Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

তৃণমূল অফিসেই গুলি করে খুন করা হল খড়্গপুরের রেলমাফিয়া শ্রীনুকে

মাস আষ্টেক আগে বিধানসভা ভোটের দিন। খড়্গপুরের মাটিতে দুধসাদা অডি এ-ফোর গাড়িতে বসে আনন্দবাজারকে সে বলেছিল, ‘‘এক দিন অ্যায়সা আয়েগা, জব শ্রীনুকে ইশারে পে খড়্গপুর মে হর পেড় কা পত্তা হিলেগা।’’

শ্রীনু

শ্রীনু

দেবমাল্য বাগচী
খড়্গপুর শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:১৮
Share: Save:

মাস আষ্টেক আগে বিধানসভা ভোটের দিন। খড়্গপুরের মাটিতে দুধসাদা অডি এ-ফোর গাড়িতে বসে আনন্দবাজারকে সে বলেছিল, ‘‘এক দিন অ্যায়সা আয়েগা, জব শ্রীনুকে ইশারে পে খড়্গপুর মে হর পেড় কা পত্তা হিলেগা।’’

সেই দিন আর দেখা হল না এ শ্রীনিবাস নায়ডুর। বুধবার বিকেলে খড়্গপুরের নিউ সেট্লমেন্ট এলাকায় তৃণমূলের ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির কার্যালয়ে হানা দিয়ে তার কপালে গরম বুলেট ফুঁড়ে দিল কয়েক জন অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী। রাতে কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে খড়্গপুরের কুখ্যাত এই রেল মাফিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। হামলায় মৃত্যু হয়েছে ধর্মা রাও (২৫) নামে শ্রীনুর এক শাগরেদেরও। জখম তিন জন।

এ শ্রীনিবাস নায়ডু। বয়স হয়েছিল মাত্র ২৭। রেল-শহর শ্রীনু নায়ডু় নামেই চিনত তাকে। ছাঁট লোহার কারবারি শ্রীনুকে দেখতে ছিল অনেকটা দক্ষিণী ছবির নায়কের মতো। আঙুলে দু’টো সোনার আংটি, কব্জিতে সোনার বালা, দু’কানে সোনার মাকড়ি, গলায় মোটা সোনার চেন, দু’হাতে ট্যাটু। গত কয়েক বছরে তার বিরুদ্ধে খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, তোলাবাজি, গুলি চালানোর অভিযোগ কম ওঠেনি। হাজতেও গিয়েছে। তবু দমানো যায়নি শ্রীনুকে। খড়্গপুরে একটু একটু করে সাম্রাজ্য ছড়াচ্ছিল এই তেলুগু যুবক।

তৃণমূলের যে কার্যালয়ে খুন হল শ্রীনু, সেখানেই বসেন ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর পূজা নায়ডু। যাঁর অন্য পরিচয়, শ্রীনুর স্ত্রী। এ দিন ঘটনা যখন ঘটে, পূজা তখনও কার্যালয়ে আসেননি। স্থানীয়রা বলছেন, শাগরেদদের নিয়ে তখন ওই অফিসে বসে রাজ্যপাট চালাচ্ছিল শ্রীনু। দু’জন দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে। হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায় ধূসর রঙের একটা গাড়ি। মুখঢাকা কয়েক জন যুবক নেমে দ্রুত ঢুকে যায় তৃণমূল কার্যালয়ে। তার পরেই বোমা-গুলির প্রবল আওয়াজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলি ছুড়তে ছুড়তে তারা আবার বেরিয়ে এসে গাড়ি নিয়ে চম্পট দেয়।

গুলির শব্দে ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। ফুটপাথে তখন রক্তের দাগ, গুলিতে ফুটো হয়ে যাওয়া চেয়ার। ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, মাটিতে পড়ে আছে রক্তাক্ত শ্রীনু। তার কপালে গুলি লেগেছে। একই অবস্থা শ্রীনুর ‘ডান হাত’ ধর্মা রাওয়ের। এম গোবিন্দ এবং সি শ্রীনু নামে আরও দুই সহচরেরও গুলি লেগেছে। এ ছাড়া বি গোবিন্দ নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা নিজের কাজে ওই কার্যালয়ে এসেছিলেন। আহত হয়েছেন তিনিও। শ্রীনু এবং ধর্মাকে প্রথমে খড়্গপুর রেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বাকি তিন জনকে খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে। সেখান থেকে মেদিনীপুর মেডিক্যালে। পরে সকলকেই কলকাতায় আনা হয়। বেসরকারি একটি হাসপাতালে শ্রীনু ও ধর্মাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

সকলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়ে ঘটনাস্থলে হাজির এক মহিলা সংবাদমাধ্যমকে জানান, তাঁর নাম সি লক্ষ্মী। তিনি শ্রীনুর অন্যতম শাগরেদ সি শ্রীনুর মা। ওই মহিলা বলেন, “প্রথমে বোমা, পরে গুলির শব্দ পাই। ছেলে শ্রীনু নায়ডুর সঙ্গে গল্প করতে এসেছিল। তাই ছুটে এলাম। দেখলাম ছেলে ও ধর্মা গুলিবিদ্ধ হয়ে বাইরে পড়ে রয়েছে। ভিতরে শ্রীনু নায়ডু পড়ে। যারা মেরেছে তাদের দেখতে পাইনি।” ঘটনার পরেই থমথমে হয়ে যায় রেল-শহরের পরিবেশ। এলাকায় বসানো হয় পুলিশ পাহারা।

কারা গুলি করল শ্রীনুকে?

পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ বলেন, “নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে তদন্তে জানা গিয়েছে। ঘটনার সঙ্গে কারা যুক্ত তা স্পষ্ট নয়। তবে, আমরা দ্রুত অপরাধীদের ধরে ফেলব।” প্রায় মাঝরাতে কলকাতা থেকে ফেরার পর পুরপ্রধান প্রদীপ সরকারের সঙ্গে খড়্গপুর টাউন থানায় যান পূজা। সেখানে এসপি-র সঙ্গে কথা হয় তাঁর। গভীর রাত পর্যন্ত শ্রীনুর পরিবার বা পুলিশের তরফে এই সাক্ষাৎ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলা হয়নি।

যদিও রাজনৈতিক চাপান-উতোর শুরু হয়ে গিয়েছে। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সী বলেছেন, ‘‘ভাড়া করা গুন্ডা না বিরোধী শক্তি— খুনের পিছনে কারা, পুলিশকে তা খতিয়ে দেখতে বলেছি। ওই আসনের যিনি বিধায়ক, তিনি সারা রাজ্যে পেশিশক্তির আস্ফালন করে বেড়াচ্ছেন। ফলে প্রকৃত ঘটনা কী ঘটেছে, তদন্ত হওয়া দরকার।’’ নাম না-করে খড়্গপুরের বিজেপি বিধায়ক তথা দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন সুব্রতবাবু। পুরপ্রধান প্রদীপবাবু অবশ্য রাখঢাক না করেই বলেছেন, ‘‘দিলীপ ঘোষ শ্রীনুকে খুনের হুমকি দিয়েছিলেন। এটা তাঁরই কাজ। আমরা দিলীপ ঘোষের গ্রেফতারি চাই।’’ দিলীপবাবু এখন বাংলাদেশে। দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘সমাজবিরোধীদের নিয়ে রাজনীতি করলে এই হয়। বিজেপি খুনের রাজনীতি করে না। আর দিলীপ ঘোষের এত দৈন্যদশা হয়নি যে শ্রীনু নায়ডুর মতো এক সমাজবিরোধীকে খুন করাতে যাবেন।’’

শ্রীনু যে ভাবে খড়্গপুরের ‘দখল’ হাতে নেয়, সে এক লম্বা কাহিনি।

দীর্ঘদিন ধরে খড়্গপুরে ‘মুকুটহীন রাজা’ বলতে একটাই নাম উঠে আসত— বাসব রামবাবু। রেলের ছাঁট লোহার কারবারে কোটি কোটি টাকা ওড়ে এই রেল-শহরে। সেই টাকার দখলদারিতে অনেক রক্ত লেগে রয়েছে। বাম আমলে সেই মৃত্যুমিছিলের তালিকায় বহুচর্চিত দুই নাম ছিল মানস ও গৌতম চৌবে। খড়্গপুরের সিপিআই নেতা নারায়ণ চৌবের দুই ছেলে। ১৯৯৯ ও ২০০১ সালে— দু’বছরের ব্যবধানে খুন হন দুই ভাই। সেই মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয় রামবাবুর। সে জেলে থাকার সময় থেকেই নাকি শ্রীনু দখল করতে শুরু করে তার সাম্রাজ্য।

বেশ কয়েকটি ডাকাতির মামলায় শ্রীনুর নাম জড়ায়। জেলে যেতে হয় শ্রীনুকে। রামবাবুর সঙ্গে শ্রীনুর মুখোমুখি আলাপ সেখানেই। সুপ্রিম কোর্টে শর্তাধীন জামিন পেয়ে ২০১০ সালে ফিরে আসে রামবাবু। সাম্রাজ্য হারানোর আশঙ্কায় ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে রামবাবুর উপরে শ্রীনু হামলা চালায় বলে অভিযোগ। কিন্তু বেঁচে যায় রামবাবু। যদিও তার পর থেকেই রামবাবুর নাম চলে যায় পিছনের সারিতে। উত্থান হতে থাকে শ্রীনুর। তবে, শ্রীনুর খুন নিয়ে এ দিন রামবাবুর কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। ফোন করা হলে তার ছেলে পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি জানান, রামবাবু শহরের বাইরে রয়েছে।

রামবাবুর মতো শুধু এলাকা দখলেই থামেনি শ্রীনু। রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রথমে তাকে নিয়ে যায় বিজেপির কাছে। ২০১৫-র পুরসভা নির্বাচনে শ্রীনুর স্ত্রীকে টিকিট দেয় বিজেপি। জিতে তৃণমূলে যোগ দেন পূজা। বিধানসভা ভোটের আগে শ্রীনু দায়িত্ব নেয় তৃণমূলের ‘লেবার সেল’-এর। তখন বহু তৃণমূল নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। নেতাদের সঙ্গে এক মঞ্চেও দেখা যায় তাকে। ভোটের সময়ে তৃণমূলের হয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিতেও দেখা গিয়েছিল শ্রীনুকে। তখনই তার সেই বিখ্যাত উক্তি— বিলাসবহুল গাড়িতে বসে। ‘বাদশা’ হওয়ার স্বপ্ন তখন চোখেমুখে।

বুধবার বিকেলে যে স্বপ্ন চিরতরে তলিয়ে গেল রেল-শহরের অন্ধকারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

TMC Shrinu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE