Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আইনি প্রক্রিয়ায় গলদ সবারই, বলল আদালত

তাপস-মামলায় বাদী এবং বিবাদী দু’পক্ষই আইন প্রক্রিয়া সঠিক ভাবে অনুসরণ করেননি বলে মন্তব্য করল কলকাতা হাইকোর্ট। বৃহস্পতিবারের শুনানিতে বিচারপতি গিরীশচন্দ্র গুপ্ত এবং তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, নদিয়ার জনসভায় উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে সাংসদ তাপস পাল আদালতগ্রাহ্য অপরাধ করেছেন কি না, সেটা পুলিশের তদন্ত করে দেখা উচিত ছিল।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৪ ০৩:২৩
Share: Save:

তাপস-মামলায় বাদী এবং বিবাদী দু’পক্ষই আইন প্রক্রিয়া সঠিক ভাবে অনুসরণ করেননি বলে মন্তব্য করল কলকাতা হাইকোর্ট।

বৃহস্পতিবারের শুনানিতে বিচারপতি গিরীশচন্দ্র গুপ্ত এবং তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, নদিয়ার জনসভায় উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে সাংসদ তাপস পাল আদালতগ্রাহ্য অপরাধ করেছেন কি না, সেটা পুলিশের তদন্ত করে দেখা উচিত ছিল। পুলিশ তা করেনি। অন্য দিকে আদালতের পর্যবেক্ষণ, অভিযোগকারীরা পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে না গিয়ে হাইকোর্টে চলে এসেছেন। নিম্ন আদালতে বিচার না পেলে তবেই উচ্চ আদালতে আসার কথা।

আইনি পদ্ধতির প্রশ্নে এই একই মামলায় সিঙ্গল বেঞ্চে বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের বক্তব্যেরও সমালোচনা করেছে ডিভিশন বেঞ্চ। বিচারপতি গুপ্ত এ দিন বলেছেন, “সিঙ্গল বেঞ্চ আইনি পদ্ধতিকে এড়িয়ে যেতে পারে না।...আইনি পদ্ধতি উল্টো দিক থেকে শুরু হতে পারে না।”

সোমবার বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত নির্দেশ দিয়েছিলেন, উস্কানিমূলক বক্তব্য (হেট স্পিচ) রাখার দায়ে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাপস পালের বিরুদ্ধে পুলিশকে এফআইআর দায়ের করতে হবে। তদন্তের ভার দিতে হবে সিআইডি-কে। ওই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে বুধবারই ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করে রাজ্য সরকার। তাপস নিজেও পৃথক আপিল মামলা করেন। দু’টি মামলাই একত্রে শুনছে ডিভিশন বেঞ্চ। তাপসের বিরুদ্ধে এফআইআর-এর নির্দেশ স্থগিত রেখে তাপসের বিতর্কিত বক্তৃতা আদৌ আদালতগ্রাহ্য অপরাধের (কগনিজব্ল অফেন্স) পর্যায়ে পড়ে কি না, সে নিয়ে দু’তরফের বক্তব্য শুনেছিলেন বিচারপতিরা। বিচারপতি গুপ্তর বক্তব্য ছিল, “আদালতগ্রাহ্য অপরাধ না-হলে পুলিশ এফআইআর দায়ের করবে না।” তাপস যা যা বলেছেন, তা আদালতগ্রাহ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে কি না, সেই মর্মে শুনানি এগিয়েছে। আজ, শুক্রবারও শুনানি চলবে।

এর আগে তৃণমূল সাংসদের বক্তৃতার সিডি ভরা এজলাসে দেখেছিলেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। এ দিন বিচারপতি গিরীশচন্দ্র গুপ্ত এবং বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চও সেই সিডি ল্যাপটপে দেখেন। তার পরে বিচারপতি গুপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মনজিৎ সিংহকে বলেন, “তাপস পালের বক্তব্য আদালতগ্রাহ্য অপরাধ কি না জানার জন্য পুলিশকে মামলা দায়ের করে তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া যেত। সরকার তা দেয়নি।”

তবে এ দিনই প্রথম রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আদালতে জানানো হয়, গত ২ জুলাই নাকাশিপাড়া থানার পুলিশ একটি জেনারেল ডায়েরি করে তদন্ত শুরু করেছে। ডিভিশন বেঞ্চে রাজ্য সরকারের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ওই কথা জানান। কিন্তু এর আগে বিচারপতি দত্ত একাধিকবার জিপি (গভর্নমেন্ট প্লিডার) অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পিপি মনজিৎ সিংহের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ওই বিষয়ে সরকারের নির্দেশ কী? জিপি এবং পিপি তখন তদন্তের কথা জানাননি। তাঁরা আগাগোড়া দাবি করছিলেন, তাপস পালের বক্তৃতা আদালতগ্রাহ্য অপরাধ নয়।

তৃণমূল সাংসদ তাপস পালের উস্কানিমূলক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে নাকাশিপাড়া থানায় আগেই অভিযোগ জানিয়েছিলেন উত্তর দমদম পুরসভা এলাকার বাসিন্দা, জনৈক বিপ্লব চৌধুরী। পুলিশ তা সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেয়নি— এই অভিযোগ নিয়েই তার পরে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন বিপ্লববাবু। সেই নিরিখেই বিচারপতি দত্ত গত সোমবার নির্দেশ দিয়েছিলেন, নাকাশিপাড়া থানার আইসি-কে (ইনস্পেক্টর ইন চার্জ) ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাপস পালের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে হবে।

পুলিশ কেন সাংসদের বিরুদ্ধে এত দিন এফআইআর দায়ের করেনি, সেই প্রশ্ন এ দিনও তোলেন আবেদনকারীর আইনজীবী অনিরুদ্ধবাবু। বিচারপতি গুপ্ত বলেন, “আদালতগ্রাহ্য অপরাধ কি না, তা পুলিশ ঠিক করবে। পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি মনে হলে আপনার উচিত ছিল, সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে বিষয়টি জানানো। তাঁর কাছে ‘কমপ্লেন কেস’ করা যেত। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে পুনরায় তদন্ত করতে বলতে পারতেন। নিম্ন আদালতে বিচার না পেলে তখন হাইকোর্টের দরজা খোলা ছিল। তড়িঘড়ি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হওয়া উচিত হয়নি।”

একই সঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন মন্তব্য করেছে, এই মামলায় বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের সিঙ্গল বেঞ্চ যে সব পর্যবেক্ষণ করেছেন, সেই পর্যবেক্ষণ না করলেই ভাল ছিল। ওই পর্যবেক্ষণের ফলে সমাজে ভুল বার্তা গিয়েছে। বিচারপতি দত্তের পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিচারপতি গুপ্তের মন্তব্য, “মশা মারতে কামান দাগা হয়েছে!”

অনিরুদ্ধবাবু আদালতে জানান, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে প্রথমে মামলাকারী হাইকোর্টের দ্বারস্থ হলে জিপি বলেছিলেন, পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয়নি। তাই মামলা গ্রহণ করা যাবে না। যখন মামলা গৃহীত হল, তখন জিপি বললেন, আদালতগ্রাহ্য অপরাধই হয়নি। অনিরুদ্ধবাবু বলেন, “বিচারপতি দত্ত জিপি-র ওই বক্তব্যকে ‘ইউ টার্ন’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।” তা শুনে বিচারপতি গুপ্ত বলেন, “সে ক্ষেত্রে রাজ্যকে তিরস্কার করতে হবে।” তাঁর মতে, “সিঙ্গল বেঞ্চ নির্দেশ দিতে গিয়ে যে সব পর্যবেক্ষণ করেছে, তা সঠিক পর্যবেক্ষণ হতেও পারে। কিন্তু সেই মন্তব্য সযত্নে এড়ানো যেত।”

বিচারপতি দত্ত যে আইনি নির্দেশ দিয়েছেন, তা নিয়েও ডিভিশন বেঞ্চ আপত্তি তুলেছে। বিচারপতি গুপ্ত এ দিন বলেন, “কোনও অপরাধ ঘটে থাকলে, পুলিশ তার তদন্ত করে ঠিক করবে কোন ধারা প্রয়োগ হবে। সিঙ্গল বেঞ্চ যে ভাবে আগে থেকে আইনি ধারা প্রয়োগের কথা বলেছে, তা করা যায় না।”

বিচারপতি গুপ্ত আরও বলেন, “আদালত মামলা রুজু করে না। তা পুলিশের কাজ। তদন্তের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করাও আদালতের কাজ নয়। কারণ, অপরাধ হলে তার যে সব তথ্যপ্রমাণ-সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে হয়, তা আদালত করতে পারে না।”

তবে এ দিন এজলাসে তাপস পালের বক্তব্যের সিডিটি ল্যাপটপে দেখার পরে বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী রাজ সরকারের আইনজীবী কল্যাণবাবুকে বলেন, “আপনিও এক জন সাংসদ। আপনিই বলুন না, কোনও সাংসদ প্রকাশ্য সভায় এমন বক্তব্য পেশ করতে পারেন? এই প্রশ্ন ব্যক্তিগত ভাবে আপনাকে করছি।”

কল্যাণবাবু বলেন, “ওই প্রসঙ্গে ফেসবুকে লিখেছিলাম, সভ্য সমাজ মহিলাদের সম্মান করে। যারা তা করে না, তারা পশু। তবে আমি এক জন আইনজীবী হিসেবে আদালতে সওয়াল করতে এসেছি। সাংসদ হিসেবে নয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE