কেন্দ্রীয় সরকার স্টেন্টের দাম প্রায় ৮৫ শতাংশ কমিয়ে দিলেও অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির খরচ কমবে তো? রোগীদের স্বার্থ নিয়ে যাঁরা আন্দোলন করেন তাঁদের অনেকেই আশঙ্কা, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর একাংশ নিজেদের লাভ অটুট রাখতে অন্য ফিকির খুঁজে নিতে পারে। কোনও কোনও হাসপাতাল হয়তো চিকিৎসার পদ্ধতিগত খরচের মাত্রা এতটাই বাড়িয়ে দেবে যে তাতে আখেরে রোগীদের আর্থিক সুরাহা তলানিতে ঠেকবে। বিষয়টি স্বাস্থ্য ভবনও নজরে রেখেছে।
চলতি সপ্তাহে ‘ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি’ (এনপিপিএ) স্টেন্টের দাম কমানোর কথা সরকারি ভাবে ঘোষণা করার পরেই বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে দফায়-দফায় বৈঠক চালাচ্ছে বলে স্বাস্থ্য ভবনে খবর এসেছে। কী ভাবে অন্যান্য খরচের মাত্রা বাড়িয়ে আগেকার লাভ বজায় রাখা যায়, তা নিয়ে হাসপাতালগুলির প্রস্তাবে চিকিৎসকদের একাংশ বেঁকে বসলে তাঁদের উপরে চাপও সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে হৃদরোগ চিকিৎসকদের একটি সংগঠন সূত্রের অভিযোগ। এনপিপিএ-র তরফেও আশঙ্কাটা উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু এনপিপিএ-র কর্তারা জানিয়েছেন, পদ্ধতিগত খরচ বা প্রসিডিওর চার্জের উপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ নেই। সেটা রাজ্য সরকারগুলিকে দেখতে হবে। এনপিপিএ-র অধিকর্তা ভূপেন্দ্র সিংহের কথায়, ‘‘স্বাস্থ্য বিষয়টি কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্যেরও আওতাভুক্ত। আমরা সব রাজ্য সরকারের কাছে লিখিত ভাবে জানিয়েছি যেন তারা প্রসিডিওর চার্জে রাশ টানার বিষয়টা দেখেন।’’
ঘটনা হল, এই মুহূর্তে রাজ্য সরকারের হাত-পা বাঁধা। কারণ, এ বিষয়ে পদক্ষেপ করার উপযুক্ত আইন এখনও চালু হয়নি। ‘ক্লিনিকাল এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট’ হয়েছে। কিন্তু পাঁচ বছরেও তার বিধি তৈরি করে উঠতে পারেনি স্বাস্থ্য দফতর। আইনটি যাঁরা প্রণয়ন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন স্বাস্থ্য দফতরের তৎকালীন টেকনিকাল অফিসার অনিরুদ্ধ মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘আইনের চতুর্থ অধ্যায়ে এমন ব্যবস্থার কথা রয়েছে যাতে হাসপাতাল প্রসিডিওর চার্জ বা অস্ত্রোপচারের প্যাকেজের জন্য অতিরিক্ত টাকা নিলে শাস্তি দেওয়া যায়। রাজ্যের হাতে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও এই রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তারা অসহায় অবস্থায় পড়েছেন। ঠিক সময়ে বিধি তৈরি করে আইন প্রয়োগ হলে এটা হতো না।’’ যদিও রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর আশ্বাস, বিধি তৈরির কাজ চলছে। এপ্রিলের মধ্যে নতুন আইনের প্রয়োগ শুরু হয়ে যাবে, পদ্ধতিগত খরচ বাড়িয়ে তখন আর রোগীর পকেট কাটা যাবে না।
আরও পড়ুন: ঘর জ্বলছে, হঠাৎ সবার খেয়াল হল ঋষি নেই
পদ্ধতিগত খরচগুলি কী কী? বেড ভাড়া, ওটি চার্জ, কার্ডিওলজিস্টের ফি, অ্যানেস্থেশিওলজিস্টের ফি, ওষুধ-ইঞ্জেকশন ইত্যাদি। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, অস্ত্রোপচারের আগে দামি পরীক্ষানিরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া, রোগীর হাসপাতাল বাসের মেয়াদ বাড়িয়েও খরচ বাড়ানোর কথা ভাবছে কোনও কোনও হাসপাতাল। একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্ণধার তো কবুলই করলেন, ‘‘শুধু কি এই? সারা দিনে ব্লাডসুগার মাপার সংখ্যা বাড়িয়ে, পালস অক্সিমিটারের খরচ বাড়িয়ে, গ্লাভসের ব্যবহার বাড়িয়ে কত বিল বাড়ানো যায়, সে সম্পর্কে মানুষের ধারণা কতটুকু?’’ আগে একই বেলুনে অন্তত ১০ জন রোগীর অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হতো। এখনও তা-ই হবে। ‘‘কিন্তু প্রত্যেক রোগীর জন্য আলাদা বেলুনের দাম নেওয়া হবে। একেকটি বেলুনের দামই ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা।’’
এখানেই শঙ্কিত চিকিৎসক মহল। বাইপাসের এক হাসপাতালের এক প্রবীণ চিকিৎসক বলেন, ‘‘স্টেন্টের ক্ষেত্রে মূল মুনাফাটা করে হাসপাতাল। কিন্তু রোগীদের রাগ-অবিশ্বাসটা গিয়ে পড়ে আমাদের ওপরে। এ বার সেটা আরও বাড়বে।’’
তা হলে কি রোগীদের এই ভোগান্তি কমার কোনও সম্ভাবনাই নেই? স্বাস্থ্যের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত প্রবীণ চিকিৎসক পীযূষকান্তি সরকারের কথায়, ‘‘দীর্ঘ আন্দোলনের ফলেই তো স্টেন্টের দাম কমল। ফের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে পদ্ধতিগত চার্জও হয়তো কমবে। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।’’
কোন স্টেন্ট কী ছিল কী হল
• বেয়ার মেটাল ৩৫-৪৫ হাজার ৭২৬০
• ড্রাগ ইলিউটিং ৮০ হাজার-দেড় লক্ষ ২৯,৬০০
• বায়ো ডিগ্রেডেবল ১.৫ থেকে ১.৭৫ লক্ষ ২৯,৬০০
• স্টেন্টের দাম কমায় হাসপাতালগুলির এত মাথা ব্যথা কেন? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত দিন স্টেন্ট বিক্রির ক্ষেত্রে দামের কোনও ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া ছিল না। ফলে কার্যত যথেচ্ছাচার চালাত কোনও কোনও হাসপাতাল। তারা এক সঙ্গে অনেকগুলি স্টেন্ট যথেষ্ট কম দামে কিনত। তার পর তা রোগীদের অনেক গুণ বেশি দামে বিক্রি করত। কখনও কখনও সেই লাভের পরিমাণ ৬৫০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছত। নতুন নিয়মে কোনও ভাবেই স্টেন্টের জন্য ৩০ হাজার টাকার বেশি দাম নেওয়া যাবে না। তাই হাসপাতালগুলি ফাঁপরে পড়েছে। লাভের অঙ্কটা আর আগের মতো থাকবে না যে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy