যে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সেই সংসারের কাছেই ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাস্থ্য দফতর।
সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ডাক্তারের সংস্থান হয়নি। হাসপাতালগুলি চালু হওয়ার নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গিয়েছিল আগেই। শেষ পর্যন্ত ভোটের তাড়ায় বাধ্য হয়ে একটি-দু’টি করে চালু হতে শুরু করলেও সেখানে পরিষেবা চালাতে গিয়ে প্রতি পদে হোঁচট খেতে হচ্ছে। বাধ্য হয়েই স্বাস্থ্য দফতর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কাছাকাছি যে মেডিক্যাল কলেজ থাকবে সেখান থেকেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তুলে এনে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের আউটডোর চালিয়ে আপাতত মুখরক্ষা করা হবে। বিশেষজ্ঞেরা যাতে বেঁকে না বসেন তার জন্য এক-একদিন আউটডোরে আসার জন্য মোটা টাকা ভাতার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
ভাতার পরিমান কী রকম? স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তর, ‘‘আউটডোরে বসার জন্য সহকারি প্রফেসরের মতো সিনিয়ার বিশেষজ্ঞরা দিন প্রতি ৫ হাজার টাকা আর টিউটর (ডেমনস্ট্রেটর)-এর মতো অপেক্ষাকৃত জুনিয়ার বিশেষজ্ঞরা দিন প্রতি ৪ হাজার টাকা করে পাবেন। বড়জোড়া আর নয়াগ্রাম দিয়ে এটা শুরু হচ্ছে। ক্রমশ সব সুপার স্পেশ্যালিটিতেই একই নিয়ম অনুসৃত হবে।’’
বড়জোড়া হাসপাতালে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ থেকে আর নয়াগ্রামের সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ থেকে বিশেষজ্ঞ তুলে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই দুই মেডিক্যাল কলেজ থেকে মেডিসিন ও সার্জারির চিকিৎসকেরা পালা করে ডিউটি করবেন নতুন তৈরি হওয়া দুই হাসপাতালের আউটডোরে। একেক জন ডাক্তার মাসে সর্বোচ্চ ১০ দিন করে ডিউটি করতে পারবেন। অর্থাৎ মাসে ১০ দিন নতুন হাসপাতালে ডিউটি করলে একেক জন সহকারি প্রফেসর ৫০ হাজার টাকা এবং টিউটর ৪০ হাজার টাকা বাড়তি রোজগার করবেন।
মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে যেখানে সরকারের ভাঁড়ারে হাঁড়ির হালের কথা বলছেন তখন বাড়তি এত টাকা বোঝা সরকার কী ভাবে বইবে? শুনে ক্ষুব্ধ গলায় সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘আমরা কী ভাবে কী করব সে সব নিয়ে আপনাদের এত চিন্তা কেন? সব হয়ে যাবে।’’ কিন্তু এমনিতেই মেডিক্যাল কলেজগুলিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে রোগীরা অসুবিধায় পড়েন। সেখানে এক-এক বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা সপ্তাহে দু’দিন করে নিকটবর্তী সুপার স্পেশ্যালিটিতে চলে গেলে মেডিক্যাল কলেজগুলি চলবে কী করে? সুশান্তবাবুর জবাব, ‘‘দু’দিন করে পালা করে গেলে কোনও অসুবিধা হবে না।’’ যা শুনে স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা আফশোসের সুরে বলেন, ‘‘কতটা মরিয়া অবস্থা হলে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয় তা এর থেকে স্পষ্ট।’’
স্বাস্থ্যশিক্ষা দফতরের আরেক কর্তার ব্যাখ্যায়, আসলে সরকার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে, চুক্তির ভিত্তিতে জেলার দিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ করতে চাইলে হয় পাওয়া যাবে না, নয়তো প্রচুর টাকা বেতন দিতে হবে। আর যেহেতু ওই ডাক্তারেরা স্থায়ী কর্মী হবেন না তাই যখন-তখন চাকরি ছেড়ে চলেও যেতে পারবেন। তুলনায় যদি সরকারি বিশেষজ্ঞদেরই অতিরিক্ত ভাতা দিয়ে তুলে নেওয়া যায় তাতে টাকাও কম পড়বে এবং যেহেতু স্বেচ্ছাবসর এখন দেওয়া বন্ধ তাই ইচ্ছে করলে তাঁরা চাকরি ছাড়তেও পারবেন না। তবে তিনি স্বীকার করলেন, ‘‘এতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হবে মেডিক্যাল কলেজগুলির।’’
স্বাস্থ্য দফতরের একটা বড় অংশের আশঙ্কা, এর ফলে বাঁকু়ড়া ও মেদিনীপুর মেডিক্যালের পরিষেবা এবং পঠনপাঠন লাটে উঠবে। কারণ ভাতা-র লোভে মেডিক্যাল কলেজের কাজ শিকেয় তুলে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের আউটডোরে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করবেন।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, কেন্দ্রের ‘ব্যাকওয়ার্ড রিজিয়ান গ্রান্ট ফান্ড’ (বিআরজিএফ)-এর এককালীন টাকায় ৩৪টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল ছাড়াও রাজ্যে আরও সাতটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল হওয়ার কথা। দিন কয়েক আগে নদিয়ার তেহট্টের প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রী বলে এসেছেন, ‘‘দু’টি সুপার স্পেশ্যালিটি চালু হল। জানুয়ারির মধ্যে আরও ২০টি উদ্বোধন হবে।’’ তাঁর এই মন্তব্যকে ঘিরেও ত্রাহি-ত্রাহি রব বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে। কার্যত সিঁটিয়ে রয়েছেন বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষরা। পাছে তাঁদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ধরেও এ বার টান পড়ে।
বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের কর্তারা জানিয়েছেন, এমনিতেই তাঁদের পরিষেবার অবস্থা খারাপ। জেলার মেডিক্যাল কলেজগুলিতে যে ডাক্তাররা যান, তাঁদের অনেকেরই হাজিরা নিয়ে বহু অভিযোগ রয়েছে। এক দিনে হাজিরা খাতায় গোটা সপ্তাহের সই করার অভিযোগও উঠেছে একাধিক বার। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য দফতরের এই নতুন সিদ্ধান্ত তাঁদের আরও বিপাকে ফেলবে।
বাঁকুড়া মেডিক্যালের এক কর্তার কথায়, ‘‘সবচেয়ে ক্ষতি হবে পঠনপাঠনের। এমনিতেই নিয়মিত ক্লাস হয় না। তার ওপরে যদি ডাক্তারদের সামনে এমন বাড়তি উপার্জনের টোপ থাকে তা হলে তো তাঁরা অনেকেই সে দিকে মন দেবেন।’’ মেদিনীপুর মেডিক্যালের এক কর্তার কথায়, ‘‘তৃণমূলের এক চিকিৎসক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ কলকাতার ভাল মেডিক্যাল কলেজে পোস্টিং করিয়ে দেওয়ার সুবাদে তিনি টাকা নেন। এ বার তো বাঁকুড়া আর মেদিনীপুরে পোস্টিং নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে যাবে।’’
প্রশ্ন আরও রয়েছে। যেমন, মেডিসিন ও সার্জারি তো ‘স্পেশ্যালিটি’ বিষয়। কোনওভাবেই ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ নয়। তা হলে ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ হাসপাতালে শুধু দুটি ‘স্পেশ্যালিটি’ আউটডোর চালু করে ঠিক কী প্রমাণ করতে চাইছে স্বাস্থ্য দফতর?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy