Advertisement
০৩ মে ২০২৪

স্কুলে গিয়েও কেন মনিহারি দোকান চালাতে হয় অজয়কে!

আজ ১২ জুন। বিশ্ব শিশু শ্রম বিরোধী দিবস। কেমন রয়েছে খিদিরপুরের মুণিরুল, রাজাবাজারের বিলকিস আর এন্টালির অজয়ের মতো শিশুরা? শিশু শ্রমিকরা? ঘুরে ঘুরে খোঁজখবর নিল অনন্দবাজার ওয়েবসাইট।

খিদিরপুরে পরোটার লেচি বেলছে মুণিরুল।

খিদিরপুরে পরোটার লেচি বেলছে মুণিরুল।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৬ ২৩:১৩
Share: Save:

খিদিরপুর বাজারে ঢোকার গলিটার মুখেই একটা চায়ের দোকান। সেখানেই দেখা হয়ে গেল বছর বারোর মুণিরুলের সঙ্গে। পরোটার লেচি বেলছিল। খুব দ্রুত। সকালে কাস্টমাররা সেখানে ভিড় করেছে মাছির মতো। বাড়িতে বাজার নিয়ে গেলে তবে রান্নাবান্না হবে। তাই বলে রোববার সকালের আড্ডায় কি আর খামতি হতে পারে! আর তার জন্য শুধু খবরের কাগজ হলে চলে না, তার সঙ্গে পেটের আগুনও নেভাতে হয়! পরোটা, সব্জি দিয়ে। তাই দ্রুত হাতে পরোটার লেচি বেলছিল মুণিরুল। বোধহয় আমাকে দেখেই বুঝেছিল, পরোটা খেতে যাইনি! প্রশ্নে প্রশ্নে ওকে জ্বালাতে গিয়েছি! তাই একেবারে কাটা কাটা জবাব। জলদি, জলদি। দু’টো বা তিনটে শব্দে।

কত দিন ধরে কাজ করছিস এখানে?

‘‘বছর দু’য়েক।’’

বাড়ি কোথায়?

‘‘পাশেই, বস্তিতে।’’

কী কী কাজ করিস এখানে?

‘‘পরোটা বানাই। কাপ-ডিশ ধুই। কাস্টমারদের খেতে দিই। এই স...ব।’’


চুলোয় যাক লেখাপড়া! আগে কাস্টমার! লুচি ফোলাই!

স্কুলে যাস না ?

‘‘না।’’

কেন যাস না স্কুলে?

আমার দিকে অবাক চোখে তাকাল মুণিরুল। হয়তো ভাবল, কিছুই জানে না লোকটা!

তার পর বলল, ‘‘সকাল সাতটা থেকে দুপুর দু‘টো অবধি এখানেই কাজ করি যে! আবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা।’’

কথাবার্তা হয়তো আরও এগত। কিন্তু এত কথা কেন? বিরক্ত দোকানের মালিক। সে আমাকেই বলে বসল, ‘‘খাবেন কিছু? না হলে এখানে দাঁড়িয়ে অত বুক্‌নি দিচ্ছেন কেন?’’

মালিকের ধ্যাতানি খেয়ে আমি আর মুণিরুল দু’জনেই চুপ করে গেলাম।

আরও পড়ুন- ব্যারাকপুরে বৃদ্ধার জরায়ুর পাশ থেকে বের হল প্লাস্টিক বল

রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের উল্টো দিকে নারকেলডাঙা ব্রিজের কোণায় মনিহারি দোকানটায় বসে বিলকিস খাতুন। তার গল্পটাও খুব একটা অন্য রকমের নয়। তিন দাদা ইস্কুলে যায় বটে, কিন্তু বিলকিসকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত, একটানা বসতে হয় দোকানেই। তারও বয়স বারোর আশপাশে। দাদাদের দেখাদেখি বাংলা পড়তে পারে বিলকিস। কিন্ত স্কুলের চৌকাঠ মাড়ানো হয়ে ওঠেনি তার।

স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না?

প্রশ্নের উত্তরে ম্লান হাসি হাসে বছর বারোর মেয়েটি! কিছুই বলে না। শুধুই চেয়ে থাকে ফ্যাল ফ্যাল করে!

এন্টালির অজয় কর্মকারের গল্পটা, মানতেই হবে, একটু অন্য রকমের। মণিরুল বা বিলকিসের চেয়ে অজয় সামান্য ভাগ্যবান! বাবার দোকানে বসতে হয় তাকেও। কিন্তু সকালে স্কুলে যাওয়ারও সুযোগ জোটে তার! কম কথা? তবে দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত তাকে কাজ করতে হয় বাবার কাপড় সেলাইয়ের দোকানে।


এন্টালির শিশু শ্রমিক অজয়। স্কুল থেকে এসেই দোকান সামলাচ্ছে।

টুকরো টুকরো ছবি। শিশু শ্রমের। শিশু শ্রমিকের।

শিশু শ্রম কি এ ভাবেই একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে আগামী দিনের ভারতবর্ষকে?

২০১১ সালের জনগণনার (সেন্সাস) রিপোর্টের ভিত্তিতে একেবারে হালে একটি সমীক্ষা করেছিল একটি সর্বভারতীয় শিশু অধিকার রক্ষা সংস্থা ‘ক্রাই-চাইল্ড রাইট্‌স অ্যান্ড ইউ’। তাদের সেই সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, সারা দেশে ৭ থেক ১৪ বছর বয়সী শিশু শ্রমিকদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই (৩০ শতাংশ) নিরক্ষর। এ রাজ্যের ক্ষেত্রেও ছবিটা খুব একটা আলাদা নয়।

২০১১-র সেন্সাস রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট, ১৪ বছরের কম বয়সী শিশু শ্রমিকদের এক-তৃতীয়াংশই শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। আরও সহজ করে বললে, পশ্চিমবঙ্গে শিশু শ্রমিকদের প্রতি তিন জনের এক জনই নিরক্ষরতার শিকার।

উদ্বেগের এখানেই শেষ নয়। বছরে ৬ মাসের কম সময় ধরে কাজ (মার্জিনাল ওয়ার্ক ফোর্স) করতে হয়, এমন শিশুদের সংখ্যা এ রাজ্যে মোট শিশু শ্রমিকের ৪৮ শতাংশ। ভাবা যায়?

বছরে ৬ মাসের বেশি সময় ধরে (মেন ওয়ার্ক ফোর্স) কাজ করা শিশু শ্রমিক আর বছরে ৬ মাসের কম সময় ধরে কাজ (মার্জিনাল ওয়ার্ক ফোর্স) করা শিশু শ্রমিকদের মধ্যে একটি বিভাজন-রেখা রয়েছে। সেই হিসেব বলছে, প্রান্তিক শিশু শ্রমিকদের মধ্যে শিক্ষার সুযোগটা পৌঁছনোর হার যথেষ্টই কম। আর তা যথেষ্টই উদ্বেগজনক।

শিশু শ্রমিকদের মধ্যে নিরক্ষতার জেলাওয়ারি হিসেবটা শুনবেন?

উত্তর দিনাজপুর, মালদহ ও মুর্শিদাবাদের ১৪ বছরের কম বয়সের শিশু শ্রমিকদের ৪০ শতাংশেরও বেশি স্কুলে যায়নি কখনও। পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটি প্রায় ৩০ শতাংশ। তবে কলকাতা, পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া ও উত্তর ২৪ পরগনায় শিশু শ্রমিকদের নিরক্ষতার হার ১৫ শতাংশের কম। যার অর্থটা খুব স্পষ্ট। পৃথিবীতে শিশু এসেছে কোনও কিছু শেখার জন্য নয়। একটু হাতে-পায়ে বেড়ে ওঠার পর থেকেই সে শ্রমিক। বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদ, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ( জেএনইউ ) অধ্যাপক আশিস নন্দীর কথায়, ‘‘এই সব শিশু কার্যত, জন্মের পর থেকেই পণ্য। কমোডিটি। তার শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দুই কমোডিটি। তাকে খুব অল্প দামে কেনা হয়। আর তার যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়।’’

আইনজীবীরা বলছেন, ‘‘শিশু শ্রম বিরোধী আইনে সম্প্রতি যে সংশোধনী-প্রস্তাব আনা হয়েছে (২০১২), তাতে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের শিক্ষাকে অক্ষুণ্ণ রেখে পারিবারিক ব্যবসায় কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফলে, ওই সংশোধনী-প্রস্তাবে কার্যত, শিশু শ্রমকেই আইনি বৈধতা দেওয়া হয়েছে। যেটা আগামী দিনের পক্ষে আরও বিপজ্জনক। আরও উদ্বেগের। যেখানে শিশুরা এত বেশি সংখ্যায় শ্রমের সঙ্গে যুক্ত এবং শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত, সেখানে এই ধরনের সংশোধনী-প্রস্তাব শিশু শ্রম রোধে কতটা কার্যকরী হবে, বা আদৌ কার্যকরী হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।’’

বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদ আশিস নন্দীর মতে, ‘‘এটা না হয় বোঝা গেল, যে শিশুটা সাক্ষর নয়, তাকে তার নিজের বাঁচা আর তার পরিবারের সদস্যদের বাঁচানোর জন্য খেলে বেড়ানোর বয়স থেকেই পুরোদস্তুর শ্রমিক হয়ে যেতে হয়। কিন্তু, যে শিশুটার বর্ণপরিচয় হয়েছে, একটা ন্যূনতম পর্যায় পর্য়ন্ত তার লেখাপড়া হয়েছে, অ-আ-ক-খ শিখেছে, নামতা পড়তে পারে, ছবি আঁকতে পারে, সে কেন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে যাবে শ্রমিক হতে, সামান্য কর্টা পয়সা রোজগারের জন্য। তা হলে কি সরকারি স্কুলগুলোতে মিড-ডে মিলের প্রলোভন দেখিয়েও শিশুদের ড্রপ-আউটের হার বেঁধে রাখা যাচ্ছে কি না?’’

‘ক্রাই’-এর পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা অতীন্দ্রনাথ দাসের কথায়, ‘‘শিক্ষার অধিকার আইনের ষষ্ঠ বর্ষ-পূর্তির মুখে দাঁড়িয়ে শিশু শ্রমিকদের নিরক্ষতার এই হার খুবই উদ্বেগের। এরই পাশাপাশি, আমরা যদি মনে রাখি, মাধ্যমিক স্তরে এ রাজ্যের শিশুদের স্কুল-ছুটের (ড্রপ-আউট) হার প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ (সঠিক ভাবে বললে ১৮.৩ শতাংশ), তা হলেই বোঝা যাবে, শিক্ষার সঙ্গে শিশু শ্রমের সম্পর্ক কতটা গভীরে। আমরা বিশ্বাস করি, ১৮ বছর বয়সের নীচে থাকা সব শিশুকেই শিক্ষার সম্পূর্ণ অধিকার দেওয়া উচিত। আর, তাদের যেন কোনও ভাবেই, অত অল্প বয়সে কোনও ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে না হয়, তা সুনিশ্চিত করা।’’


বই ভুলে পরোটা শিল্পে মুণিরুল!

১৯৯২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনে ভারত জানিয়েছিল, দেশ থেকে শিশু শ্রম মুছে ফেলতে ধাপে ধাপে ইতিবাচক পদক্ষেপ করা হবে। অথচ তার ২৫ বছর পরেও, এখনও সেই লক্ষ্যে পৌঁছনো তো দূরের কথা, কয়েক ইঞ্চিও এগনো যায়নি।

এই প্রসঙ্গে ‘ক্রাই’-এর পলিসি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর কোমল গনোত্রার বক্তব্য, ‘‘গত ১০ বছরে সারা দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আগের চেয়ে সামান্য কমলেও, ৯ বছরের কম বয়সী শিশুদের হারটা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩৭ শতাংশ। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, শিশু শ্রম মোকাবিলায় যে আইন বানানো হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় আদৌ যথেষ্ট নয়।’’

খিদিরপুরের মুণিরুল, রাজাবাজরের বিলকিস বা এন্টালির অজয় অবশ্য অত শত বোঝে না!

তারা জানে, আগামী কালও তাদের দোকানেই এসে বসতে হবে। স্কুলে যাওয়া হবে না। হয়তো বা আগামী মাসে বা আগামী বছরেও!

প্রতি বছরই ১২ জুন আসবে। চলেও যাবে।

কিন্তু মুণিরুল, বিলকিস, অজয়দের রোজনামচা বদলাবে কি?

পাল্টাবে তাদের বিধিলিপি?

তথ্য সূত্র ও সহায়তা: ‘ক্রাই-চাইল্ড রাইট্‌স অ্যান্ড ইউ’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE