জল-যান। রবিবার মধ্য কলকাতায়।— নিজস্ব চিত্র।
আবির্ভাবের সূচনা পর্বেই এক ঘূর্ণিঝড় তাকে প্রায় থাবড়ে বসিয়ে দিয়েছিল। এ বার প্রথম থেকে ঝিমিয়ে থাকা সেই বর্ষাকে হেঁচকা টানে চনমনে করে দিল এক নিম্নচাপ। তারই দৌলতে রবিবার মরসুমের প্রথম সত্যিকার বাদলদিন উপহার পেল কলকাতা, দক্ষিণবঙ্গ।
দফায় দফায় বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় এ দিন ভোর থেকেই। ঘন মেঘে আকাশ ঢাকা থাকায় তাপমাত্রাও তেমন বাড়তে পারেনি। ফলে এত দিন যে-নাকাল করা গরম সইতে হয়েছে, রেহাই মিলেছে তার থেকেও। আলিপুর হাওয়া অফিস জানিয়েছে, এ দিন বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত কলকাতায় ৩৬.৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা (২৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) নেমে গিয়েছে স্বাভাবিকের থেকে চার ডিগ্রি নীচে।
দিনভর বৃষ্টির অবধারিত উপসর্গ হিসেবে জল জমার সমস্যা ভোগায় মহানগরীকে। এ দিন অবশ্য তেমন ভোগান্তির খবর মেলেনি। মহাত্মা গাঁধী রোড, যদুবাবুর বাজার, উল্টোডাঙা আন্ডারপাসে অল্প জল জমলেও তার বিশেষ প্রভাব পড়েনি মহানগরে। পুলিশি সূত্রের খবর, ছুটির দিন বলে রাস্তায় গাড়ি কম ছিল। ফলে কিছু কিছু জায়গায় জল জমলেও সমস্যা হয়নি। বর্ষার স্নিগ্ধতা প্রসন্ন রেখেছিল পুরো দিনটাকেই।
অথচ হাওয়া অফিসের খাতায়-কলমে দিন পনেরো আগে হাজির হওয়া সত্ত্বেও মৌসুমি বায়ুর দাপট আদৌ মালুম হচ্ছিল না। মুষ্টিভিক্ষার মতো এখানে-ওখানে দু’চার ফোঁটা বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি ঝরলেও বর্ষার উদার ঐশ্বর্যের দেখা মিলছিল না রাঢ়বাংলায়। উল্টে ভরা আষাঢ়েও মানুষকে নাকাল করছিল প্যাচপেচে গরম। হঠাৎই বদলে গেল পরিস্থিতি। ছুটির দিনে ভোরে উঠেই কলকাতা টের পেল, এটা আসলে বর্ষাকাল। টের পেল গোটা দক্ষিণবঙ্গই।
আবহবিদেরা এর যাবতীয় কৃতিত্ব দিচ্ছেন বঙ্গোপসাগর থেকে আসা একটি নিম্নচাপকে। তাঁদের আশ্বাস, কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আজ, সোমবারেও বৃষ্টি চলবে। কোনও কোনও এলাকায় ভারী
বৃষ্টির পূর্বাভাসও আছে। ঝিমিয়ে থাকা বর্ষা এই নিম্নচাপের হাত ধরেই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠবে বলে আবহাওয়া দফতরের আশা।
উপগ্রহ-চিত্র বিশ্লেষণ করে হাওয়া অফিসের বিজ্ঞানীরা জানান, আলস্য ভাঙিয়ে বর্ষাকে যে সক্রিয় করে তুলেছে, সেই নিম্নচাপটি এ দিন দুপুরে ছিল গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং লাগোয়া ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডের উপরে। তার টানেই সাগর থেকে ক্রমাগত জলীয় বাষ্প ঢুকছে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে। এবং সেই জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে তৈরি করছে মেঘ। দফায় দফায় নামছে বৃষ্টি। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (পূর্বাঞ্চল) গোকুলচন্দ্র দেবনাথের আশ্বাস, বর্ষার এই প্রসন্নতা হুট করে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আপাতত নেই। কারণ, বিদায় নেওয়ার ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে না নিম্নচাপটির মধ্যে। সে এগোচ্ছে খুব ধীর গতিতে। তাই খুব তাড়াতাড়ি তার দুর্বল হয়ে পড়ার ভয় নেই। আর নিম্নচাপের ক্ষমতা যত দিন অটুট থাকবে, বৃষ্টি চলতেই থাকবে কমবেশি। হারিয়ে যাবে না বর্ষা।
হারিয়ে ফেলার ভয় এ বার বাড়িয়ে দিয়েছে বর্ষার দেরি করে আসাটাই। ৮ জুনের বদলে সে দক্ষিণবঙ্গে পৌঁছয় ১৭ জুন। সেই দেরি পুষিয়ে দেওয়ার তৎপরতাটাও দেখা যায়নি তার মধ্যে। ধারাবর্ষণের অভাবে ভরা আষাঢ়েও চড়া রোদের গরম সইতে হয়েছে আমবাঙালিকে। তরতরিয়ে বেড়েছে বৃষ্টির ঘাটতিও। মৌসম ভবনের হিসেব বলছে, জুনে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বর্ষার ঘাটতি ছিল ২৮ শতাংশ। এই পরিস্থিতিতে অন্ধ্র উপকূলের কাছে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া নিম্নচাপের আশায় ছিলেন আবহবিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলেছিলেন, নিম্নচাপটি এ রাজ্যের দিকে সরে এলে জোরালো বৃষ্টি মিলতে পারে।
কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিভাগের সদর দফতর মৌসম ভবনের এক আবহবিদ জানাচ্ছেন, ঘূর্ণাবর্ত বা নিম্নচাপের সময়জ্ঞানের উপরেই বর্ষার মেজাজমর্জি নির্ভর করে। বর্ষার সময় বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ বা ঘূর্ণাবর্ত দানা বাঁধলে তা বর্ষণকে জোরদার করে। এ দিন সেটাই হয়েছে। কিন্তু বর্ষা আসার ঠিক আগে কোনও শক্তিশালী নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় দানা বাঁধলে তাতে বেজায় মার খায় বৃষ্টি। কারণ, বর্ষা সমাগমের পটভূমি হিসেবে আরবসাগর ও বঙ্গোপসাগরের পরিস্থিতির মধ্যে যে-ভারসাম্যের দরকার হয়, ওই সময়ের নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ে সেটা টাল খায়। আবার সেই ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপ কেটে গেলেও তার প্রভাবে বেশ কিছু দিন নতুন করে নিম্নচাপ বা ঘূর্ণাবর্ত দানা বাঁধতে পারে না। প্রকৃতির সেই প্রবণতাও এ বার হাড়ে হাড়ে মালুম হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ-সহ সারা দেশের। ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ মৌসুমি বায়ুর পথে শুধু কাঁটাই ছড়ায়নি। তার ধাক্কায় বর্ষা দেরি করে এসেও ঘাটতি মেটানোর জন্য তেমন সক্রিয় হতে পারছিল না।
এপ্রিলে মৌসম ভবন বলেছিল, গোটা দেশে এ বার স্বাভাবিকের থেকে বেশি বর্ষণ হবে। কিন্তু জুনের শেষে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ-সহ পূর্ব ভারতে বর্ষা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ে। আবহবিজ্ঞানীদের অনেকেই বলছেন, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে শুধু বর্ষার আগমন বিগড়ে যায়নি, পূর্ব ভারতে বর্ষার ছন্দও গিয়েছে কেটে।
ছন্দ কী ভীষণ ভাবে কেটেছে, জুনের বর্ষণ-ঘাটতি সেটা মর্মে মর্মে বুঝিয়ে ছেড়েছে বাংলার চাষিদের। মধ্য-আষাঢ়েও আকাশ সদয় না-হওয়ায় অশনি-সঙ্কেত দেখছিলেন তাঁরা। বলছিলেন, এমন বৃষ্টি-ঘাটতি চলতে থাকলে জুলাইয়ে বীজতলা তৈরি করতে সমস্যা হবে। সমস্যা হবে অন্যান্য শাকসব্জির চাষেও।
নিম্নচাপ তাঁদের আশঙ্কা অনেকটা কাটাতে পারবে বলেই মনে করছে হাওয়া অফিস। গোকুলবাবু বলছেন, বর্ষা সক্রিয় হওয়ায় এখন নিয়মিত বৃষ্টি হবে। ফলে ধানের বীজতলা তৈরিতে যে-সমস্যা হচ্ছিল, তা কেটে যাবে অচিরেই। এই নিম্নচাপের প্রভাবে ভারী বৃষ্টি হবে ঝাড়খণ্ড-সহ দামোদর উপত্যকায়। বিভিন্ন জলাধারে যে-জলসঙ্কট চলছিল, তা কমবে। ‘‘এটাও সেচ ও চাষের পক্ষে ভাল খবর,’’ বলছেন গোকুলবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy