আশায় ছিলেন, এ বার জামিন হয়ে যাবে। চাপা উত্তেজনা সত্ত্বেও মোটামুটি ফুরফুরেই ছিলেন সোমবার সারাদিন। তাল কাটল রাত ৯টা নাগাদ, যখন জানতে পারলেন, আদালত তাঁর জামিনের আর্জি খারিজ করে দিয়েছে। নিমেষে মেজাজ হারালেন মদন মিত্র। হাতের কাছে যাঁকে পেলেন, ক্ষোভ উগরে দিয়ে বললেন, ‘‘কুণালের মতো আমাকেও বলি করা হচ্ছে।... কোথায়, কী বোঝাপড়া হয়েছে— সবই আমার জানা আছে।’’
এসএসকেএম-এর উডবার্ন ওয়ার্ডের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ২০ নম্বর কেবিনে মদনের দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা তখন ‘দাদা’-র রুদ্রমূর্তি দেখে সিঁটিয়ে গিয়েছেন। বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসে মদন থেকে-থেকেই চিৎকার করে উঠছেন, ‘‘দলনেত্রীর উপরে অগাধ আস্থা রাখারই ফল পাচ্ছি। সবাই বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি জেলে পচছি।’’ কর্মীরা তাঁকে থামানোর চেষ্টা করলেন। তাঁদের পাত্তা না দিয়ে মদন বলে চলেন, ‘‘এত দিন জেলে রয়েছি। মুখ্যমন্ত্রীর কথা না হয় বাদ দিচ্ছি, এক জন মন্ত্রীও আসেনি দেখা করতে! কেউ ফোন করেও বড় একটা খবর নেয় না। সবাই কি ভয় পেয়ে গেল? মনে করছে, মদনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে সিবিআই ডাকতে পারে?’’ তার পর একটু থেমে মদনোচিত তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘জেল থেকে বেরোলে তো ওরাই নানা সাহায্য চাইতে আসবে।’’
সাড়ে পাঁচ মাস আগে, গত ১২ ডিসেম্বর সারদা-মামলায় গ্রেফতার হন মদন। তার পর থেকে শুনানির কারণে যে ক’দিন তাঁকে আদালতে আনা হয়েছে, প্রতিবারই তাঁর মুখে শোনা গিয়েছে মমতা ও দলের নামে স্লোগান।
দলও পাশে দাঁড়িয়েছিল মদনের। তাঁর গ্রেফতারের পর ‘সিবিআইয়ের চক্রান্তের বিরুদ্ধে’ ময়দানে গোষ্ঠ পালের মূর্তির পাশে প্রতিবাদ মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে হাজির হয়েছিলেন মমতাও। মদনকে মন্ত্রী পদেও রেখে দেন তিনি। এই যেখানে প্রেক্ষাপট, তখন গত সোমবার নগর দায়রা আদালতে জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পরে মদন কেন তাঁর ঘনিষ্ঠদের সামনে দল ও নেত্রীর বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ উগরে দিলেন, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে।
যে সময় মন্ত্রী গ্রেফতার হন, তখন সারদা-তদন্ত প্রতিদিন সংবাদপত্রের শিরোনামে। নিয়ম করে ধরপাকড়-জেরা-তল্লাশি চলছে। মন্ত্রীর গ্রেফতারের পর দল ও সরকারের আর কোন কোন মাথাকে ধরে টান দেবে সিবিআই, তা নিয়ে জল্পনায় গোটা রাজ্য সরগরম। যে তালিকার শীর্ষে ছিলেন তৃণমূলের তৎকালীন দু’নম্বর মুকুল রায়। কিন্তু সময় গড়াতে দেখা গেল, এক বার জেরার পরে মোটামুটি স্বস্তিতেই রয়েছেন মুকুল। ইতিমধ্যে জামিন পেয়ে গিয়েছেন দলের আর এক সাংসদ এবং নেতা।
মদন-ঘনিষ্ঠদের ব্যাখ্যা, গোড়ায় মদনের প্রতি দল যে সহমর্মিতা দেখিয়েছিল, ইদানীং তা যেন উধাও। তাঁর সঙ্গে নেত্রী ও দলের প্রথম সারির প্রায় কেউই এখন আর যোগাযোগ রাখেন না। আদালতে মন্ত্রীকে আইনি লড়াই লড়তে হচ্ছে নিজের উদ্যোগে। ফলে মদনের ধারণা হয়েছে যে, তাঁকে বলি দিয়ে সারদার আঁচ থেকে বাঁচতে চাইছে দল। আর সেই কারণেই ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘দেড়শো দিন বন্দি রয়েছি। এক দিনের জন্যও দলনেত্রীর বিরুদ্ধে একটি কথাও বলিনি। যাঁরা বলেছেন, তাঁরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সিবিআই তাঁদের ছুঁতেও পারছে না। কোথায়, কী বোঝাপড়া হয়েছে, সব আমার জানা আছে।’’
মদনের এই অভিযোগ মানতে নারাজ তৃণমূল নেতাদের একাংশ। প্রকাশ্যে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যেতে চাইছেন না কেউ। দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় শুধু বলেছেন, ‘‘আমি মনে করি না মদনের রাজনৈতিক জীবনে বিরাট কোনও ক্ষতি হয়েছে।’’ একান্ত আলোচনায় এই অভিমতের ব্যাখ্যা দিয়ে অনেক তৃণমূল নেতা বলছেন— দলনেত্রী মদনের প্রতি বিরূপ, এটা প্রমাণ হলো কীসে! প্রথমত, মুকুলকে দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দিলেও মদনকে মন্ত্রী রেখে দিয়েছেন তিনি। তার উপরে জেলবন্দি হলেও সরকারি বদান্যতায় মদন রয়েছেন সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের কেবিনে। চিকিৎসকেরা তাঁকে তেমন অসুস্থ বলে মনে না
করা সত্ত্বেও। হাসপাতালে সম্ভাব্য সব রকম সুযোগসুবিধাই রাখা হয়েছে মদনের জন্য। মিলন মুখোপাধ্যায়ের মতো আইনজীবী মদনের হয়ে লড়ছেন। তিনি এবং অন্য আইনজীবীরা সব রকম ভাবে সিবিআইয়ের অভিযোগ ও যুক্তি ‘অসার’ প্রমাণ করার জন্য প্রাণপাত করছেন। ওই তৃণমূল নেতাদের মতে, মদনকে বলি করার চেষ্টা হলে আইনজীবী নিয়োগে তাঁর প্রভাব পড়ত। তাঁদের তৎপরতাও দেখা যেত না। সুতরাং মন্ত্রীর ক্ষোভ অসঙ্গত।
মদন যে এই যুক্তি মানছেন না, সেটা অবশ্য তাঁর সে দিনের আচরণ থেকেই স্পষ্ট। তাঁর এক অনুচরের কথায়, ‘‘শেষ কবে দাদা এ রকম মেজাজ হারিয়েছেন, মনে করতে পারছি না। সেই রাতে ওই রকম রেগে যাওয়ায় শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। কোনও রকমে ‘নেবুলাইজার’ দিয়ে দাদাকে শান্ত করেন চিকিৎসকেরা। তবে বাকি রাতটা উনি আর ঘুমোননি। মাঝে-মধ্যেই বিছানায় উঠে বসে নিজের ভাগ্যকে দুষেছেন।’’ মন্ত্রীর আইনজীবী নীলাদ্রি ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমার মক্কেলকে এ রকম তিরিক্ষি মেজাজে কখনও দেখিনি।’’
ঘটনা হল, মদনের ক্ষোভ পুরোটা অযৌক্তিক বলে কিন্তু মনে করছেন না বিরোধীরা। কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের মতে, ‘‘সকলেরই ধারণা, নিজেকে এবং পরিবারের লোকজনকে বাঁচাতে মুখ্যমন্ত্রী এখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আঁতাঁত করছেন। সিবিআই যাতে আর না এগোয়, সে জন্যই তিনি হয়তো তাঁর মন্ত্রী মদনকে বলি দিতে তৈরি আছেন। এই অঙ্ক বুঝে ফেলে হতাশা থেকে মদন ক্ষোভপ্রকাশ করে থাকলে আশ্চর্য হব না।’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ‘‘মাছরাঙারাই শুধু কলঙ্কের ভাগীদার।’’
মদনকে সহানুভূতি দেখাচ্ছেন এমন তৃণমূল নেতার সংখ্যাও অবশ্য কম নয়। তাঁদের মতে, দল সত্যি সত্যিই তাঁর উপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে। এক শীর্ষ তৃণমূল নেতার মন্তব্য, ‘‘যারা পাহাড় নিয়ে চলে গেল, তাদের কিছু হল না। আর নুড়ি-পাথর কুড়নোর অভিযোগে মদনকে দিনের পর দিন জেলে থাকতে হচ্ছে।’’
মদন-ঘনিষ্ঠদের অনেকে মনে করছেন, এত দিন হাসপাতালে থাকাটাই মন্ত্রীর কাল হয়েছে। জামিনের আর্জির বিরোধিতা করতে গিয়ে আদালতে এই বিষয়টিই তুলে ধরেছেন সিবিআইয়ের আইনজীবী। বলেছেন, এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, মন্ত্রী কতটা প্রভাবশালী। সে কথা মদনকে বলতেই অবশ্য তিনি খিঁচিয়ে উঠেছেন। তাঁর কটাক্ষ, এক জন তো চার দিন জেলে থেকে চল্লিশ দিন হাসপাতালে ছিলেন। তিনি তো দিব্যি জামিন পেয়ে গেলেন। এখন নবান্নে গিয়ে দলনেত্রীর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈঠক করছেন।
যাঁদের জামিন পাওয়া নিয়ে মদন ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তাঁরা হলেন, প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসু ও দলের সহসভাপতি রজত মজুমদার। কিন্তু শাসক দলের অনেকেই মনে করেন, এঁরা কেউই বড় দরের নেতা নন। দলের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগও অল্প দিনের (সৃঞ্জয় তো জামিন পাওয়ার পর দল ও সাংসদ পদ দুই-ই ছেড়ে দিয়েছেন)। কিন্তু মদন গত কয়েক দশক ধরে রাজনীতি করছেন। তিনি দলের প্রথম সারির নেতা। তাঁর ডাকে কয়েক হাজার লোক মিছিলে হাঁটে। সেই কারণেই সম্ভবত তিনি জামিন পেলে তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারেন, এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে আদালতের কাছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy