Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

অস্ত্রশিক্ষার তৃতীয় ঘাঁটি বোলপুরে

বর্ধমান, মুর্শিদাবাদে জঙ্গি-ডেরার সন্ধান মিলেছিল আগেই। এ বার যুক্ত হল বীরভূমের নাম। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বোলপুরের নাম। • কোথায় এই ডেরা: বোলপুর শহর ঘেঁষা গ্রাম মুলুক। সেই গ্রামেই শান্তিপল্লির লাগোয়া এক বিঘার একটি সরকারি খাসজমি। সেই জমিতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে গড়ে উঠেছে তিনটি প্লাস্টারহীন পাকা বাড়ি। টিন ও উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বলে বাইরে থেকে দেখা যায় না কিছুই। আশপাশের বাসিন্দাদের মুখে মুখে জায়গাটির নাম ‘লাদেনপট্টি’। এই বাড়িতেই অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হতো বলে জানতে পেরেছেন জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র গোয়েন্দারা।

মহেন্দ্র জেনা ও অনল আবেদিন
বোলপুর ও লালগোলা শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০৪
Share: Save:

বর্ধমান, মুর্শিদাবাদে জঙ্গি-ডেরার সন্ধান মিলেছিল আগেই। এ বার যুক্ত হল বীরভূমের নাম। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বোলপুরের নাম।

• কোথায় এই ডেরা: বোলপুর শহর ঘেঁষা গ্রাম মুলুক। সেই গ্রামেই শান্তিপল্লির লাগোয়া এক বিঘার একটি সরকারি খাসজমি। সেই জমিতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে গড়ে উঠেছে তিনটি প্লাস্টারহীন পাকা বাড়ি। টিন ও উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বলে বাইরে থেকে দেখা যায় না কিছুই। আশপাশের বাসিন্দাদের মুখে মুখে জায়গাটির নাম ‘লাদেনপট্টি’। এই বাড়িতেই অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হতো বলে জানতে পেরেছেন জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র গোয়েন্দারা।

• কারা থাকে সেখানে: মিঠু ওরফে হাফিজুর রহমান, আব্দুল মালেক ও তালেহার শেখ।

• কেন সন্দেহের জালে: খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত কওসরের সঙ্গী হবিবুর শেখের আনাগোনা ছিল এই ‘লাদেনপট্টিতে’। হবিবুর নিজেও শান্তিপল্লির বাসিন্দা। কিন্তু বছর দুই আগে সে রাতের অন্ধকারে বাড়ি ছাড়ে। পালিয়ে যাওয়ার আগে তার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল ডালিমের সঙ্গে। ‘লাদেনপট্টি’-তে হবিবুরের যাতায়াত ছিল। এই তিনটি বাড়ির কোনওটিতেই তার বিয়েও হয়েছিল বলে জানিয়েছে হবিবুরের পরিবার। তদন্তে এনআইএ জানতে পেরেছে, ডালিম শেখই ওই জমির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল হাফিজুর, আব্দুল ও তালেহারকে। খাগড়াগড়-বিস্ফোরণের পর থেকেই ডালিম সপরিবার উধাও। খোঁজ নেই আব্দুল ও তালেহারেরও। শনিবার ওই তিনটি বাড়িতেই হানা দেয় এনআইএ।

• কী মিলল সেখানে: তিনটি বাড়ির দেওয়ালে সন্দেহজনক ঘুলঘুলি এবং তিন বাড়ির নকশা দেখে আগেই সন্দেহ হয়েছিল গোয়েন্দাদের। এনআইএ-র দুই সদস্যের দল শনিবার আব্দুল ও তালেহারের বাড়ি থেকে শনিবার সন্দেহজনক নথি ও কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ পায়। কুয়ো থেকে মেলে ভারী ব্যাগ। তিনটিই বাড়িই পরস্পরের সঙ্গে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে। দেওয়ালে জানলার মাপের গর্ত। যেগুলি ইটের আলগা গাঁথনি দিয়ে ভরাট করা। ঠেললেই কিন্তু ইট পড়ে যাবে। যার সাহায্যে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়া যেতে পারে।

• কী বলছে গোয়েন্দা সূত্র: উদ্ধার হওয়া নথি ও নকশা পরীক্ষা করে এনআইএ-র গোয়েন্দারা নিশ্চিত, বর্ধমানের মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া মাদ্রাসা এবং মুর্শিদাবাদের লালগোলার মকিমনগর মাদ্রাসার মতো বোলপুরের ‘লাদেনপট্টি’-তেও ছিল জঙ্গি ডেরা। সেখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। রবিবার সেই সব নথি ও নকশা বিভিন্ন মহলে ই-মেলে পাঠিয়েছেন এনআইএ-র গোয়েন্দারা।

রবিবার বোলপুর এসডিপিও-র দফতরে জেরা করা হয় হাফিজুর রহমান ওরফে মিঠুকে। তার মা রোশেনারা বিবি এবং সব্জি ব্যবসায়ী সইফ শেখকেও (হাফিজুরের বাড়িতে থাকে) জিজ্ঞাসাবাদ করে এনআইএ। পরে হাফিজুর দাবি করে, সে পেশায় মশারি বিক্রেতা। আদি বাড়ি মুরারই ১ ব্লকের দাঁতুরা-নয়াগ্রাম এলাকায়। ডালিম বা হবিবুরকে সে চেনে না বলেও জানিয়েছে সে। হাফিজুর সত্যি বলছে কি না, তা যাচাই করতে এনআইএ এ দিন মুরারইয়ের মিত্রপুর গ্রাম পঞ্চেয়েতের তৃণমূল সদস্য বাবলু আখতারকেও ডেকে পাঠায় বোলপুরে। এনআইএ-র ডিআইজি অনুরাগ তনখা এ দিনই জেরা করেন কীর্ণাহারের নিমড়া গ্রামের বাসিন্দা হিপজুল্লা কাজিকে। হাফিজুর ও হিপজুল্লাকে বিস্ফোরণ-কাণ্ডে সন্দেহভাজনদের ছবি দেখানো হয়। কওসর-ঘনিষ্ঠ কদর গাজির বাড়ি ওই নিমড়া গ্রামেই।

গত ২ অক্টোবর বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণে আহত হয়েছিল আব্দুল হাকিম। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আব্দুল হাকিম জেরায় জানিয়েছে, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমান এই চার জেলায় শ’য়ে শ’য়ে আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) মজুত করে রাখা আছে বিভিন্ন গোপন গুদামে। সেই সূত্রে আগেই মঙ্গলকোটের শিমুলিয়ায় তল্লাশি চালিয়েছে এনআইএ এবং এনএসজি। শনিবার এনআইএ হানা দেয় শান্তিপল্লিতে। আর রবিবার তাদের গন্তব্য ছিল, লালগোলার মকিমনগর মাদ্রাসা।

• গোয়েন্দারা কী দেখলেন সেখানে: দেখলেন, ঈদের ছুটির পর পঠনপাঠন শুরু হওয়ার কথা ছিল শনিবার। কিন্তু, মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা নিজেই ফেরার। দেখা নেই এক জন শিক্ষিকারও। নেই ১৩০ জন পড়ুয়ার কেউই। গোয়েন্দাদের দাবি, শিমুলিয়ার মতো এই মাদ্রাসাতেও একদল তরুণী রীতিমতো জেহাদি প্রশিক্ষণ পেত। এ দিন মকিমনগরের মাদ্রাসায় ছাত্রীদের তালা বন্ধ বাক্স-প্যাঁটরা, বইপত্র তন্নতন্ন করে ঘেঁটে এনআইএ-র পাঁচ সদস্যের দল খুঁজে বেড়িয়েছে জঙ্গিযোগের সুলুক। তল্লাশি চালিয়ে বেশ কিছু নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করেছেন তাঁরা। তার মধ্যে রয়েছে ছাত্রীদের নাম লেখা হাজিরা খাতা, রান্নার গ্যাসের নথিপত্র, মাদ্রাসার আয়-ব্যয় সংক্রান্ত হিসেবের খাতা, একটি ডায়েরি। ডায়েরিতে লেখা বেশ কিছু নাম ও ফোন নম্বর। ডাঁই হয়ে থাকা বইপত্র থেকে তদন্তকারী আধিকারিকরা পটাপট ছিঁড়ে নিলেন বেশ কিছু পাতা।

খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে, ঈদের ছুটির নোটিস লটকে সপরিবার নিখোঁজ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয় বাসিন্দা মোফাজ্জুল শেখ। এ দিন মাদ্রাসা থেকে মাত্র ৩০০ মিটার দূরে সেই মোফাজ্জুলের বাড়িতেও এনআইএ হানা দিয়েছিল। পাওয়া গিয়েছে ২৫টি তিরের ফলা। তিরের ফলা মোফাজ্জুলের বাড়িতে কেন, তা নিয়ে ধন্দে রয়েছেন গোয়েন্দারা। এ ছাড়াও মিলেছে দু’টি মোবাইল, দু’টি সিমকার্ড, একটি চিপ, বিভিন্ন ব্যক্তির নাম ও ফোন নম্বর লেখা একটি ডায়েরি, চাঁদা আদায়ের রসিদ, ইটভাটার হিসেব লেখা নথি।

রবিবার সকাল ৭টা থেকে টানা সাত ঘণ্টার তল্লাশি চলে মকিমনগরে। পাঁচ সদস্যের এনআইএ দলের সঙ্গে ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশের এক ডিএসপি, লালবাগের এসডিপিও এবং ওসি-সহ প্রায় ৩০ জনের পুলিশ বাহিনী। তা ছাড়াও ছিলেন গ্রামের স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যের স্বামী আবদুল গফ্ফর, স্থানীয় বাসিন্দা হাজি আবুল কাশেম ও মেসের আলি।

মাদ্রাসার দেওয়ালে নোটিস ঝুলছে-- ২ অক্টোবর ঈদ উপলক্ষে ছুটি শুরু। ১৭ অক্টোবর মাদ্রাসা খুলবে। ১৮ অক্টোবর থেকে নিয়মিত পঠনপাঠন শুরু হবে। কিন্তু, খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের খবর চাউর হতেই ছাত্রী থেকে আলেমা (শিক্ষিকা), সকলেই নিজেদের লুকিয়ে ফেলেছেন। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, ৬ অক্টোবর থেকেই বেপাত্তা স্বয়ং মোফাজ্জুল। আসছেন না ‘হেড-আপা’(প্রধান শিক্ষিকা)-সহ মাদ্রাসার অন্য সদস্যরাও। মাদ্রাসারই এক আবাসিক আলেমা জানান, মাদ্রাসার ৯ শিক্ষিকার অধিকাংশই ছিলেন ভিন্ জেলার। প্রধান শিক্ষিকা মাইমুনা বিবি মালদহের বাসিন্দা। তিনি তাঁর স্বামী আব্দুল বারিকে নিয়ে মাদ্রাসাতেই থাকতেন।

রবিবার এনআইএ দল যায় বেলডাঙাতেও। খাগড়াগড় বিস্ফোরণে মৃত শাকিল আহমেদের তিনটি ডেরা ছিল বেলডাঙায়। তাঁর বাড়ি এবং বোরখা তৈরির কারখানায় এর আগেই তল্লাশি চলেছে। এ দিন বিকেলে এনআইএ স্থানীয় বড়ুয়া মোড়ে শাকিলের দোকান ‘বোরখা ঘরে’ তল্লাশি চালায়। ছোট্ট সেই ঘরের দরজা ভেঙে কিছু নথিপত্র, মোবাইল ফোন, এক্স-রে প্লেটের ফিল্ম, প্রচুর লাল মলাটে বাঁধাই করা বই, দোকানের রসিদ, একটি সংবাদপত্র, বোরখা তৈরির সরঞ্জাম মেলে।

এ দিন বর্ধমানের বাবুরবাগ ও খাগড়াগড়ের বাড়ির মালিকদের ডেকে রবিবার আর এক প্রস্ত জিজ্ঞাসাবাদ করছে এনআইএ। দুপুর নাগাদ রাজ্য পুলিশ এবং সিআইডিকে নিয়ে ফের খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণস্থলে যায় এনআইএ। তল্লাশি চলে সন্ধে পর্যন্ত। এ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া রায়ায়নিক, আসবাবপত্র, অস্ত্র, নানা যন্ত্রপাতি, লেদ মেশিন ইত্যাদির তালিকার সঙ্গে বর্ধমান থানা ও সিআইডি-র তালিকা মিলিয়ে দেখা হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE