এখনও অধরা সুদীপ্ত ঘোষ। শনিবার দিনভর বোলপুরের রাস্তায় তাই এ ভাবেই প্রতিবাদ জানালেন স্থানীয় এক বাসিন্দা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের হাতে পুলিশের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা এ রাজ্যে নতুন নয়। কিন্ত গত তিন বছরে শাসক দলের হাতে পুলিশ যে ভাবে বারবার আক্রান্ত হয়েছে এবং তার পরেও তাদের ‘ঠুঁটো’ হয়ে থাকতে হয়েছে, তাতে আশঙ্কায় বাহিনীরই একাংশ।
এবং এতে গোটা পুলিশ বাহিনীর মনোবলই যে তলানিতে ঠেকছে, সে বিষয়ে কোনও সংশয় নেই ওই পুলিশকর্তাদের। তাঁদের বক্তব্য, যে ভাবে একের পর এক ঘটনায় কিল খেয়ে কিল হজম করে যেতে হচ্ছে, তাতে পরে বাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করা সহজ নয়। এক পদস্থ পুলিশ কর্তার কথায়, “পুলিশ সমাজের রক্ষক। কিন্তু সেই রক্ষকই যখন আক্রান্ত এবং আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাকেই নবান্নের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে, তখন আইনভঙ্গকারীরাই উৎসাহিত হচ্ছে।” রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এ ধরনের একের পর এক ঘটনার পরেও যে ভাবে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হচ্ছে, তার সুদূরপ্রসারী ফল যে ভাল হবে না, তা বুঝছেন উঁচুতলার অফিসারেরাও।
তাঁরা বলছেন, শাসক দল নিজেদের স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করে, এটা কারও অজানা নয়। বাম আমলেও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু বর্তমানে যে ভাবে পুলিশের প্রতিটি কাজে নবান্ন নাক গলাচ্ছে এবং সেই ‘ডিক্টেট’ মতো পুলিশকে চলতে হচ্ছে, তাতে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে বলে মনে করছেন কর্তাদের একাংশ।
তা বলে বোমার আঘাতে বা ওয়ান শটারের গুলিতে উর্দি পরা পুলিশ রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়লেও বাহিনীর কর্তারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকবেন? প্রশ্ন তুলেছেন প্রশাসনের অনেকেই। তাঁদের বক্তব্য, বুধবার রাতে বোলপুর থানায় ঢুকে শাসক দলের নেতার বিরুদ্ধে পুলিশকে মারধরের যে অভিযোগ উঠেছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বীরভূমের এসপি অলোক রাজোরিয়া যা বলেছেন, সেটাই এ রাজ্যের পুলিশের প্রকৃত ছবি। মাত্র চার বছর চাকরি হয়েছে, তা সত্ত্বেও যে ভাবে তিনি বর্তমান পুলিশি ব্যবস্থার সার সত্যটা বলেছেন, তা প্রশংসারই দাবি রাখে বলে মত নবান্নের একাংশের।
যদিও প্রশাসনেরই অন্য একটি অংশ এর বিরুদ্ধ মত পোষণ করে বলেছেন, এসপি-র চাকরি পুলিশে শুরু বলেই গণ্য হয়। এর পর যদি রাজোরিয়াকে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন পদে বদলি করে দেওয়া হয়, তখন কাউকেই উনি পাশে পাবেন না। কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেনের প্রসঙ্গ টেনে প্রশাসনের ওই কর্তারা বলছেন, নতুন সরকারের গোড়ায় এমন ‘শাস্তিমূলক’ পদক্ষেপের সাক্ষী থেকেছে রাজ্যের মানুষ। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে ধর্ষণের কথা কবুল করে উত্তরবঙ্গে বদলি হতে হয়েছিল ওই মহিলা আইপিএসকে।
কিন্তু কী বলেছেন বীরভূমের পুলিশ সুপার? কেন থানায় হামলা চালানোর পরেও শাসক দলের নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না, সেই প্রসঙ্গে শুক্রবার সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, “এটুকু বলতে পারি, পুলিশ খুব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই মিলে এর মোকাবিলা করব।” রাজোরিয়ার এই বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে দেখে শনিবার সকাল থেকেই তাঁকে ফোন করতে শুরু করেন বিভাগীয় সিনিয়রেরা। তাঁদের কয়েক জনের পরামর্শ, সব সত্য বলতে নেই। সরকারের নির্দেশ পালন করাই পুলিশের কর্তব্য।
সিনিয়রদের এ হেন পরামর্শে কিছুটা চাপের মুখেই আগের দিনের মন্তব্য থেকে সরে এসেছেন রাজোরিয়া। শনিবার তিনি বলেন, “আমি ও রকম কোনও কথা বলতে চাইনি। আমার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।” তা হলে আপনার বক্তব্য কী? রাজোরিয়া বলেন, “ওই মামলায় এখনও উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি। তদন্ত শুরু হয়েছে। আইন অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কিন্তু ঘটনা হল, পুলিশের উপরে ওই হামলার পরে ৭২ ঘণ্টা কেটে গেলেও এখনও একজনকেও গ্রেফতার করেনি বোলপুর থানার পুলিশ। অথচ, শুক্রবার রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, এফআইআর যখন হয়েছে তখন ‘অ্যাকশন’ নেওয়া উচিত। কী সেই ‘অ্যাকশন’, শনিবার রাত পর্যন্ত অবশ্য তা জানতে পারেননি রাজ্যের মানুষ।
তবে প্রশাসনের একাংশ এত দিনে এটা জেনে গিয়েছেন, অভিযুক্ত যদি শাসক দলের নেতা বা কর্মী হন, তা হলে থানায় এফআইআর হওয়ার পরেও তাঁকে ধরতে নবান্নের সবুজ সঙ্কেতের অপেক্ষায় থাকতে হবে পুলিশকে। আর সেই নির্দেশ না মিললে অধরাই থেকে যাবেন অভিযুক্ত। লোকসভা ভোটের সময় সোনামুখীর বিধায়ক দীপালি সাহা কিংবা মীনাখাঁর বিধায়ক ঊষারানি মণ্ডলের বিরুদ্ধে কমিশনের নির্দেশে এফআইআর দায়ের হলেও পুলিশের নাগালের বাইরেই থেকে গিয়েছিলেন তাঁরা। পরে আদালত থেকে জামিন নেন ওই দুই তৃণমূল বিধায়ক। পুলিশের একাংশ বলছেন, বাহিনীর এখন এমনই অবস্থা যে, শাসক দলের সামান্য এক পঞ্চায়েত সদস্যকে ধরতেও উঁচুতলার নির্দেশ নিতে হচ্ছে! কিন্তু তা-ও যে খুব সহজে মিলছে, তা নয়। কারণ, নিচুতলাকে নির্দেশ দেওয়ার আগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে নীল-সাদা বাড়ির দিকে।
নবান্নের নথি বলছে, বর্তমান সরকারে এ পর্যন্ত দু’টি পুলিশ খুনের ঘটনা ঘটেছে এবং দু’টিতেই জড়িয়েছে শাসক দলের নেতাদের নাম। গত বছরের গোড়ায় গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে গোলমালের সময় দুষ্কৃতীর গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল কলকাতা পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরীর। সেই ঘটনায় বিহার থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল কলকাতা পুরসভার ১৫ নম্বর বোরোর তৃণমূল চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নাকে। তিনি এখন জামিনে মুক্ত আছেন। কিন্তু বোমার আঘাতে বীরভূমের দুবরাজপুর টাউন থানার ওসি অমিত চক্রবর্তীর মৃত্যুর পরেও অধরা থেকে গিয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা শেখ আলিম। দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ হওয়ার সুবাদে ওই ঘটনার পরেও আলিমকে এলাকায় ঘুরতে দেখেছিলেন স্থানীয়রা। কিন্তু দেড় মাস পরে যে দিন আহত অমিতবাবুর মৃত্যুর খবর পৌঁছয় দুবরাজপুরে, সে দিনই গা ঢাকা দেন ওই তৃণমূল নেতা। আজও তিনি বেপাত্তা। বেপাত্তা বোলপুর থানায় ঢুকে ডিউটি অফিসারকে মারধরের ঘটনায় অভিযুক্ত জেলা তৃণমূলের যুব সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষও। পুলিশ আছে পুলিশেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy