আঞ্চলিক দলগুলির সহযোগিতা প্রয়োজন হবে মোদী সরকারের। সুতরাং তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্কের সব সেতু পুড়িয়ে ফেলা কোনও কাজের কথা নয়। বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশের বক্তব্য, সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের

উপর চাপ ক্রমশ বাড়ছে। মুকুল বিদ্রোহী হয়ে দিল্লিতে ঘাঁটি গাড়ায় সেই চাপ আরও বাড়ছে। এই বাতাবরণে মমতাও ন’মাসের অনড় অবস্থান পাল্টে মোদীর সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চেয়েছেন। তাঁর এই নমনীয় মনোভাবের সুযোগ বিজেপির নেওয়া উচিত।

কিন্তু তাই বলে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল বিরোধিতায় কোনও ঢিলেমি আনতে চাইছেন না মোদী-জেটলিরা। মমতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে রাজ্যে বিজেপির জনসমর্থন ক্রমশ বাড়া এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে তাদের উঠে আসাটা সদ্যসমাপ্ত জোড়া উপনির্বাচনের ফলে স্পষ্ট হয়েছে। ফলে রাজ্য বিজেপির আন্দোলনে রাশ টানার কোনও প্রশ্নই নেই। পাশাপাশি মুকুলকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূলে ভাঙন ধরানোর চেষ্টাও অব্যাহত থাকবে। তাঁকে সরাসরি দলে নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে বিজেপির অন্দরে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, মুকুলকে এখনই দলে নিয়ে রাজ্যে সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানো হোক। আবার অনেকের মতে, সারদা কেলেঙ্কারিতে অভিযোগের আঙুল যে হেতু মুকুলের দিকেও, তাই সিবিআই পুরোপুরি ছাড়পত্র দেওয়ার আগে তাঁকে দলে নেওয়া উচিত নয়। পরিবর্তে শুভ্রাংশুকে দলে নেওয়ার প্রস্তাব মুকুলকে দেওয়া হয়েছে বলে বিজেপি সূত্রের খবর। কিন্তু মুকুল এই প্রস্তাব মানবেন কি না, সন্দেহ। এই অবস্থায় মুকুলকে দলে না নিয়েও তাঁকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূলকে হীনবল করার কাজ শুরু হয়েছে।

পরিস্থিতি আন্দাজ করে মুকুলকে হীনবল করার কাজে হাত দিয়েছে তৃণমূলও। দল থেকে সংসদ সর্বত্রই মুকুলের কর্তৃত্ব খর্ব করে দেওয়া হয়েছে। দলে তাঁর সঙ্গেই সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে সুব্রত বক্সীকে। সংসদীয় কৌশল স্থির করার জন্য ছয় সদস্যের একটি কমিটি গড়া হয়েছে। সেখানে মুকুলের ঠাঁই হয়নি। আজ সেই কমিটির বৈঠক হয়। তার পর সৌগত রায়ের বাড়িতে সব তৃণমূল সাংসদকে নিয়ে নৈশভোজের আসর বসে। সেখানেও ছিলেন না মুকুল। আর রাতে তো সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান পদটাও চলে গেল!

যদিও এখনও নিজেকে নিঃসঙ্গ অ্যাখ্যা দিতে নারাজ মুকুল। তাঁর কথায়, “গোটা বাংলার মানুষের কাছে থেকে এত ফোন পাচ্ছি, তা হলে কী করে নিজেকে নিঃসঙ্গ বলা যায়!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

arun jaitley mukul roy tmc agni roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE