Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

প্রয়াত সেতারবাদক সুব্রত রায়চৌধুরী

পণ্ডিত বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং উস্তাদ হাফিজ় আলি খাঁ-র ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন তিনি। ধ্রুপদী সঙ্গীতের দিকে তাঁর ঝোঁকের কারণেই হয়তো বাজনার ক্ষেত্রে আলাপ এবং জোড়ের মতো ধীর, ধ্যানমুগ্ধ দিকগুলি হয়ে ওঠে তাঁর প্রিয়।

সুব্রত রায়চৌধুরী

সুব্রত রায়চৌধুরী

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৭ ০৪:১৭
Share: Save:

শুধুমাত্র বিখ্যাত সেতারবাদক বা সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে নয়, শিল্পের জগতে দু’টি দুনিয়াকে মেলানোর জন্য ভক্তরা মনে রাখবেন শ্রী সুব্রত রায়চৌধুরীকে।

জন্ম ১৯৪২-র ২৯ জানুয়ারি, কলকাতায়। ১৪ বছর বয়সে গুরু শ্রী নির্মল চক্রবর্তীর কাছে সেতারে হাতেখড়ি। শিল্পীর কাছে খুলে যায় নতুন পৃথিবী। মিশনারি স্কুলে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সুব্রতর সঙ্গীতশিক্ষা চলেছিল প্রাচীন বৈদিক ধারায়। প্রাচ্য
দর্শনচিন্তার সঙ্গে স্বাভাবিক পাশ্চাত্য যুক্তিবোধ মিলিত হয়ে সুব্রতর সঙ্গীত এক অনন্য মাত্রা পেয়েছিল। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য মেলানো এই বিশ্বদর্শনই ছিল তাঁর সঙ্গীতের মূল ধারা।

পণ্ডিত বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং উস্তাদ হাফিজ় আলি খাঁ-র ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন তিনি। ধ্রুপদী সঙ্গীতের দিকে তাঁর ঝোঁকের কারণেই হয়তো বাজনার ক্ষেত্রে আলাপ এবং জোড়ের মতো ধীর, ধ্যানমুগ্ধ দিকগুলি হয়ে ওঠে তাঁর প্রিয়। ‘গন্ডা’ বেঁধে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ডাগর ঘরানার বিখ্যাত ধ্রুপদ গায়ক উস্তাদ নাসির আমিনুদ্দিন খান ডাগরের। এরপর রাধিকামোহন মৈত্র ও বিমল মুখোপাধ্যায়ের কাছে সেতারবাদনের বিভিন্ন ঘরানায় শিক্ষাপ্রাপ্ত সুব্রতবাবুর বাজনায় ধীরে-ধীরে ধ্বনিত হয় উনিশ শতকের ফেলে আসা সুর। বীণা মিড় অঙ্গ ও রবাবি বোল বানি হয়ে ওঠে তাঁর পছন্দের জায়গা।

ছয়ের দশকের শুরুতে কলকাতায় প্রথমবার শ্রোতাদের সামনে সেতার ধরেন সুব্রতবাবু। এরপর বহু অনুষ্ঠান ও পুরস্কার জয়। সাতের দশকে শুরু হয় বিদেশে সঙ্গীতভ্রমণগুলি। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি প্রভৃতি দেশের রেডিও স্টেশনগুলিতে বেজে ওঠে তাঁর সেতার। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, দু’টি দিক মেলানোর কথা হচ্ছিল না? বেশ কিছু জ্যাজ় অনুষ্ঠানে সুব্রতবাবু নিমন্ত্রিত হন। বাজিয়েছেন সোপরানো স্যাক্সোফোনিস্ট স্টিভ লেসির সঙ্গে। তাঁর অ্যালবাম ‘এক্সপ্লোরেশন’ ফিউশন সঙ্গীতে খুবই জনপ্রিয়। সুব্রতবাবু সঙ্গীতজ্ঞানের ঝুলিটি ভরা বিরা়ট সংখ্যক রাগে। সঙ্গীতের নানা দিকের মহামিলন তাঁর আঙুলের টানে। জার্মানিতে রবিশঙ্করের পরে প্রথম সেতারবাদক হিসেবে তাঁর অনুষ্ঠান ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য পথ খুলে দেয়। ইন্ডিয়া আর্কাইভ মিউজ়িক থেকে তাঁর অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বসঙ্গীত বিভাগে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে তিনিই প্রথম ভারতীয়।

আরও পড়ুন: কাশ্মীর নিয়ে রাওয়তের সুরেই সুর রাজনাথের

ভারত ছাড়া ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে সেতারবাদন পরিবেশন করেছেন সুব্রতবাবু। বক্তৃতা দিয়েছেন বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলকাতা, বার্লিন ও নিউ ইয়র্কের স্টুডিয়োতে কাজ করেছেন প্রচুর শিক্ষার্থীকে নিয়ে। তাঁর স্থাপন করা সুব্রত স্কুল অব মিউজ়িক বিভিন্ন দেশে জন্ম দিয়েছে বহু সঙ্গীতশিল্পীর। সঙ্গীতকে আরও জানা ও ভালবাসার কারণে কলমও ধরেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা ও দ্য স্টেট্‌সম্যান পত্রিকায় লিখেছেন। থিমা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর বই ‘দ্য সাউন্ড অব সিতার’।

২২ মে ৭৫ বছর বয়সে বার্লিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন সুব্রতবাবু। রেখে গিয়েছেন স্ত্রী উমা, কন্যা সোহিনী, জামাতা সুদীপ্ত এবং দৌহিত্র ঋষিকে। সোহিনী নামী নৃত্যশিল্পী। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যর মধ্যে সঠিক মেলবন্ধন ঘটাতে পারেন এমন শিল্পী-দার্শনিকের ক্রমশই অভাব ঘটছে। সুব্রতবাবুর প্রয়াণ সে ক্ষেত্রে এক অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু তাঁর সঙ্গীত ভক্তদের মনে তাঁর স্মৃতিকে জাগরূক রাখবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE