Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

বারুদের আঁতুড়ঘরেই বন্দি নানুর

কী বা ডান, কী বা বাম— গদি যাদের দখলেই থাক, নানুর রয়ে গিয়েছে সেই নানুরেই! বোমা উদ্ধার, খুচরো মারপিট, এলাকায় হুজ্জুতি তাই আর নতুন কোনও খবর নয় নানুরের কাছে। খবরের কাগজের শিরোনামে ‘নানুর’ দেখে চমকে যান না পড়শি গাঁ-ঘরের মানুষও।

অর্ঘ্য ঘোষ
নানুর শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:২১
Share: Save:

কী বা ডান, কী বা বাম— গদি যাদের দখলেই থাক, নানুর রয়ে গিয়েছে সেই নানুরেই!

বোমা উদ্ধার, খুচরো মারপিট, এলাকায় হুজ্জুতি তাই আর নতুন কোনও খবর নয় নানুরের কাছে। খবরের কাগজের শিরোনামে ‘নানুর’ দেখে চমকে যান না পড়শি গাঁ-ঘরের মানুষও। খোদ জেলা পুলিশের কাছেই, ‘লাশ না পড়লে’ নানুর এলাকার গোলমাল এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ ব্যাপার!

কেমন সে রোজের ঘটনা?

নজির মিলল সোমবার নানুর থানায়। সন্ধ্যা নামার একটু আগে বেজে উঠল থানার টেলিফোন। ডিউটি অফিসার রিসিভার তুলতেই ও প্রান্ত থেকে কীর্ণাহার ২ নং পঞ্চায়েত এলাকার এক সিভিক ভলান্টিয়ারের উদ্বেগ ঝরে পড়ল, ‘‘স্যার সরডাঙা-পশলা মাঠে ফের তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর বোমাবাজি শুরু হয়েছে।’’

ডিউটি অফিসার ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইলেন, ‘‘লাশ-টাশ কিছু পড়েছে নাকি?’’ ওপার থেকে উত্তর এল, ‘‘না স্যার, এখনও সেরকম কিছু ঘটেনি।’’

এপারের জবাব, ‘‘তাহলে তো মামুলি ব্যাপার। যেতে দে , বাড়াবাড়ি কিছু হলে জানাস!’’

কথাগুলো নিরাসক্ত গলায় বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন অফিসার। ওই ফোনেই এসেছিল ২০০০ সালে সুচপুরে ১১ জন তৃণমূল সমর্থক খুনের। ২০১০ সালে তৃণমূল নেতা সোনা চৌধুরী খুন কিংবা ২০১০ সালেই প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক আনন্দ দাস খুনের খবরও এসেছে ওই ফোন নম্বরেই। নানুরের পাপুড়ি, তাকোড়া, থুপসাড়া, নবোস্তা, রামকৃষ্ণপুর, বাসাপাড়ার নানা এলাকা থেকে বোমা উদ্ধার, বোমাবাজি, দোকান ভাঙচুর, এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে দুই গোষ্ঠীর কোন্দলের ঘটনা তাই নিতান্তই ‘মামুলি’ ব্যাপার বলেই মনে করেন নানুর থানার অধিকাংশ পুলিশ কর্মী। স্থানীয়রা দুষছেন এই পুলিশকেই। তাঁদের দাবি, ‘‘পুলিশ আরও সক্রিয় হলে, নানুরে শান্তি ফিরত।’’

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

অথচ নানুরের অন্য এক পরিচিতি রয়েছে। কবি চণ্ডীদাসের সাধনক্ষেত্র এই নানুর। সেই সুবাদে ওই জনপদকে একযোগে ‘চণ্ডীদাস-নানুর’ বলেই অভিহিত করেন অনেকে। কিন্তু সেই পরিচিতি ছাপিয়ে এখন সন্ত্রাসের আঁতুরঘর হিসাবেই পরিচিতি লাভ করেছে নানুর। বোমাবাজি প্রায় রোজকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা হয়, ‘‘বোমা বানানো নানুরের কুটির শিল্প।’’

ভোট মানেই কেন নানুর নির্বাচন কমিশনের কাছে ‘স্পর্শকাতর’ এলাকা, কেন বারবার খবরের কাগজে উঠে আসে তার নাম?

ভৌগোলিক অবস্থানই নানুরকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। নানুর এলাকাকে ছুঁয়ে বয়ে গিয়েছে অজয় নদ। অজয়ের অপর পাড়ে বর্ধমান। অন্য দিকে বর্ধমানের কেতুগ্রাম এবং মুর্শিদাবাদের বড়ঞা থানা এলাকার সঙ্গে মিশে রয়েছে নানুরের শেষপ্রান্ত। সেই হিসাবে নানুর অনেকটাই দুষ্কৃতীদের কাছে নিরাপদ রাস্তা হিসাবে বিবেচিত হয়। সেই বাম আমল থেকেই টাকা পয়সার পাশাপাশি লুঠের মাল এবং অস্ত্রশস্ত্রের চুক্তিতে এলাকা দখলের জন্য পড়শি দুই জেলা থেকে নানুরে দুষ্কৃতীদের ভাড়া করে এনেছেন রাজনৈতিক দলগুলি। আবার পুলিশি ধরপাকড় এড়াতে নানুরের দুষ্কৃতীরা নদী পেরিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন ওই দুই জেলায়। সেক্ষেত্রে বহিরাগত দুষ্কৃতীদেরও আত্মগোপনের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে নানুর। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। বরং গত বিধানসভা নির্বাচনের পর তা আরও সুদৃঢ হয়েছে। কারণ ওই নির্বাচনে কেতুগ্রামের বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন নানুরেরই পাপুড়ির বাসিন্দা তথা কাজল শেখের দাদা শেখ সাহানেওয়াজ। রাজনৈতিক মহলের মতে, ওই যোগসূত্রই সন্ত্রাসের পথ আরও সুগম করেছে। একসময় ওই পথকে কাজে লাগিয়ে অনুব্রত অনুগামীদের কোণঠাসা করেছিল কাজল-গদাধরের যৌথশক্তি। সেই শক্তি ভেঙে এখন কাজল অনুগামীদের সঙ্গে গদাধর অনুগামীদের সংঘাত তীব্রতর হচ্ছে।

এলাকার ঘটনাক্রম বলছে, অস্থিরতা সেই বাম আমল থেকেই। মূলত, ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করেই নানুরে রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘদিনের। বাম আমলে সিপিএমের সঙ্গে দাসকলগ্রাম-কড়েয়া ১ এবং ২ নং পঞ্চায়েত এলাকায় ফরওয়ার্ড ব্লক এবং জলুন্দি, বড়া-সাওতা, নওয়ানগর-কড্ডা প্রভৃতি পঞ্চায়েত এলাকায় আরএসপি’র সঙ্গে কোন্দলে বার বার তেতে উঠেছে। পরবর্তীকালে তৃণমূলের সঙ্গে সিপিএমের সংঘাতেও সেই একই ঘটনা ঘটেছে। ওইসব সংঘর্ষে খুন-জখমের পাশে কবেই গুরুত্ব হারিয়েছে বোমাবাজি কিংবা অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা।

জেলার রাজনীতির গতিপ্রকৃতির পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, নানুর এলাকার ক্ষমতা ধরে রাখার অন্যতম হাতিয়ার হল পঞ্চায়েত। পঞ্চায়েতের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের টাকা পরোক্ষে পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলেই এলাকার দখল কায়েম করে দেওয়ার লোক জুটে যায়। আর ওই সব লোকেরা হাতে থাকলে আরও অনেক কিছু হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ ঘটে। ‘আরও অনেক কিছু’র মধ্যে রয়েছে বাসাপাড়া বাজার এলাকা এবং বালিঘাটের দখল।

বাসাপাড়া বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে শতাধিক ধান–চালের আড়ত। ওইসব আড়তে হাজারখানেক মুটে-মজুর জড়িত রয়েছেন। নিজের লোকেদের সেখানে নিয়োগ করে রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির পাশাপাশি আড়তগুলি থেকে মোটা অঙ্কের তোলা আদায়ের জন্য সংঘাত বেধেছে বহুবার। লাগোয়া অজয় নদের বালির ঘাটের দখল নিয়েও কম রক্ত ঝরেনি। একসময় শরিকদের কিংবা তৃণমূলের সঙ্গে ওই সংঘাতে নাম জড়িয়েছে সিপিএমের। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর এলাকায় বামেরা কার্যত ধুয়ে মুছে গিয়েছে। তার পর পরই শাসকদলের বিধায়ক গদাধর গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজলের অনুগামীদের সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। সেই সংঘাত সমানে চলেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, বিধানসভা ভোটের মুখেও বেআব্রু কোন্দলে রাশ টানা না গেলে বিরূপ প্রভাব পড়বে ভোটবাক্সে। সে নিয়ন্ত্রণ কী ভাবে, প্রশ্ন সব মহলেই।

তৃণমূলের একটি সূত্রে খবর, গদাধরের টিকিট পাওয়া ঠেকাতে বহু দিন ধরেই সক্রিয় কাজল-গোষ্ঠী। কিন্তু, অনুব্রত-সহ জেলা তৃণমূলের বড় অংশ গদাধরকেই ফের নানুরে দাঁড় করাতে চান। এ মাসের গোড়ায় সিঙ্গি পঞ্চায়েতে জনসভা করে গদাধর-কাজলের নাম না করেই কাজলের এলাকা দখলে নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। পরিস্থিতি দেখে ঘর গোছাতে সক্রিয় হয়েছে কাজল শিবিরও। ফলে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘাতের মাত্রা বেড়েই চলেছে।

ঘটনা হল, নানুরের অধিকাংশ পঞ্চায়েত তো বটেই, বোলপুরের বাহিরী-পাঁচশোয়া, সিঙ্গি এবং সিয়ান-মুলুক পঞ্চায়েত বিধায়ক গদাধর হাজরাকে ব্রাত্য করে কর্তৃত্ব কায়েম করে কাজল। শুধু পঞ্চায়েতের নিয়ন্ত্রণ নয়, গদাধর অনুগামীরা লাগোয়া অজয় নদের বালির ঘাটের দখল হারাতে শুরু করেন। মাস কয়েক আগে, বাহিরী এলাকায় কাজলকে খুনের চেষ্টার অভিযোগে নাম জড়ায় গদাধর অনুগামীদের। তারপরে-পরেই পাল্টা হিসেবে তিন গদাধর অনুগামীকে খুনের অভিযোগে নাম জড়ায় কাজল-সহ তার অনুগামীদের। সম্প্রতি জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীর উপস্থিতিতে সিঙ্গি পঞ্চায়েত এলাকার এক সভায় গদাধর হাজরা কাজলের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিঙ্গি-সহ সব পঞ্চায়েত দখলে নেওয়ার হুমকি দেন। তার পর থেকেই এলাকা দখল নিয়ে টক্কর চলছে একেবারে সেয়ানে-সেয়ানে।

নানুর রয়েছে নানুরেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE