Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সিঙ্গুর যেন যুদ্ধক্ষেত্র, থমকে যাচ্ছে গাড়ি

দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের এই জায়গায় এসে গাড়ির গতি কমে যাচ্ছে। কৌতূহলী চোখ জানলা দিয়ে দেখে নিচ্ছে সিঙ্গুরের আরেক পর্ব। কেউ বা গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ছেন সময়ের সাক্ষী হওয়ার জন্য।

এখন যে রকম। সিঙ্গুরের কারখানা। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

এখন যে রকম। সিঙ্গুরের কারখানা। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় ও পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়
সিঙ্গুর শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:১৬
Share: Save:

দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের এই জায়গায় এসে গাড়ির গতি কমে যাচ্ছে। কৌতূহলী চোখ জানলা দিয়ে দেখে নিচ্ছে সিঙ্গুরের আরেক পর্ব। কেউ বা গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ছেন সময়ের সাক্ষী হওয়ার জন্য।

যেমন, ফলতার অজয় হালদার। স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে নিয়ে তারপীঠ যাচ্ছিলেন। পথে সিঙ্গুরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন কারখানা গেটের সামনে। কী দেখছেন? অজয়বাবুর জবাব, ‘‘সিঙ্গুর নিয়ে অনেক শুনেছি, খবরের কাগজে পড়েছি। সামনে

দিয়ে যখন যাচ্ছি, এক বার নিজের চোখে দেখি।’’

ন্যানো কারখানার চত্বর জুড়ে জবরদস্ত তৎপরতা। শুক্রবার থেকে শুরু হল ডিনামাইট ফাটিয়ে কারখানার শেড ভাঙা। অন্তত ৫০টি জেসিবি আর্থ মুভার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সেখানে। যেন যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক!

যুদ্ধই বটে! মুখ্যমন্ত্রী ২০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। তার মধ্যেই টাটাদের শেড ভেঙে ফেলে, পুকুর বুজিয়ে, পিচ রাস্তা উপড়ে মাটির মুখ দেখাতে হবে। যে মাটিতে আবার চাষ হবে। এখন যেখানে কাশ ফুলের ঢেউ, সেখানে ফসল ফলবে। সেই লক্ষ্যেই এখন দিনরাতের যুদ্ধ চলছে সিঙ্গুরে।

কারখানার পাঁচিলের বাইরে বসেছে মুড়ি-তেলেভাজার দোকান। রাস্তার ধারে গাছে গাছে ঝুলছে সিঙ্গুরে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার বি়জ্ঞাপন। দূর দূর থেকে শ্রমিকেরা আসছেন। পুলিশ ব্যস্ত হলুদ ‘এন্ট্রি’ পাশ তৈরিতে। আর সব কাজে অতন্দ্র নজর রাখছে পেল্লায় সব সিসিটিভি ক্যামেরা।

কিন্তু সময়সীমার নিরিখে কাজটা মোটেই সহজ নয় বলে মনে করছেন এক ঠিকাদার সংস্থার ম্যানেজার। দুর্গাপুর থেকে এসেছেন। কারখানা শেডের ২০০০ টন লোহা নামানোর বরাত তাঁদের। কাজটা কঠিন কেন? ঠিকাদার সংস্থার ওই ম্যানেজার বলেন, ‘‘মূল কারখানার শেডগুলির নীচে সাত-আট ফুট পুরু কংক্রিট রয়েছে, যা ভূমিকম্প সহ্য করতে পারে। ডিনামাইট ফাটিয়েই ওই ধরনের কংক্রিট ভাঙা সম্ভব।’’

ভদ্রলোক যে ভুল বলেননি, তা টের পাওয়া গিয়েছে শুক্রবারই। ডিনামাইট ফাটিয়েই ক‌ংক্রিট ভাঙা শুরু হয়েছে। অন্য শ্রমিকদের দূরে সরিয়ে দিয়ে আট-দশ জনের একটি দল এই কাজ শুরু করল। জেলা প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, প্রয়োজনে আরও শ্রমিক লাগানো হতে পারে ডিনামাইট ফাটানোর কাজে। কারণ, যত দ্রুত সম্ভব, জমিকে চাষের উপযুক্ত করতে হবে।

সিঙ্গুর কৃষক বাজারে চেক বিলির অস্থায়ী শিবির হয়েছে। অনিচ্ছুকরা চেক নিচ্ছেন। ইচ্ছুকরা পরচা। সাড়ে ১৩ হাজার চাষির হাতে হয় চেক অথবা পরচা পৌঁছে দেওয়ার তাড়ায় প্রশাসনের ঘুম ছুটেছে। শিবিরে দাঁড়িয়ে বেড়াবেড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান দুধকুমার ধাড়া বলছেন, ‘‘আমাদের প্রমাণ করতে হবে, আন্দোলন ভুল ছিল না। সুপ্রিম কোর্ট মান্যতা দিয়েছে। এ বার চাষিদের মাঠে নামিয়ে আমরা দেখাব, সিঙ্গুরে কৃষিই হবে।’’

সিঙ্গুরকে অনেক কিছুরই প্রমাণ দিতে হয়েছে। এক বার গেয়েছে শিল্পের গান। চাষির জমিতে পাঁচিল উঠেছে, তৈরি হয়েছে কারখানা। এখন আবার সিঙ্গুরকে ফিরতে হবে দশ বছর আগের চেহারায়। চাষ নিয়ে উপপ্রধানের গলায় যতটা জোর, অনেক কৃষকেরই কিন্তু তা নেই। ওই জমি কতটা চাষযোগ্য হবে, তা নিয়ে এখনও সংশয় রয়েছে তাঁদের।

কারখানার আশপাশে এখন দুম-দাম শব্দ, ধুলোর ঝড়! তারই মধ্যে ন্যানো-র ভাঙা শেডকে পিছনে রেখে সেলফি তুলছেন অনেকেই। লাঙল ফেরার পরে সিঙ্গুরে শিল্পায়নের গড়া-ভাঙা হয়তো মোবাইলের স্মৃতিতেই থেকে যাবে। আর ইতিহাসে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

dynamite singur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE