রায়বেঁশে: মঞ্চে ভগবানগোলা গার্লস হাইস্কুলের পড়ুয়ারা। —নিজস্ব চিত্র।
বাধা ছিল। ওরা তা লাফ দিয়ে পেরিয়ে গিয়েছে।
বাধা ছিল ধর্ম, বাধা ছিল পেটে চনচন করা খিদে। ওরা চোখে চোখ রেখে বোল তুলেছে— জাগিন জাগিন জাগিন যা! তা তা তা তাতাক তা!
লাফ দিয়ে ওরা পেরিয়ে গিয়েছে বাংলার সীমানা, এ বার দেশ জয়ের জন্য ছুটছে আট অশ্বমেধের ঘোড়া— রায়বেঁশের কন্যাবাহিনী।
রায়বেঁশে মেয়েরা নাচে না, যুদ্ধের নাচ রায়বেঁশে। মুসলিম মেয়েরা তো একেবারেই নয়। অথচ মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উঠে আসা এই দলের আট মেয়ের সাত জন মুসলিম। আগামী ১-৭ জানুয়ারি মধ্যপ্রদেশের ভোপালে ‘রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান’ আয়োজিত ‘২০১৭ কলা উৎসব’-এ তারা নামতে চলেছে জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায়।
কিছু দিন আগে এই মুর্শিদাবাদেরই বেলডাঙা থেকে ধর্মের আগল টপকে জাতীয় স্তরে সাইকেল প্রতিযোগিতায় গিয়েছিল তিনকন্যা। ভগবানগোলার এই মেয়েদেরও রোখা যায়নি। ২২টি জেলার দলকে হারিয়ে রাজ্যের মুখ হয়ে উঠেছে ভগবানগোলা গার্লস হাইস্কুলের এই মেয়েরা। দলের নেত্রী দ্বাদশ শ্রেণির প্রীতি সিংহ। সঙ্গে রয়েছে একাদশ শ্রেণির হোসনেয়ারা খাতুন, দশম শ্রেণির শবনম সুলতানা ও ডলি খাতুন, নবম শ্রেণির মৌসুমি খাতুন, রুমানা পারভিন, রাইহানা খাতুন ও শুকতারা খাতুনেরা। ওই স্কুলের শিক্ষিকা রাখী মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অভিভাবকেরা মেয়েদের ছাড়তে চাইছিলেন না। আমরা অনেক বোঝানোর পরে নিমরাজি হন।’’
আরও পড়ুন:বন্ধ-পোস্টার ছিঁড়ে খুলে গেল পাহাড়
রাইহানা বলে, ‘‘আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে নাচগান নিষিদ্ধ। তাই বাধা এল। বাড়ি থেকে, আত্মীয়-পড়শিদের থেকেও। পরে অবশ্য লোকে বুঝেছে, আমরা খারাপ কিছু করছি না।’’ পদ্মা পেরোলেই ও পারে বাংলাদেশের রাজশাহি। রুমানা বলে, ‘‘বাড়িতে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল চলে। তাতে দিব্যি নাচ-গান হয়। আমাদের নিয়ে যখন আপত্তি উঠল, অনেকেই কিন্তু বললেন, ওখানে যদি মুসলিমরা করতে পারে, এখানেই বা করা যাবে না কেন?’’ মৌসুমির কথায়, ‘‘প্রথমে মা ছাড়া বাড়ির আর কেউ রাজি ছিল না। রাজ্যে সেরা হওয়ায় অন্যেরাও এখন মত বদলে সায় দিয়েছেন।’’
প্রাথমিক বাধা কাটতেই ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা দিলরুবা খাতুন স্থানীয় রায়বেঁশে শিক্ষক আকাশ বিশ্বাসকে মেয়েদের তৈরি করানোর দায়িত্ব দেন। সঙ্গে ছিলেন স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষিকা হাসিনা খাতুন, সহশিক্ষিকা দ্বীপান্বিতা রায়েরাও। কিন্তু শুধু ধর্ম নয়, বাধা তো ট্যাঁকেরও। রাখী বলেন, ‘‘এ নাচে লাঠিসোটা নিয়ে কসরত, পুষ্টিকর খাবার দরকার। কিন্তু কয়েক জনের বাবা-মা জানালেন, তাঁদের বাড়িতে সব দিন দু’বেলা হাঁড়িই চড়ে না!’’
অগত্যা মিড-ডে মিলের ভাঁড়ার থেকে ডিমের বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়া হল। শিক্ষিকারা নিজেদের টাকায় মেয়েদের পুষ্টিকর টিফিনের ব্যবস্থা করলেন। শুরু হল জোরদার প্রস্তুতি। ঢোল-কাঁশি বাজিয়ে, রণ-পা নিয়ে মেয়েরা বোল তুলল— ‘জাওরে গিজার গিজ গিনি তা।’ প্রথমে জেলা চ্যাম্পিয়ন, তার পর গত ২১-২২ সেপ্টেম্বর কলকাতার সেন্ট্রাল পার্কে রাজ্যস্তরে জয় হাসিল।
চোখরাঙানি আর খিদে উড়িয়ে এ বার বাজি আখরি ফয়সালা— জাগিন জাগিন জাগিন যা!
চলো ভোপাল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy