Advertisement
২৭ মে ২০২৪

ইজাজের সূত্রেই জালে ইরশাদ

প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের জাহাজ তৈরির কারখানায় ঠিকা শ্রমিকের কাজ করত সে। অভিযোগ, ওই কারখানা থেকেই তথ্য জোগাড় করে তা পাঠিয়ে দিত পাকিস্তানে! এবং সেটা দীর্ঘদিন ধরেই। শুধু এটুকু নয়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের জাহাজ তৈরির কারখানায় ঠিকা শ্রমিকের কাজ করত সে। অভিযোগ, ওই কারখানা থেকেই তথ্য জোগাড় করে তা পাঠিয়ে দিত পাকিস্তানে! এবং সেটা দীর্ঘদিন ধরেই। শুধু এটুকু নয়। খাস কলকাতার বুকে বসেই পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের এক এজেন্টকে নিজের বাড়িতে দেড় বছর আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি তার জন্য তৈরি করে দিয়েছিল এ দেশের ভোটার আইডি, পাসপোর্টের মতো পরিচয়পত্রও। রবিবার পাক চর সন্দেহে গার্ডেনরিচের বাসিন্দা ইরশাদ আনসারিকে গ্রেফতার করার পর এমনই দাবি করছেন গোয়েন্দারা। সোমবার ইরশাদ, আসফাক ও জাহাঙ্গিরকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হলে বিচারক তাদের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেন।

কলকাতার বুকে বসে দীর্ঘদিন ধরে এমন কাজকর্ম চালিয়ে গেলেও এত দিন অবশ্য কলকাতা পুলিশের নজরেই আসেনি সে! গোয়েন্দা সূত্রের খবর, গত শুক্রবার উত্তরপ্রদেশের মেরঠ থেকে পাক এজেন্ট মহম্মদ কালাম ওরফে ইজাজ ধরা পড়ার পর তাকে জেরা করে সে রাজ্যের গোয়েন্দারা কলকাতায় আইএসআইয়ের এই চক্রটির হদিস পান। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের থেকে খবর পেয়েই ইরশাদ, তার ছেলে আসফাক এবং শ্যালক জাহাঙ্গিরকে পাকড়াও করেছে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)।

গোয়েন্দাদের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ইজাজের কাছ থেকে কলকাতা যোগের তথ্য মেলার পর শুক্রবার থেকেই ইরশাদদের নজরবন্দি করে ফেলেছিল কলকাতা পুলিশের এসটিএফ। রবিবার দুপুরে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয় তাদের। তবে এসটিএফের একটি সূত্র বলছে, ইজাজ কলকাতায় আসার আগে থেকেই ইরশাদ আইএসআইয়ের হয়ে কাজ করত। কলকাতা পুলিশের এক এসটিএফ কর্তার কথায়, ‘‘অন্তত দশ বছর ধরে সে এই কাজ করছে বলে জেরায় জানিয়েছে ইরশাদ।’’ গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি, চলতি শতকের গোড়ার দিকে পাকিস্তানের করাচিতে আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েই পাক গুপ্তচর সংস্থার অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। ইতিমধ্যেই নিরাপত্তা সংক্রান্ত বহু তথ্য সে পাকিস্তানে পাচার করেছে।

কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র এ দিন জানান, একবালপুরের সুধীর বসু রোড থেকে ইরশাদ, আসফাক ও জাহাঙ্গিরকে ধরার পরে তাদের কাছ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকার জাল নোট, গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স (জিআরএসই) এবং নেতাজি সুভাষ ডকের হাতে আঁকা মানচিত্র এবং আরও নানা গুরুত্বপূর্ণ নথি মিলেছে। তিন জনের বিরুদ্ধেই দেশদ্রোহিতা-সহ একাধিক অভিযোগে মামলা রুজু করা
হয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, ইরশাদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের জাহাজ নির্মাণ কারখানা জিআরএসই-র ঠিকা শ্রমিক ছিলেন। তিনি তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র সদস্য বলেও জানা গিয়েছে। তাঁর ছেলে আসফাক গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা।

গোয়েন্দাদের দাবি, ইজাজকে আশ্রয় দেওয়ার বেশ কয়েক বছর আগেই করাচিতে আত্মীয়দের বাড়িতে ঘুরে এসেছে ইরশাদ। তখন থেকেই তার আইএসআই-যোগ। আত্মীয়তার সূত্রে বাংলাদেশেও যাতায়াত ছিল ইরশাদ, আসফাক ও জাহাঙ্গিরের।
গত ১৪ নভেম্বর মধ্য কলকাতার কলুটোলা থেকে সন্দেহভাজন
পাক চর আখতার খানকে গ্রেফতার করে এসটিএফ। দু’দিন পরে তার ভাই জাফরকেও গ্রেফতার করা হয়। আখতার ও জাফরও দীর্ঘদিন করাচিতে ছিল। আখতারের
সঙ্গে ইরশাদদের কোনও যোগসূত্র রয়েছে কি না, তা এখন খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।

উত্তরপ্রদেশ পুলিশ জানিয়েছে, ইজাজ মেরঠ, আগরা, বরেলীর
বিভিন্ন বায়ুসেনা ঘাঁটি ও সেনা
ছাউনির তথ্য, অস্ত্রশস্ত্র, বিমান এবং গতিবিধির তথ্য জোগাড় করে পাকিস্তানে পাঠাত। পাক নাগরিক ইজাজ আইএসআইয়ের কাছে চরবৃত্তির প্রশিক্ষণ শেষে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে জলপথে বসিরহাট সীমান্ত দিয়ে এ দেশে ঢোকে। ২০১৩ সালের অগস্ট মাসে সে গার্ডেনরিচের রামনগরে ইরশাদের কাছে যায়। আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি ইরশাদ এই পাক গুপ্তচরের জন্য ভোটার কার্ড, পাসপোর্ট, রেশন কার্ডও তৈরি করেছিল বলে অভিযোগ।

উত্তরপ্রদেশ এসটিএফের আইজি সুজিত পাণ্ডে বলেন, ‘‘মেটিয়াবুরুজে ইজাজ কেবল দেড় বছর বসবাস করেছে এমন নয়। কলকাতায় সে আরও কিছু সহায়তা পেয়েছে। যার ফলে কলকাতা থেকে সে বরেলীতে চলে এসে কাজ করতে পারে।’’ গোয়েন্দারা জানান, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইজাজ কলকাতায় ছিল। সেই সময়ে সে ইরশাদ মারফত গার্ডেনরিচের জাহাজ কারখানার বিভিন্ন তথ্য ও ছবি পাকিস্তানে পাচার করেছে। কলকাতার একটি ব্যাঙ্কে ইজাজের অ্যাকাউন্টও ছিল। পাকিস্তানে নথি ও তথ্য
পাচারের জন্য সেই অ্যাকাউন্টে নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা আসত। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি, ইজাজ এক জন বড় মাপের আইএসআই এজেন্ট। সে এ দেশে ঢোকার পরে তার অধীনেই ইরশাদরা কাজ করত।

গোয়েন্দাদের একটি সূত্র বলছে, এ দেশে বসে ই-মেল মারফত পাকিস্তানে নথি পাচার করত ইরশাদ। পাশাপাশি আসফাক
দু’বার বাংলাদেশে গিয়ে বাবার

দেওয়া ভারতীয় নৌবাহিনীর কিছু গোপন তথ্য ও ছবি সেখানকার কিছু লোকের হাতে তুলে দিয়ে এসেছে। অভিযোগ উঠেছে, ঠিকা শ্রমিক হলেও নিজের ক্ষমতাবলে কখনও কখনও বাইরের লোককেও ‘ডেলি পাস’ বানিয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়েছে ইরশাদ!

প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এমন গুরুত্বপূর্ণ জায়গার নথি ফাঁস হওয়ার ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে নড়েচড়ে বসেছেন সেনা গোয়েন্দারাও। তাঁদের একাংশের মতে, শুধু বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি নয়, বিদেশি শক্তির সঙ্গে যুদ্ধের নিরিখেও গার্ডেনরিচের কারখানা গুরুত্বপূর্ণ। কেন?

কেন্দ্রীয় ও সেনা গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, দেশের সমুদ্র উপকূলই এই মূহূর্তে জঙ্গি হানা বা বিদেশি আক্রমণের সবচেয়ে বড় নিশানা। বিশেষ করে ডুবোজাহাজে চেপে হানা দিতেই পারে শত্রুসেনা। তাই ডুবোজাহাজ-বিধ্বংসী জাহাজ তৈরির উপরে সাম্প্রতিক কালে বেশি জোর দিয়েছে ভারতীয় নৌসেনা। নয়া প্রযুক্তির এই জাহাজগুলির সব ক’টাই তৈরি হচ্ছে জিআরএসই-তে। নৌ-সেনা সূত্রের খবর, চিনের সহায়তায় পাকিস্তানও নয়া প্রযুক্তির ডুবোজাহাজ তৈরির কাজ শুরু করছে। গত অক্টোবরেই এই চুক্তির কথা ঘোষণা করেছে ইসলামাবাদ। এই পরিস্থিতিতে গার্ডেনরিচে তৈরি হওয়া ডুবোজাহাজ-বিধ্বংসী জাহাজগুলির নকশা এবং অস্ত্র সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য জোগাড় করলে পাকিস্তান এর মোকাবিলায় নয়া প্রযুক্তির ডুবোজাহাজ সহজেই তৈরি করতে পারবে বলে সেনা কর্তাদের আশঙ্কা। আর সেই জন্যই গার্ডেনরিচের ভিতরের খবর জোগাড় করা হচ্ছিল বলে গোয়েন্দাদের একাংশ মনে করছেন।

প্রশ্ন উঠছে, এত গুরুত্বপূর্ণ কারখানার ভিতরে পাক গুপ্তচর ঢুকল কী ভাবে?

প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের একটি সূত্রে বলা হচ্ছে, এই ধরনের সংস্থায় যাঁরা পাকাপাকি ভাবে চাকরি করেন, তাঁদের নিয়োগের আগে পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সব তথ্য খতিয়ে দেখে। কিন্তু অনেক

ক্ষেত্রে ঠিকাদার সংস্থার মাধ্যমে ইরশাদের মতো অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। তাঁদের ভোটার
কার্ড বা আধার কার্ড খতিয়ে দেখা হলেও গোয়েন্দা নজরদারি সম্ভব নয়। সূত্রের খবর, তা ছাড়া ইরশাদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু পুলিশ অফিসারের দহরম-মহরমও ছিল চোখে পড়ার মতো। সে নিজেও শাসক দলের শ্রমিক সংগঠনের সদস্য ছিল। তার ছেলে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা। এমন যোগাযোগেই ঠিকা শ্রমিকের কাজ পেতে ইরশাদের সমস্যা

হয়নি বলে মনে করছেন গোয়েন্দাদের একাংশ। এ দিন গার্ডেনরিচের ওই জাহাজ কারখানার চেয়ারম্যান এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল অনিলকুমার বর্মা বলেন, ‘‘আমরা নিজেরাও এই ঘটনা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছি। পাশাপাশি পুলিশের সঙ্গেও কথা বলছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE