Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সরকারি টেন্ডার কমিটি, মাথায় গায়ক ও প্রযোজক

সরকারি দফতরের টেন্ডার কমিটি, অথচ তার মাথায় রয়েছেন দু’জন বেসরকারি লোক। এ-ও এক নতুন নজির মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের। দু’জনের এক জন গত লোকসভা নির্বাচনে বহরমপুর কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী গায়ক ইন্দ্রনীল সেন। অন্য জন মুখ্যমন্ত্রীর অনুচর এক চলচ্চিত্র প্রযোজক, নাম শ্রীকান্ত মোহতা। কপিরাইট ট্যাক্স দেওয়ার ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতার অভিযোগ পেয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর তাঁরই প্রযোজনা সংস্থায় তদন্তে গিয়েছিলেন অর্থ দফতরের অফিসাররা।

শ্রীকান্ত মোহতা ও ইন্দ্রনীল সেন

শ্রীকান্ত মোহতা ও ইন্দ্রনীল সেন

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৪
Share: Save:

সরকারি দফতরের টেন্ডার কমিটি, অথচ তার মাথায় রয়েছেন দু’জন বেসরকারি লোক। এ-ও এক নতুন নজির মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের।

দু’জনের এক জন গত লোকসভা নির্বাচনে বহরমপুর কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী গায়ক ইন্দ্রনীল সেন। অন্য জন মুখ্যমন্ত্রীর অনুচর এক চলচ্চিত্র প্রযোজক, নাম শ্রীকান্ত মোহতা। কপিরাইট ট্যাক্স দেওয়ার ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতার অভিযোগ পেয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর তাঁরই প্রযোজনা সংস্থায় তদন্তে গিয়েছিলেন অর্থ দফতরের অফিসাররা। তদন্ত চলাকালীন নবান্নের শীর্ষস্তর থেকে টেলিফোন পেয়ে সেই তল্লাশি মাঝপথে ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন অর্থ-কর্তারা। এমনকী বাজেয়াপ্ত করা নথিপত্রও মোহতার কর্মচারীদের হাতে জমা দিয়ে আসতে হয়। ইন্দ্রনীলের পাশাপাশি এই প্রবলপ্রতাপ মোহতার কাঁধেই এ বার মমতা সরকারের প্রচার-সংস্থা নির্বাচনের দায়িত্ব তুলে দিয়েছে তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ।

সংস্থা বাছাইয়ের কাজও শুরু করে দিয়েছেন ওই প্রযোজক এবং গায়ক। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন সংস্থার কাছে প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। টেন্ডার কমিটির বাকি সদস্যরা অবশ্য সকলেই সরকারি অফিসার। তবে ইন্দ্রনীল-শ্রীকান্তের অধীনেই তাঁদের কাজ করতে হচ্ছে।

নিয়ম অনুযায়ী সরকারি কোনও দফতরের টেন্ডার কমিটিতে কেবলমাত্র সরকারি আধিকারিকেরাই থাকেন। টেন্ডার কমিটিতে বিশেষ দক্ষতার কোনও ব্যক্তির প্রয়োজন হতেই পারে। কিন্তু সেই ব্যক্তিকেও নেওয়া হয় কোনও সরকারি সংস্থা থেকে। অর্থাৎ সরকারি আধিকারিক নন, এমন কেউ কোনও অবস্থাতেই টেন্ডার কমিটির সদস্য বা চেয়ারম্যান হতে পারেন না।

অর্থ দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, দফতর, ডিরেক্টরেট, সরকার অধিগৃহীত সংস্থা, জেলা পরিষদ ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরে টেন্ডার কমিটি তৈরি হয়। ফলে কমিটির কোনও একটি নির্দিষ্ট কাঠামো গড়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু এই টেন্ডার কমিটিতে নিদেনপক্ষে গ্রুপ-এ অফিসারদের রাখতেই হয়। এমনকী মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদরাও থাকতে পারেন না সেই কমিটিতে। বরাত দেওয়ার জন্য সংস্থা বাছাইয়ের কাজের দায়িত্ব যে একমাত্র সরকারি আধিকারিকরাই পালন করবেন, সরকারি ক্ষেত্রে সেটাই নিয়ম।

কেন এই নিয়ম?

অর্থ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, এই ব্যবস্থায় সরকারি অফিসারদের দায়বদ্ধতার বিষয়টি যুক্ত থাকে। বরাত দেওয়ার কাজে কোনও গোলমাল ধরা পড়লে পরে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু টেন্ডার কমিটিতে বেসরকারি কেউ থেকে অনিয়ম, দুর্নীতি বা স্বজনপোষণ করে গেলে পরে আর কিছু করার থাকবে না।

উদাহরণ দিয়ে এক অর্থ-কর্তা জানাচ্ছেন, সম্প্রতি পরমা আইল্যান্ড-পার্ক সার্কাস উড়ালপুল নির্মাণের কাজে বরাত সংক্রান্ত গোলমাল ধরা পড়ে। সরকার তখন রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ সচিবের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি বসায়। বাতিল করা হয় ওই বরাত প্রক্রিয়া। তাতে প্রায় ১২০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। টু-জি, কয়লা কেলেঙ্কারির মতো ঘটনাতেও বরাত দেওয়ার কাজে যুক্ত তৎকালীন সরকারি অফিসাররাই এখন সিবিআই তদন্তের মুখে পড়েছেন। এক প্রাক্তন জুট কমিশনারের বিরুদ্ধে সরকারি চটকলে নিয়ম ভেঙে হাওড়ার এক মাফিয়াকে নির্মাণ কাজের বরাত দেওয়ার অভিযোগ ওঠায় তদন্ত শুরু হয়েছে। ওই অর্থ-কর্তার প্রশ্ন টেন্ডার কমিটির মাথায় কোনও বেসরকারি লোক থাকলে কি এটা করা যেত?

তা হলে সরকারি সাফল্য প্রচারে সংস্থা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইন্দ্রনীল সেন বা শ্রীকান্ত মোহতা কী ভাবে টেন্ডার কমিটির মাথায় এলেন? তথ্য সংস্কৃতি অধিকর্তা রীতেন্দ্রনারায়ণ বসু রায়চৌধুরির জবাব, “কর্তৃপক্ষ মনে করেছেন, তাই এসেছেন!” কে এই কর্তৃপক্ষ? অধিকর্তার জবাব, “তা আপনাকে জানানো আমার কাজ নয়।”

সাধারণত টেন্ডার কমিটি তৈরি করেন দফতরের সচিব। বরাত দেওয়ার জন্য যে সংস্থার নাম টেন্ডার কমিটি বাছাই করে, তাতে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার অধিকারীও তিনিই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সচিব অবশ্য মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে টেন্ডার কমিটি তৈরি বা বরাত দেওয়ার কাজ করে থাকেন। তবে কোনও ক্ষেত্রেই সরকারি অফিসার (গ্রুপ-এ) ছাড়া অন্য কেউ এই ধরনের কমিটির মাথায় তো দূরের কথা, সাধারণ সদস্য হিসেবেও থাকতে পারেন না।

এ ক্ষেত্রে তা হলে সরকারি প্রচার সংস্থা বাছাইয়ের টেন্ডার কমিটিতে গায়ক-প্রযোজকের নিয়োগ হল কী ভাবে? এই প্রশ্নের জবাব পেতে অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে বার বার টেলিফোন করা হয়, এসএমএস পাঠানো হয়। কিন্তু কোনও জবাব মেলেনি। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে অর্থ দফতর কিছুই জানে না। নিয়ম ভাঙা হলে তার দায় সম্পূর্ণ ভাবে ওই দফতরের। তথ্য অধিকর্তার ইঙ্গিত অনুযায়ী ইন্দ্রনীল বা মোহতাকে টেন্ডার কমিটির মাথায় এনেছেন তাঁর উপরতলার কর্তারা অর্থাৎ সচিব অথবা মন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে টেলিফোনে এবং এসএমএস বার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তথ্য ও সংস্কৃতিসচিব অত্রি ভট্টাচার্য সাড়া দেননি। তবে তাঁর দফতরের ব্যাখ্যা, টেন্ডার কমিটিতে কারা থাকতে পারবেন তা নিয়ে অর্থ দফতরের কোনও সুনির্দিষ্ট বিধি নেই। সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে ইতিমধ্যেই প্রচার কমিটির মাথায় ইন্দ্রনীল ও মোহতাকে বসানো হয়েছে। সুতরাং তাঁরা তো সরকারি লোকই। ফলে ওই দু’জনকে টেন্ডার কমিটিতে নেওয়ায় অনৈতিক কিছু হয়নি।

যাঁদের নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক, তাঁদের এক জন ইন্দ্রনীল সেন বলেন, “যদি এটা নিয়মবিরুদ্ধ হয় লিখুন। আমার কিছু বলার নেই।”

শ্রীকান্ত মোহতাকে তাঁর বক্তব্য জানতে টেলিফোন করা হলে তিনি জানান, বৈঠকে ব্যস্ত আছেন পরে কথা বলবেন। পরে বহু চেষ্টা করা হলেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE