Advertisement
১০ মে ২০২৪

ন’ভাই খুনে বিচার নেই তিন যুগে

জানলাবিহীন আট ফুট বাই দশ ফুটের ছোট্ট ঘর। প্রাণে বাঁচতে সেই ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে দিয়েছেন ন’জন। বাইরে বল্লম-টাঙ্গি, তরোয়াল নিয়ে ফুঁসছে শ’চারেক লোক! প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, শাবল দিয়ে মাটির দেওয়ালে গর্ত করে জনতা। লাঠির মাথায় কাপড়ে বাঁধা লঙ্কা পুড়িয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় সেই গর্ত দিয়ে। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় খড়ের চালেও।

বিচারের অপেক্ষায়। সে দিন খুন হওয়া পাঁচ ভাইয়ের বোন নইমা বিবি। ছবি—সব্যসাচী ইসলাম

বিচারের অপেক্ষায়। সে দিন খুন হওয়া পাঁচ ভাইয়ের বোন নইমা বিবি। ছবি—সব্যসাচী ইসলাম

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৪:১৪
Share: Save:

জানলাবিহীন আট ফুট বাই দশ ফুটের ছোট্ট ঘর। প্রাণে বাঁচতে সেই ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে দিয়েছেন ন’জন। বাইরে বল্লম-টাঙ্গি, তরোয়াল নিয়ে ফুঁসছে শ’চারেক লোক!

প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, শাবল দিয়ে মাটির দেওয়ালে গর্ত করে জনতা। লাঠির মাথায় কাপড়ে বাঁধা লঙ্কা পুড়িয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় সেই গর্ত দিয়ে। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় খড়ের চালেও। সেই ‘গ্যাস চেম্বার’-এ টিকতে থাকতে না পেরে একে একে বেরিয়ে আসেন ছয় সহোদর, তিন মাসতুতো-মামাতো ভাই-সহ ন’জন। এরপরেই পিটিয়ে-খুঁচিয়ে তাঁদের খুন করা হয় বলে অভিযোগ।

১৯৮১ সালের ৮ অগস্ট, শনিবার। বছর সতেরোর সানোয়ার হোসেন সে দিন বীরভূমের মাড়গ্রাম থেকে দাদাদের নিয়ে বোন নইমা বিবির শ্বশুরবাড়ি ময়ূরেশ্বরের কোটগ্রামে গিয়েছিলেন। নইমার বাড়িতেই বসে ফকিরি গানের আসর। ভাবনা ছিল, সুফিগানের উদার বার্তা গ্রামবাসীকে শোনানো। ভাইয়েরা মিলে গড়েছিলেন সুফিগানের দল। পুলিশ সূত্রের দাবি, কিছু লোকের ধারণা হয়, ওই গানে তাঁদের ভাবাবেগে আঘাত করা হয়েছে। তার পরিণতিতেই সানোয়ার (১৭) ছাড়া তাঁর পাঁচ ভাই— নুর হোসেন (৩০), নুর আলি (২৬), আবুল হোসেন (২৪), জিয়ার হোসেন (২১) আনোয়ার হোসেন (১৯), দুই মাসতুতো ভাই—জাফর শেখ (২৫), ভুনু শেখ (২১) এবং মামাতো ভাই পিয়ার শেখকে (২৪) খুন করা হয়।

প্রায় তিন-যুগ পেরিয়ে মামলা চলছে আজও।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নইমা এখনও দেখতে পান, ‘‘সকালে গানের আসর নির্বিঘ্নে মিটেছিল। দুপুরে বিশ্রামের সময় বাড়ির বাইরে থেকে ইটের টুকরো উড়ে আসে। সানোয়ারের মাথা ফেটে যায়। বাইরে উঁকি দিয়ে দেখি, শ’চারেক লোক বল্লম, টাঙ্গি, তরোয়াল, লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে। দেখতে দেখতে ওরা বাড়িতে ঢুকে পড়ে!’’ বিপদ বুঝে নইমা জানলাবিহীন এক ঘরে দাদা-ভাইদের ঢুকিয়ে দেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।

গানের অনুষ্ঠান দেখতে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে চোখের সামনে ছয় ছেলেকে খুন হতে দেখেন নইমার মা আনোয়ারা বিবি। পুলিশের কাছে অভিযোগও দায়ের করেন তিনি। বিচারের আশায় থেকে থেকে বছর আটেক আগে মারা যান বৃদ্ধা।

পুলিশ সূত্রের খবর, অভিযুক্তদের প্রত্যেকেই জামিনে মুক্ত। ঘটনার দু’বছরের মাথায় পুলিশ সিউড়ি আদালতে ৭২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা করে। চার্জগঠন করতেই ১০ বছর পেরোয়। নিহতদের পরিবারের ক্ষোভ, কোনও দিন সরকারি আইনজীবী থাকেননি, কোনও দিন ছিলেন না বিচারক। তার উপরে পুলিশ সময়ে আদালতে তথ্য-প্রমাণ জমা দেয়নি। তাতেই এত দেরি।

‘‘১৯৯৮ সালে তিন মাসের মধ্যে মামলা শেষের নির্দেশ দেয় আদালত। কিন্তু শুনানি শুরুর আগেই মারা যান সরকারি আইনজীবী। নতুন আইনজীবী নিয়োগ হতে কাটে আরও কিছু বছর’’— বলছিলেন নিহতদের পক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ মুন্না। ২০০৬ -এর মার্চে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু সিউড়ি আদালতে। মামলার চূড়ান্ত শুনানি হবে আগামী ১৯ এপ্রিল।

বীরভূম জেলা আদালতের সরকারি কৌঁসুলি রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, অভিযুক্তদের গরহাজিরায় মামলা দীর্ঘায়িত হয়েছে। গাফিলতির অভিযোগ মানেননি জেলার এক পুলিশ-কর্তা। বলেন, ‘‘পুলিশের গাফিলতি খুঁজে পেলে আদালত নিশ্চয়ই ছে়ড়ে কথা বলত না!’’ যুক্তি হিসেবে পাড়ুই, সাত্তোর-সহ একাধিক মামলার উদাহরণ টেনেছেন তিনি।

এ দিকে, মামলা চলতে চলতে অভিযুক্তদের অনেকের মৃত্যু হয়েছে। এখন জীবিত অভিযুক্তের সংখ্যা ৫৩। এলাকায় সকলেই সক্রিয় তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত। মামলার অন্যতম অভিযুক্ত তথা কোটগ্রামের তৃণমূল নেতা জাকির হোসেনের দাবি, ‘‘গ্রাম্য বিবাদের জেরে বহু নির্দোষ মানুষকে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।’’

খুনের পরে বেশ কিছু কাল নইমার শ্বশুরবাড়িতে লোক থাকত না। এখন পোড়া ঘরটায় লেগেছে নতুন টিনের ছাউনি। কিন্তু নইমার ক্ষত শুকোয়নি। ভাঙা গলায় প্রৌঢ়া গেয়ে ওঠেন, ‘‘এ বিশ্ব মালিক খোদা তুমি নিত্য-সর্বদা/পলে পলে দেখাইছ, প্রভু নব নুর পর্দা।’’ বলেন, ‘‘ভাইদের গলায় গানটা শেষ শুনেছি তিন যুগ আগে সেই দিনে। যারা ওদের মারল, তাদের শাস্তিটুকু দেখে যেতে চাই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE