আগামী অক্টোবরেই ৯৮ বছরে পা দিতেন তিনি। বার্ধক্যজনিত হরেক অসুস্থতায় বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতেই ঘরবন্দি হয়ে কাটছিল শেষ কয়েক বছর। সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে চার দিন বেলভিউ নার্সিং হোমে থাকার পর মঙ্গলবার মারা গেলেন সত্যজিৎ-পত্নী বিজয়া রায়।
কী ভাবে থাকবেন বিজয়া রায়? শুধুই সত্যজিৎ-পত্নী হিসেবে? প্রতিভাবান স্বামীর প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’র জন্য যিনি গায়ের গয়না দিতেও কুণ্ঠিত হননি? সম্ভবত, বিজয়া রায়ই স্বাধীনতার পরে প্রথম বাঙালি কন্যা যিনি ১৯৪৯ সালে কাজিন প্রেমিককে বিয়ে করছেন, দু’ জনকেই এই কৌতূহলী বাঙালি সমাজে সেই ঘটনা চেপে রাখতে হচ্ছে। ‘রিভার’ ছবির সময়েও জঁ রেনোয়া সত্যজিৎ রায়কে তাঁর ছবি উপহার দিয়ে লিখছেন, ‘মানিক রায়কে, যাকে বিবাহিত দেখলে খুশি হব।’ সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিকূলতার চাপে মানিক রায় ও তাঁর স্ত্রীকে যে কী ভাবে প্রথম কয়েক মাস নিজেদের রেজিস্ট্রির কথা চেপে রাখতে হয়েছিল, রেনোয়া জানতেন না। বিয়ের পর শাশুড়ি সুপ্রভা রায়কে বিজয়া জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এ বার থেকে তোমাকে কী বলব?’ শাশুড়ি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এতদিন মাসিমা বলতে, এ বার শুধু মা বোলো।’
বিজয়া রায় আজ অবধি সুকুমার ও সুপ্রভা রায়ের পুত্রবধূ, সত্যজিৎ রায়ের পত্নী, সন্দীপ রায়ের মা। বাঙালি সমাজে এগুলিই তাঁর পরিচিতি। বিজয়াও তা মেনে নিয়েছিলেন। নইলে আত্মজীবনীর নাম ‘আমাদের কথা’ রাখবেন কেন? তাঁর ‘আত্ম’ সবসময় অপরের আলোয় উদ্ভাসিত, একক ‘আমি’র বদলে স্বামী-পুত্র-পরিবার নিয়ে ‘আমাদের’ বহুবচনই সেখানে প্রধান।
অথচ সত্যজিতের বেশির ভাগ ছবির লোকেশন দেখা থেকে কস্টিউম ডিজাইনিং তাঁর হাত ধরে। বালক অপুকে খুঁজে বের করা কিংবা প্রথম স্ক্রিন টেস্টের জন্য ‘অপর্ণা’ শর্মিলা ঠাকুরকে সাজিয়ে দেওয়া সবই তাঁর সৌজন্যে। সত্যজিতের ঘরে ফিল্ম বা সন্দেশ পত্রিকার আড্ডা কি সম্ভব হত বিজয়া রায়ের প্রচ্ছন্ন গৃহিণীপনা ছাড়া?
এহেন বিজয়া একদা নিজগুণেই খ্যাত ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত, জ্যাঠামশাই অতুলপ্রসাদ সেন থেকে হিমাংশু দত্তের গান রেকর্ড করেছেন। এবং আত্মজীবনীতে লিখছেন, ‘একটা গানও আমার কাছে নেই, ইচ্ছা করেই রাখিনি। গান গেয়ে এবং শুনে এত খারাপ লেগেছিল যে রাখবার কোনও তাগিদ অনুভব করিনি।’ পিসিমা সাহানা দেবীর কাছে ছোট থেকে গান শিখেও এই অনুভব? নিজেকে লুকিয়ে রাখার সাধনা ছিল তাঁর জানা। পটনার ব্যারিস্টার চারুচন্দ্র দাশ ও মাধুরী দেবীর কন্যা বিজয়া দাশ। বাবার অকালমৃত্যুর পরে কলকাতায় কাকা প্রশান্ত দাসের বাড়ি। এখানেই সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। সিনেমা, রেডিওয় পাশ্চাত্য সঙ্গীত এবং আরও অনেক কিছু দু’ জনকে এক হাইফেনে জুড়েছিল। তখন সত্যজিৎ ডিজে কিমারে চাকরি করেন, বিজয়া কমলা গার্লস ও বেথুন স্কুলে পড়ান। ১৯৪৪ সালে ‘শেষরক্ষা’ ছবিতে নায়িকার ভূমিকায়, অতঃপর মুম্বইয়ে ‘রজনী’, ‘মশাল’ ইত্যাদি ছবিতে অভিনয়। বিএ পাশ, চাকরি, সিনেমায় নামা, গান গাওয়া এবং মুম্বই পাড়ি। বিজয়া রায়ের ইতিহাস স্বাধীনতার আগেও মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে মেয়েদের পরিসর তৈরির ইতিহাস। স্ত্রী-র কর্তব্য হিসেবে সংস্কৃত ভাষার মহাকবি সেখানে লেখেন, ‘গৃহিণী সচিবঃ সখী প্রিয়শিষ্যা ললিতকলাবিধৌ।’ বিজয়া ৯৮ বছর ধরে এই দুই আলোর নীচে অনায়াস হেঁটে গিয়েছেন, সংশয় ছিল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy