এক কাল ছিল যেখানে সেখানে ঝান্ডার দাপট! এখন যত প্রতিবাদ, প্রায় সবই ঝান্ডা আড়ালে রেখে।
সংগঠনের ত্রুটি-বিচ্যুতি সারাতে সিপিএম যখন রাজ্য প্লেনামে যাচ্ছে, সেই সময়েই রাজনৈতিক আন্দোলনের এই ধরন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে দলের অন্দরে।
দু’বছর আগের লোকসভা ও কয়েক মাস আগের বিধানসভা ভোটের ফলের নিরিখে বিচার করলে বিরোধী আসনে গিয়ে নজর কাড়ার মতো সাফল্য নেই সিপিএমের ঝুলিতে। অথচ সারদা থেকে নারদ-কাণ্ড, টেট কেলেঙ্কারি থেকে নারী নির্যাতন— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে হাতিয়ার কম পায়নি তারা। তবু ভোটের বাক্সে দাগ কাটতে না পেরে গোটা বাম শিবিরই এখন প্রায় মুহ্যমান! এই প্রেক্ষিতেই দলের মধ্যে মাথা তুলছে নতুন বিতর্ক। দলের একাংশ দাবি করতে শুরু করেছে, ‘সেভ ডেমোক্র্যাসি’র মতো ঝান্ডাহীন মঞ্চের পাটাতন ছেড়ে সিপিএমের এ বার উচিত সরাসরি দলীয় পতাকা নিয়ে আন্দোলনে যাওয়া। বিরোধী ভূমিকায় থাকাকালীন যে কাজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করতেন।
তৃণমূলের জমানার প্রথম ইনিংসে কোনও বিষয়েই বলতে গেলে সে ভাবে তেড়েফুঁড়ে আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকেনি সিপিএম। সারদা-কাণ্ডের জেরে বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থায় প্রতারিত মানুষের দাবি আদায়ের লড়াইয়ে কাজে লাগানো হয়েছে আমানতকারী ও এজেন্টদের যৌথ মঞ্চকে। সেখানে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও অন্য দলের নেতারা একসঙ্গেই সামিল হয়েছেন। তবে রাজনৈতিক ব্যানার সামনে রেখে নয়। একই ভাবে গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে তৈরি হয়েছে ‘সেভ ডেমোক্র্যাসি ফোরাম’। কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান, সিপিএমের সুজন চক্রবর্তীদের সঙ্গেই সেই মঞ্চে যোগ দিয়েছেন প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়, শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার বা সিপিএমেরই আইনজীবী-নেতা বিকাশ ভট্টাচার্যের মতো ব্যক্তিত্ব। আবার শাসক দলের হাতে হেনস্থার শিকার হওয়া লোকজনকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘আক্রান্ত আমরা’ নামে আলাদা মঞ্চ। বিধানসভা ভোটে এই ধরনের মঞ্চ থেকে কিছু মুখ তুলে এনে প্রার্থীও করা হয়েছে। লাভ কিছু হয়নি।
সিপিএমের রাজ্য কমিটির এক সদস্যের প্রশ্ন, ‘‘এই ধরনের নানা মঞ্চ গড়ে আন্দোলন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের বড় অংশ আমাদের দেখতেই পাননি! তাঁরা মনে করেছেন, সিপিএম রাস্তায় নেই। তার চেয়ে সরাসরি দলের নাম নিয়ে আন্দোলনে থাকাই ভাল।’’ এই মতের প্রবক্তারা উদাহরণ দিচ্ছেন, বিরোধী নেত্রী মমতা জমি আন্দোলন যেমন চুটিয়ে করেছেন, তেমনই রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যুর মতো অরাজনৈতিক ঘটনাকেও রাজনৈতিক রং দিতে তাঁর আটকায়নি। তাতে যে খারাপ কিছু হয়নি, ভোটে তৃণমূলের ফলই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। দলের গণসংগঠনের কেউ কেউ সুযোগ পেলে বিষয়টি আজ, শুক্রবার থেকে শুরু হতে যাওয়া রাজ্য প্লেনামের আসরেও তুলতে চান।
রাজ্য নেতৃত্ব অবশ্য দলের অন্দরের এমন দাবির সঙ্গে সহমত নন। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের যুক্তি, ‘‘দলের ঝান্ডা নিয়ে গেলেই প্রতিবাদের পরিসর কিছুটা ছোট হয়ে যায়। সামাজিক পরিমণ্ডল এখন যা, সেখানে অনেক ব্যাপারেই সরাসরি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মানুষ পছন্দ করছেন না। সেটা বুঝেই আমাদের এগোতে হবে।’’ সেই যুক্তি মাথায় রেখেই এ বারের প্লেনামের খসড়া রিপোর্টে আন্দোলন ও সংগঠন আরও ছড়িয়ে দেওয়ার ডাক দেওয়া হয়েছে নতুন নতুন অপরীক্ষিত ক্ষেত্রে। কিন্তু সেটা নাগরিক মঞ্চের হাত ধরেই। ঝান্ডা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নয়।
দলের এক রাজ্য নেতার মতে, ‘‘ভোটের ফল বেরিয়েছে কয়েক মাস। সামনে উৎসবের মরসুম। আন্দোলন কিছু হচ্ছে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়ার সময় এখনও আসেনি!’’ রাজ্য নেতৃত্বের যুক্তি, ২০১১ সালে পরিবর্তনের পরে ঝান্ডাহীন মঞ্চ গড়ে আন্দোলন দানা বাঁধাতেও এক বছরের বেশি সময় লেগেছিল। ‘সেভ ডেমোক্র্যাসি’ তৈরি হয়েছিল আরও পরে। তাই লাল ঝান্ডার গুণ ফিরে পেতে এখনই উদগ্রীব নয় আলিমুদ্দিন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy