এখানেই ছিল সেই শপিং মল। ছবি: দিলীপ মণ্ডল।
দেশ জুড়ে তাদের প্রায় আড়াইশো আউটলেট। ছত্রিশ হাজারেরও বেশি কর্মী। এগারো হাজার কোটি টাকার উপরে ব্যবসা।
ভারতে খুচরো বিপণনের অন্যতম পথিকৃৎ নামজাদা সংস্থার ব্যবসা শুরু হয়েছিল মফস্সল শহর ডায়মন্ড হারবারেও। কিন্তু তাপস মল্লিকের দাপটে লাটে ওঠে সে সব। গত তিন বছর ধরে এক সময়ের ঝাঁ চকচকে সেই শপিং মল ফাঁকা পড়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রে। আর স্বমহিমায় লীলাখেলা দেখিয়ে চলেছে তাপস। যার সর্বশেষ সংযোজন, দলবল জুটিয়ে মোষ চুরির অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে খুন আইটিআই পড়ুয়া কৌশিক পুরকাইতকে।
২০১০ সালে ডায়মন্ড হারবার স্টেশন রোডে তৈরি হয়েছিল শপিং মলটি। কলকাতা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে প্রথম বারের জন্য আধুনিক পরিবেশে কেনাকাটার সুযোগ খুঁজে পেয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন শহরবাসী। মাসখানেকের মধ্যে
ব্যবসা জমেও গিয়েছিল। স্থানীয় শ’দেড়েক তরুণ-তরুণীর চাকরি হয়েছিল। ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছিল কর্মসংস্থান। আরও কিছু মল খুলে ব্যবসা বাড়ানোর কথা ভেবেছিলেন কর্তৃপক্ষ।
এই বাড়বাড়ন্ত নজর এড়ায়নি তাপসের। রাজনৈতিক তকমা থাকায় কর্তৃপক্ষও শুরুর দিকে তাকে কিছুটা গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু এমন সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোবে তাপস— তা জানা ছিল না তখনও। ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতা বদলের পরে তৃণমূল নেতা তাপসের তখন বাড়বাড়ন্ত। মলের কর্মীদের নিয়ে ইউনিয়ন গড়ে শুরু হয় নানা হুজ্জুত, তোলাবাজি, হাঙ্গামা। যার জেরে ২০১৩ সালে মল বন্ধই করে দিতে বাধ্য হন কর্তৃপক্ষ। আখেরে কাজ হারান বেশ কিছু স্থানীয় যুবক-যুবতী।
মলের এক প্রাক্তন আধিকারিকের কথায়, ‘‘তাপসবাবু মালিকপক্ষকে বুঝিয়েছিলেন, শ্রমিক অসন্তাষ থেকে ব্যবসা বাঁচানোর দায়িত্ব তিনিই নেবেন। কিন্তু সে জন্য ইউনিয়ন গড়া দরকার।’’ সেই প্রস্তাবে প্রথমটায় নিমরাজি হয়েও পরে সায় দেন কর্তৃপক্ষ। কর্মচারী সংগঠন তৈরি করে সভাপতি হয়ে বসে তাপসই। পরে তার নব নব রূপ দেখে যখন সম্বিৎ ফেরে কর্তৃপক্ষের, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। শপিং মলে গেড়ে বসেছে তাপস আর তার দলবল।
শুরুর দিকে শ্রমিক অসন্তোষ আদৌ ছিল না বলে জানাচ্ছেন এক আধিকারিক। কিন্তু তাপসের থেকে ইন্ধন পেয়ে ক্রমে ক্রমে কর্মীদের নানা বায়নাক্কা শুরু হয়। বেতন বৃদ্ধির দাবিতে কর্মবিরতিও হয়। এ ছাড়াও, নানা দাবিতে মলের আধিকারিকদের হেনস্থা করা শুরু করে কর্মীরা।
সবটাই চলছিল তাপসের অঙ্গুলিহেলনে, অভিযোগ এমনটাই। মলের একতলায় অফিস খুলে বসে তাপসের হম্বিতম্বি চলত। কর্মীদের বিক্ষোভ প্রশমিত করার ব্যাপারে অবশ্য মালিকপক্ষের কোনও কথাই কানে তুলত না সে। মলের পুরনো এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে ওর কোনও হেলদোল ছিল না। উল্টে একতলার কয়েকটা খালি ঘর দখল করে নেয় তাপস। সেখানে মদের আসর বসাতে শুরু করে। মাঝে মধ্যে ওই সব খালি
ঘরে এলাকার বাইরে থেকে আসা দুষ্কৃতীরা ডেরা গাড়ত।’’ জানা গেল, এ সব কথা মালিকপক্ষের কানে উঠেছিল ঠিকই। কিন্তু তাপস তত দিনে বারণ, নিষেধ শোনার ঊর্ধ্বে। তৃণমূলে তাপস-বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর অভিযোগ, মল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মাসের শেষ গুণে গুণে ৩ লক্ষ টাকা তোলা আদায়েই ছিল তার নজর।
২০১২ সালের শেষ দিকে কর্মী অসন্তোষ চরমে ওঠে। মাসিক বরাদ্দ ছাড়াও নানা অজুহাতে চলছিল টাকা আদায়। মালিকপক্ষের একজনের কথায়, ‘‘তাপস কৌশলে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে কর্মচারীদের লেলিয়ে দিয়েছিল। তারপর
নিজে তোলাবাজির মাত্রা চড়াতে শুরু করে। একে বারে যেন সাঁড়াশি আক্রমণ। ওই পরিস্থিতিতে ব্যবসায় লাভের গুড় সবই পিঁপড়ে খেয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।’’
ইতিমধ্যে নানা দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেন মলের কিছু কর্মী। তাদেরই কয়েক জনকে কলকাতায় ওই সংস্থার অন্য আউটলেটে বদলি করেন কর্তৃপক্ষ। তাতে আগুনে ঘি পড়ে। তাপসের নেতৃত্বে কর্তব্যরত ম্যানেজারকে মাটিতে ফেলে মারধর করা হয়। শপিং মলে ভাঙচুর চলে। পুলিশ ও স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব সব জেনেও সে সময়ে টুঁ শব্দটি করেননি বলে অভিযোগ। ধরা পড়েনি কেউ।
মলের এক আধিকারিক জানান, ওই ঘটনার পরে মালিকপক্ষ মল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। মল
খুলতে হবে, এই দাবিতেও চলছিল শাসানি। ২০১৩ সালের গোড়ায় পাকাপাকি ভাবে ঝাঁপ পড়ে শপিং মলটিতে। স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘তাপসের দৌরাত্ম্যেই ওই মল বন্ধ হয়েছে। দেড়শো কর্মচারী চাকরি খুইয়েছেন।’’
মল চালু হওয়ার পরে আশেপাশে আরও কিছু খাবারের দোকান গড়ে উঠেছিল। মল বন্ধ হওয়ার পরে সে সবও মুখ থুবড়ে পড়ে।
চালু ব্যবসায় গণেশ উল্টে দিয়ে তাপসের অবশ্য তখনও কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘এলাকার ভাবমূর্তিটাই নষ্ট হয়ে গেল। এরপরে কোনও বড় ব্যবসাদার কি আর ডায়মন্ড হারবারে আসতে চাইবেন?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy