পূর্ণিমা বিশ্বাস। গ্রেফতারের আগে বাগুইআটিতে। ছবি: শৌভিক দে।
স্বামীর সঙ্গে নিজেরই বোনের ঘনিষ্ঠতা মেনে নিতে পারেনি সে। নিজের সংসার বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টায় তাই বোনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর সে জন্যই নতুন ফ্ল্যাটের টোপ দিয়ে সে হাত করেছিল তন্ত্রমন্ত্রে আগ্রহী রামপদ মান্নাকে। তমলুকের গড়কিল্লা গ্রামে যুবতীর মুণ্ডহীন দেহ উদ্ধার হওয়ার ঘটনায় নিহতের দিদি পূর্ণিমা বিশ্বাসকে গ্রেফতার করার পরে এমন সব ঘটনাই সামনে এসেছে তদন্তকারীদের। সেই সঙ্গে পুলিশ প্রায় নিশ্চিত, তন্ত্রসাধনার জন্য নরবলি নয়, পার্বতী সরকার নামে ওই তরুণীকে খুনের পিছনে আসলে রয়েছে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক।
বৃহস্পতিবারই পার্বতীর পরিচয় জানতে পেরেছিলেন তদন্তকারীরা। তার পর শুক্রবার সকালে বাগুইআটির হেলাবটতলা থেকে পার্বতীর দিদি পূর্ণিমাকে গ্রেফতার করে তমলুক থানার পুলিশ। খুনের ষড়যন্ত্রে মদত দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় পার্বতীর বৌদি টুকটুকি ওরফে পুঁটি সর্দারকেও। একই কারণে পার্বতীর আর এক বৌদিকেও আটক করেছে পুলিশ। পূর্ণিমার সংসার বাঁচাতেই এই দু’জনে খুনের ব্যাপারে তাঁকে সহায়তা করেছিল বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া এ দিন বলেন, ‘‘তদন্তে নেমে আমরা জানতে পেরেছি, পূর্ণিমা তাঁর স্বামীর সঙ্গে বোন পার্বতীকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছিল। তার পরেই বোনকে খুন করার ছক কষতে থাকে সে। তার পর রামপদকে ফ্ল্যাটের লোভ দেখিয়ে খুনের দায়িত্ব দেয়।’’
কিন্তু ঘটনায় পূর্ণিমা জড়িত বলে জানা গেল কী করে?
তমলুক থানা সূত্রে খবর, রামপদর মোবাইলের কল-লিস্ট খতিয়ে দেখতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, খুনের আগে এবং পরে একটি নির্দিষ্ট নম্বরে মোট ৫২ বার যোগাযোগ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় ওই সিম-কার্ড রয়েছে পূর্ণিমার স্বামী বাপি বিশ্বাসের নামে। কিন্তু মোবাইলটি ব্যবহার করে পূর্ণিমা। সন্দেহের সূত্রপাত সেখানে থেকেই।
এই বাপি আবার এলাকায় ‘ব্যস্ত বাপি’ নামে কুখ্যাত। তার বিরুদ্ধে নানা অসামাজিক কাজে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। অস্ত্র-মামলায় জেলও খেটেছে সে। এই ঘটনার পরে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বাপি ফেরার হয়ে যায়। তার এ ভাবে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও ভাবাচ্ছিল তদন্তকারীদের।
গত শনিবার, লক্ষ্মীপুজোর দিন তমলুকের গড়কিল্লা গ্রামে রামপদর বাবার পান বরজেই মিলেছিল পার্বতীর মুণ্ডহীন দেহ। আশপাশে পুজো ও যজ্ঞের নানা সামগ্রীও পাওয়া যায়। সেই সূত্র ধরে তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, গ্রামের ছেলে রামপদর তন্ত্রমন্ত্রে ঝোঁক রয়েছে। তবে সে গ্রামে থাকে না। কলকাতার বাগুইআটিতে সেলুনে কাজ করে। পরে বাগুইআটি থেকেই রামপদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে খবর, জেরায় সে খুনের কথা কবুলও করে। তবে খাড়া করে তন্ত্রসাধনা ও বলির তত্ত্ব। ওই যুবতীর সঙ্গে খুনের দিনই তার প্রথম আলাপ হয় বলেও দাবি করেছিল রামপদ। কিন্তু পার্বতীর পরিচয় জানার পরে পুলিশের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, রামপদ পুরো মিথ্যে কথা বলছে। শুরু হয় দফায় দফায় জেরা। পুলিশের দাবি, এর পর রামপদও জেরায় স্বীকার করে নেয় যে পূর্ণিমাই তাকে বোনকে খুনের দায়িত্ব দিয়েছিল।
কিন্তু নিজের গ্রামের বাড়ির কাছে এনে কেন পার্বতীকে মারল রামপদ?
পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার জবাব, ‘‘আসলে রামপদ ভেবেছিল এতটা দূরে মেয়েটিকে কেউ চিনতে পারবে না। সে জন্য মুণ্ড কেটে পাশের গ্রামের খালে ফেলেও দিয়েছিল। আর খুনের মূল উদ্দেশ্য আড়াল করার জন্য ঘটনাটিকে তন্ত্রসাধনা ও বলি হিসেবে সাজাতে চেয়েছিল।’’ তদন্তকারীদের অবশ্য বক্তব্য, ঘটনাটিকে তন্ত্রসাধনা ও বলি হিসেবে দেখাতে চেয়েই বোকামি করেছে রামপদ। শেষমেশ সেই তন্ত্রসাধনার যোগসূত্র ধরেই প্রকৃত সত্য সামনে এসেছে।
কিন্তু পার্বতী কেন রামপদর সঙ্গে তমলুকে গেল?
তদন্তকারীরা জানান, স্বামী সঞ্জীবের সঙ্গে ঝগড়া করে পার্বতী দু’ মাস ধরে বাপের বাড়িতে থাকছিলেন। তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে পার্বতীর পারিবারিক সমস্যা মেটানোর আশ্বাস দিয়েছিল রামপদ। সে কথা বলেই লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন পার্বতীকে সঙ্গে নিয়ে সে তমলুকের গড়কিল্লা গ্রামে নিয়ে যায়। তারপর পার্বতীর ধড়-মুণ্ড আলাদা করে রামপদ ফিরে আসে বাগুইআটিতে, যেখানে সে তপন নাম নিয়ে থাকত।
শুক্রবার অশ্বিনীনগরে পার্বতীর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দেখা গেল স্বামী সঞ্জীব, শাশুড়ি আলোদেবী, বছর ছয়েকের ছেলে সৌরভ সকলেই বিপর্যস্ত। কাঁদতে কাঁদতে সঞ্জীব বললেন, ‘‘বাপি আর পূর্ণিমা মিলে আমার সংসারটা একেবারে শেষ করে দিল। ওদের যেন ফাঁসির সাজা হয়।’’ অঝোরে কাঁদছিল মা-হারা সৌরভও। কাঁদতে কাঁদতেই সে বলে, ‘‘শুক্রবার বিকেলে দিদিমার বাড়ি থেকে জ্যাংরা পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে এসেছিলাম। তারপরে মা আমাকে ফিরে যেতে বলল। মা যে আর কোনও দিন আসবে না, বুঝতে পারিনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy