Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
সুচেতা-খুন

আরও এক তরুণী জড়িত কি, খুঁজছে পুলিশ

তিনি হার মানাতে পারেন বব বিশ্বাসকেও। সুচেতার মৃত্যুর তদন্তে নেমে মূল অভিযুক্ত সমরেশ সরকার সম্পর্কে এমন ধারণাই ক্রমশ জোরালো হচ্ছে পুলিশের একাংশের মধ্যে।

দুর্গাপুরে সমরেশ সরকারের বাড়িতে তালা ঝোলাল পুলিশ। সোমবার বিকাশ মশানের তোলা ছবি।

দুর্গাপুরে সমরেশ সরকারের বাড়িতে তালা ঝোলাল পুলিশ। সোমবার বিকাশ মশানের তোলা ছবি।

সুব্রত সীট ও বিতান ভট্টাচার্য
দুর্গাপুর ও ব্যারাকপুর শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৯
Share: Save:

তিনি হার মানাতে পারেন বব বিশ্বাসকেও। সুচেতার মৃত্যুর তদন্তে নেমে মূল অভিযুক্ত সমরেশ সরকার সম্পর্কে এমন ধারণাই ক্রমশ জোরালো হচ্ছে পুলিশের একাংশের মধ্যে।

সুজয় ঘোষের ‘কহানি’ ছবির চরিত্র বব বিশ্বাস আপাতদৃষ্টিতে অতি নিরীহ, ছাপোষা গেরস্ত। আসলে সে ঠান্ডা মাথার খুনি। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সমরেশ সরকারও তাঁর দায়িত্বশীল স্বামী ও পিতার ভূমিকার আড়ালে যে পরিচিতির জাল তৈরি করেছিলেন, তার ব্যাপ্তি আর গভীরতা, দুই-ই অবাক করছে পুলিশকে।

তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছে, কেবল নিহত সুচেতা চক্রবর্তী নয়। সম্ভবত একাধিক মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সমরেশেবাবুর। তাঁদের মধ্যে একজনের উপর নজরও রাখছে পুলিশ। ব্যাঙ্কের কর্মী ও স্থানীয় নানা সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর পঞ্চান্নর এক মহিলা ও তাঁর তরুণী মেয়ে ভাড়া থাকতেন ব্যাঙ্ক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে। সমরেশবাবু তাঁদের ‘আত্মীয়’ বলে পরিচয় দিতেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সমরেশ আসতেন মাঝেমাঝে। মে মাস পর্যন্ত তাঁরা সেখানে ভাড়া ছিলেন। পরে উঠে যান কাছাকাছি এলাকায় অন্য একটি আবাসনে। পুলিশের ধারণা, নতুন বাড়িটি তুলনায় নিরিবিলি এলাকায়, কারও আসা-যাওয়া নজরে পড়ার আশঙ্কা কম। তাই সেখানে উঠে যান মা-মেয়ে। সমরেশবাবুর স্কুটারটি এখনও সেই বাড়িতেই আছে বলে পুলিশ জেনেছে।

ব্যাঙ্কের কয়েক জন কর্মী জানান, ওই তরুণীর সঙ্গে ইদানীং মামড়া বাজার এলাকায় সমরেশবাবুকে একাধিক বার ঘুরতে দেখা গিয়েছে। তাঁদের দাবি, দু’জনের চালচলনে ঘনিষ্ঠতা নজরে এসেছে। একজন দাবি করেন, শুক্রবার বিকেলের দিকেও দু’জনকে মামড়া বাজারে এক সঙ্গে দেখা গিয়েছে।

সুচেতা ও তাঁর মেয়েকে খুনের ঘটনায় ওই তরুণীর কোনও ভূমিকা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এ দিন ওই তরুণী ফোনে দাবি করেন, সমরেশবাবু তাঁদের ‘‘অভিভাবক।’’ তাঁর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের প্রশ্নই নেই। তবে সুচেতাকে তিনি চিনতেন কিনা, প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘এ বিষয়ে আমি কিছুই বলব না।’’

অন্য দিকে, সুচেতার সঙ্গে সমরেশবাবুর সম্পর্কের গভীরতা নিয়েও নতুন করে চিন্তা করা হচ্ছে। ইঙ্গিত মিলছে, দু’জনের মেলামেশা কেবল দুর্গাপুরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সোমবার ব্যারাকপুর গাঁধীঘাটের পাশে একটি সরকারি টুরিস্ট লজের কর্মীদের কয়েকজন দাবি করেন, সুচেতা ও দীপাঞ্জনাকে সম্প্রতি সেখানে যেতে দেখেছেন। সংবাদপত্রে সুচেতার ছবি দেখে সেখানকার চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মী জানান, গত মাস তিনেকের মধ্যে অন্তত বার তিনেক ছুটির দিনে ওই লজে সুচেতাকে দেখা গিয়েছে। যদিও লজের রেজিস্টারে সমরেশ বা সুচেতার নাম নেই। সমরেশবাবুর ছবি দেখে অবশ্য কর্মীরা নির্দিষ্ট ভাবে কিছু মনে করতে পারেননি। ছুটির দিনে বাড়িতে থাকলেও মোটরবাইক নিয়ে ‘গৃহস্থালি’-র কাজে বেশ কিছুক্ষণের যে বেরিয়ে যেতেন, সে কথা জানিয়েছেন সমরেশের স্ত্রী উৎসাদেবী। দুর্গাপুরে সুচেতার প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, মাঝেমাঝেই শনি-রবিবার মেয়েকে নিয়ে বাইরে যেতেন সুচেতা। বলতেন, কলকাতায় আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছেন। যে শুক্রবার তিনি নিহত হন, তার আগের শনি-রবিবারও তিনি বাইরে ছিলেন।

পেশার ক্ষেত্রেও সুচেতার জন্য কিছু কিছু অনিয়ম করে থাকতে পারেন সমরেশবাবু, সেই ইঙ্গিত মিলছে। সমরেশবাবু যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মামড়া বাজার শাখার ম্যানেজার ছিলেন, সুচেতার সেই ব্যাঙ্কে লকার আছে। ব্যাঙ্কের খাতা অনুযায়ী ১০ জুলাই শেষ বার লকার খোলা হয়েছিল। কিন্তু ব্যাঙ্কের এক কর্মীর দাবি, গত সপ্তাহের গোড়ার দিকে লকার রুমে সুচেতাকে নিয়ে ঢুকেছিলেন সমরেশ। লকার খোলা হয়েছিল। নিরিবিলিতে ফোন করার জন্য হঠাৎ লকার রুমে ঢুকে পড়ে তা তিনি দেখে ফেলেন বলে ওই কর্মীর দাবি। ‘দুঃখিত’ বলে সঙ্গে-সঙ্গে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু তিনি লক্ষ করেন, লকার খোলার বিষয়টি ব্যাঙ্কের খাতায় তোলা হয়নি। কেন? ওই কর্মী বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই গোপন ব্যাপার ছিল। তাই সমরেশবাবু এ কাজ করেছিলেন। সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’’

সমরেশবাবু নিজের ব্যাঙ্ক থেকে ২০১৪-র জুনে এক বার ২০ লক্ষ এবং এক বার ৩ লক্ষ টাকা গৃহঋণ নেন। ৩ লক্ষ টাকার ঋণ শোধ হয়েছে। জুলাইয়ে তিনি পিএফ থেকে ৩ লক্ষ টাকা ব্যক্তিগত ঋণ নেন। এই ব্যাঙ্কে তাঁর সেভিংস আমানত আছে তিনটি। রেকারিং ডিপোজিট দু’টি। মোট অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। এ দিন সাংবাদিক সম্মেলন করে সমরেশবাবুকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ।

সোমবার সুচেতার বাড়িতে ফরেন্সিক দল আসার কথা থাকলেও, শেষমেশ আসেনি। দুপুরে শ্রীরামপুর থানা থেকে দুই পুলিশ অফিসার এসে সমরেশবাবু ব্যাঙ্কের যে আবাসনে থাকতেন, সেখানে যান। জামাকাপড়, কাগজপত্র, ডায়েরি পরীক্ষা করেন। পরে দুর্গাপুরের নিউ টাউনশিপ থানার পুলিশ ঘরটি ‘সিল’ করে দেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE