Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শব্দদৈত্য দমনে ভরসা নাগরিক কন্ট্রোল রুম

দু’টো ফোনে অভিযোগ ঢোকে। আর অন্য তিনটে ফোন থেকে কল করে সমস্যাসঙ্কুল এলাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হয় নির্দিষ্ট সময় অন্তর। সেটা করেন পাঁচ-ছ’জন। কন্ট্রোল রুমের সরঞ্জাম, লোকবল বলতে এ টুকুই। কোনও সরকারি সংস্থা নয়, নিছকই নাগরিক সমাজের কন্ট্রোল রুম।

চলছে নিষিদ্ধ শব্দবাজি তৈরি। মঙ্গলবার, দক্ষিণ শহরতলিতে ছবিটি তুলেছেন শশাঙ্ক মণ্ডল।

চলছে নিষিদ্ধ শব্দবাজি তৈরি। মঙ্গলবার, দক্ষিণ শহরতলিতে ছবিটি তুলেছেন শশাঙ্ক মণ্ডল।

সুরবেক বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৬ ০১:১৭
Share: Save:

দু’টো ফোনে অভিযোগ ঢোকে। আর অন্য তিনটে ফোন থেকে কল করে সমস্যাসঙ্কুল এলাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হয় নির্দিষ্ট সময় অন্তর। সেটা করেন পাঁচ-ছ’জন। কন্ট্রোল রুমের সরঞ্জাম, লোকবল বলতে এ টুকুই। কোনও সরকারি সংস্থা নয়, নিছকই নাগরিক সমাজের কন্ট্রোল রুম। দীপাবলিতে শব্দ দূষণ রুখতে যে কন্ট্রোল রুম কালীপুজো ও তার পর দিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এমনটা চলছে গত ছ’বছর ধরে।

পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ শব্দ দূষণ কমাতে যত ঢিলে দিয়েছে, ততই নাগরিক সমাজের কন্ট্রোল রুমের উপর ভরসা বাড়ছে মানুষের।

গত বছর দীপাবলির সন্ধ্যায় ওই কন্ট্রোল রুমে শব্দবাজি ও মাইক সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়েছিল ৬৪টি। পরের দিন ৭০টি। তবে পর্ষদ জানিয়েছিল, তাদের কন্ট্রোল রুমে দু’দিনে হাতে গোনা অভিযোগ জমা পড়েছে। পর্ষদের এক কর্তা দাবি করেছিলেন, ‘‘অভিযোগ কম আসা থেকেই তো প্রমাণিত যে এ বার পরিস্থিতি অনেক ভাল!’’

নাগরিক সমাজের এই কন্ট্রোল রুম চালাচ্ছে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’। শব্দদূষণ কোথায়, কতটা হচ্ছে, সেটা যাচাই করে দেখতে ও সেই মতো পুলিশ ও পর্ষদকে খবর দিতে উত্তর কলকাতা ও সল্টলেক এবং দক্ষিণ কলকাতায় সবুজ মঞ্চের দু’টি গাড়ি বেরোয়।

গত বছর দীপাবলির সন্ধ্যা। সবুজ মঞ্চের গাড়ি এম আর বাঙুর হাসপাতালে পৌঁছতেই ছুটে এলেন ডেপুটি সুপার। বললেন, ‘‘আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। নিজের কানেই শুনুন, সাইলেন্স জোন হাসপাতাল চত্বরের ভিতরে ও বাইরে কত শব্দবাজি ফাটছে।’’

পর্ষদ সূত্রে খবর, এক চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে বছর তিনেক আগে ওই কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁর কৌশলই ছিল, অভিযোগ কম আসা নিশ্চিত করা। যে কারণে শব্দ দানবের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ মানুষ পরিবেশ ভবনে ফোন করলে তাঁদের নাম, ঠিকানা এ সব জিজ্ঞেস করে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলা হত। কারণ, অধিকাংশ মানুষই ঝঞ্ঝাট এড়াতে পরিচয় গোপন রাখতে চান। পর্ষদের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘সাধারণ মানুষকে এই ভাবে বিড়ম্বনায় ফেললে তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই অভিযোগ জানাতে সঙ্কোচ করবেন। সেই জন্য অভিযোগ কম আসছে। অথচ দাবি করা হচ্ছে, দূষণ কম বলে অভিযোগও কম!’’

মজা হল, পর্ষদ ও ‘সবুজ মঞ্চ’, দু’টোরই কন্ট্রোল রুম কিন্তু সল্টলেকে। অবশ্য আলাদা জায়গায়।

অতীতে প্রতি বছর কালীপুজোর সন্ধ্যায় সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে শব্দদূষণের বিভিন্ন জায়গায় হানা দিতেন পর্ষদের তৎকালীন মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়। হাতেনাতে পাকড়াও করতেন শব্দবাজি ফাটানো লোকদের, সাইলেন্স জোন-এ মাইক বাজানো পুজো সংগঠকদের। ২০০৯-এ ফুলবাগানের শিশু হাসপাতালের চারপাশে যখন শব্দবাজি ফাটছে আর সেই শব্দে চিকিৎসাধীন সদ্যোজাতরা চমকে চমকে ওঠায় স্যালাইনের সূঁচ খুলে যাচ্ছে, বিশ্বজিৎবাবু তখন সেখানে পৌঁছে হইচই বাঁধিয়ে পুলিশ তলব করেন।

কালীপুজোয় গত চার বছর ধরে পর্ষদের কোনও আধিকারিক আর গাড়ি নিয়ে এই ভাবে নজরদারিতে বেরোন না। ফলে, সরকারি হাসপাতালের ডেপুটি সুপার ভরসা করেন ‘সবুজ মঞ্চ’-র কন্ট্রোল রুমের গাড়ির উপর। সংগঠনের পক্ষে পরিবেশকর্মী নব দত্তের বক্তব্য, ‘‘পর্ষদ ও পুলিশ শব্দদূষণের বিরুদ্ধে সক্রিয় হলে আমাদের কন্ট্রোল রুমে এত অভিযোগ আসতই না। সাধারণ নাগরিক সরকারি সংস্থার কাছে অভিযোগ জানাতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন না বলেই আমাদের উপর ভরসা করছেন।’’

এ বার অবশ্য দেরিতে হলেও শব্দকে জব্দ করতে পুলিশ কোমর বেঁধে নেমেছে বলে বাড়তি উৎসাহী নাগরিক সমাজ। নববাবু বলেন, ‘‘দেরি হয়েছে ঠিকই, তবে পুলিশ যুদ্ধকালীন তৎপরতায় নড়েচড়ে বসেছে।’’ কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) বিশাল গর্গ জানান, সোমবার ১৬০০ কেজি শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে দু’জন।

নাগরিক সমাজের কন্ট্রোল রুমের গাড়ি এ বার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, বৃদ্ধাশ্রম ও কয়েকটি এলাকার বহুতল আবাসন ও তার আশপাশের কথা মাথায় রেখে ঘুরবে। নাগরিক সমাজের পর্যবেক্ষণ: লালবাজার কন্ট্রোল রুমে ফোন করে শব্দদূষণের অভিযোগ জানালে যতটা সাড়া পাওয়া যায়, থানাগুলোর অধিকাংশের কাছে সেটা মেলে না। গত বছর তিলজলা থানার উল্টো দিকে লাগাতার শব্দবাজি ফাটছিল। ‘সবুজ মঞ্চ’-র প্রতিনিধিরা থানায় জানালে উত্তর পাওয়া যায়, ‘‘আচ্ছা দেখছি। ফোর্স এখন থানায় তেমন নেই। কী করব?’’

তবে এ বার লালবাজারের উদ্যোগ দেখে নাগরিক সমাজের মনে হচ্ছে, পুলিশের কাছ থেকে উপযুক্ত সাহায্য মিলবে। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকারও বলেন, ‘‘শুভ উদ্যোগে পুলিশের তরফে সব রকম সহযোগিতা থাকবে।’’

দীপাবলিতে শব্দদূষণের অভিযোগ জানাতে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কন্ট্রোল রুমের নম্বর: ২৩৩৫-৩৯১৩/২৩৩৫-৮২১২।
আর ‘সবুজ মঞ্চ’-র কন্ট্রোল রুমের নম্বর: ৯৮৩১৩-১৮২৬৫/৯৮৩১১-৭২০৬০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Firecrackers Illegal Firecrackers New Helpline
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE