পিন্টুকুমার পুরকাইত। —নিজস্ব চিত্র।
বয়স বছর চৌত্রিশ। শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক পাশ। কিন্তু পশ্চিম জটার কাঁসারিপাড়ার পিন্টুকুমার পুরকাইতের আরও একটা পরিচয়, এলাকার চাষিদের কাছে তিনি জৈবচাষের মাস্টারমশাই।
কৃষি দফতরের কর্তারাই বলছেন, ৪০টি গ্রুপ তৈরি করে প্রায় এক হাজার চাষিকে জৈব চাষে সামিল করেছেন পিন্টু। ভূমিহীন কৃষককেও উৎসাহিত করেছেন বাড়ির গায়ে বস্তা, ঝুড়িতে চাষ করার। পিন্টু যে দু’টি পঞ্চায়েতের চাষিদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন, সেই কঙ্কনদিঘি এবং নগেন্দ্রপুরের ৫৩০০ হেক্টর জমির মধ্যে জৈব চাষ হয় ১৭০০ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ প্রায় এক তৃতীয়াংশ জমিতে। এই অনুপাত অন্য পঞ্চায়েতের তুলনায় বেশি। জৈব পদ্ধতিতে ধান, সব্জি, ডাল ও ফল চাষে তাঁর এলাকা পিছনে ফেলে দিয়েছে আশেপাশের ব্লকগুলোকে।
পিন্টুবাবুর কাজ সম্পূর্ণ নিজের উৎসাহে। তাই এ বছর রাজ্য সরকার তাঁকে দিয়েছে ব্লক কৃষিরত্ন পুরস্কার। পুরস্কারের ১০ হাজার টাকার বেশ খানিকটা দিয়ে কৃষির বই কিনেছেন তিনি। পুরো টাকাটাই চাষের উন্নতির কাজে খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মণ্ডলপাড়ার সুনীল মাইতি, গিরিপাড়ার মৃত্যুঞ্জয় প্রধানরা তাঁদের জমির বেশির ভাগটাতেই জৈব চাষ করেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা, “এ চাষে উৎপাদন যেমন বেশি হচ্ছে তেমনই চাষের খরচ কমায় লাভও বেশি। এক এক করে অনেক চাষিই আসছেন।” ২০০৯ সালে আয়লা ঝড়ের পর জমিতে নুন বেশি হয়ে যাওয়ায় চাষ বরবাদ হয়ে গিয়েছিল। ‘মুক্তি’ নামে এক সংস্থার সহায়তায় জৈব সার ব্যবহারে জমির হাল ফেরানোর কাজে সামিল হয়েছেন পিন্টুবাবু।
জৈব চাষে চাষিদের প্রশিক্ষিত করার যে কাজটা পিন্টুবাবু করছেন, তা যে কৃষি প্রযুক্তি সহায়কদের করার কথা, তা স্বীকার করে কৃষি দফতরও। কিন্তু কেপিএস সংখ্যায় খুবই নগণ্য। মথুরাপুর ২ ব্লকের সহ কৃষি অধিকর্তা মলয় রায় বলেন, “১১ পঞ্চায়েতের এই ব্লকে কেপিএস থাকার কথা ২৭ জন। আছেন ৩ জন। বাধ্য হয়ে ভরসা করতে হয় পিন্টুর মতো মানুষদের উপরে।’’ তাঁর দাবি, ব্লকের মোট ১৯ হাজার হেক্টর কৃষি জমির মধ্যে এখন জৈব প্রযুক্তিতে চাষ হয় তিন হাজার আটশো হেক্টর জমিতে। বছর পাঁচেক আগে যার পরিমাণ ছিল ৭৫০ হেক্টর।
পিন্টুকুমার পুরকায়েত এই প্রসঙ্গে বলেন, “২০০৯ সালে কৃষকের মেঠো পাঠশালায় কৃষি দফতর কয়েক জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। প্রশিক্ষিত অধিকাংশ চাষি একে গুরুত্ব না দিলেও আমি প্রতি সপ্তাহে স্থানীয় ক্লাবঘরে চাষিদের নিয়ে বসতাম। নিজের সাফল্য ওঁদের দেখিয়ে তবেই আস্থা অর্জন করেছি।” এখন মাসে এক-দু’বার প্রশিক্ষণ ও প্রতিদিন মাঠে মাঠে চাষিদের কাছে পৌঁছে সমস্যার সমাধান করা তাঁর দায়িত্ব হয়ে গিয়েছে। তিনি চাষিদের বোঝান, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মাটি, ফসল, জল ও কৃষকের নিজের কীভাবে ক্ষতি করে।
জৈব সার ও কীটনাশক বাজারে সহজলভ্য নয়। এগুলি বাজার থেকে কিনে আনতে চাষিরা উৎসাহ হারান। তাই বাড়ির জিনিসেই বাড়িতে তা উৎপাদনের পদ্ধতি ও প্রয়োগ শেখান পিন্টুবাবু। তাতে চাষে খরচও কমে। নিজে ধান, সব্জি, ফল, ডালশস্য, তৈলবীজ, মাছ, হাঁস, মুরগি চাষ করেন সারা বছর। তাঁর স্ত্রী শকুন্তলাও গ্রুপে সামিল হয়ে ৫ বছর ধরে জৈব চাষ করছেন ব্যবসায়িক ভাবে। দম্পতির স্বপ্ন, এক দিন না এক দিন এলাকায় রাসায়নিক বিষমুক্ত জৈব চাষ হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy