Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

পড়েই রইল ভাঙা বাড়ি, দেখা হল না বোনের বিয়ে

ওঁরা দু’জনেই দিনমজুরি করেন। এক জন স্বপ্ন দেখছিলেন, ছেলের উপার্জনের টাকায় টালির চালের জীর্ণ বাড়িটা নতুন করে গড়ার। আর এক জন, মেয়ের বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় করছিলেন।

মাকে সান্ত্বনা বিশ্বজিতের বড়দা রণজিতের। সোমবার সাগরের বাড়িতে। ছবি:শান্তশ্রী মজুমদার

মাকে সান্ত্বনা বিশ্বজিতের বড়দা রণজিতের। সোমবার সাগরের বাড়িতে। ছবি:শান্তশ্রী মজুমদার

নুরুল আবসার ও শান্তশ্রী মজুমদার
জগৎবল্লভপুর ও সাগর শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৩
Share: Save:

ওঁরা দু’জনেই দিনমজুরি করেন। এক জন স্বপ্ন দেখছিলেন, ছেলের উপার্জনের টাকায় টালির চালের জীর্ণ বাড়িটা নতুন করে গড়ার। আর এক জন, মেয়ের বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় করছিলেন। রবিবার ভোরে কাশ্মীরের উরি সেনাঘাঁটিতে জঙ্গি হানায় খানখান হয়ে গেল দু’জনের স্বপ্নই। উরির হামলায় শহিদ ১৮ জওয়ানের মধ্যে আছেন ওঁদের ছেলেরাও।

নিহতদের এক জন হাওড়ার জগৎবল্লভপুরের যমুনাবালিয়া গ্রামের গঙ্গাধর দলুই (২২)। অন্য জন দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগরের সূর্যবৃন্দা পাড়ার বিশ্বজিৎ ঘোড়ই (২২)। কর্মজীবন শুরুর দু’বছরের মাথাতেই চিরঘুমে চলে গেলেন দুই ‘সেপাই’।

রবিবার বিকেলেই দুই পরিবার ছেলেদের মৃত্যুসংবাদ পায়। তার পর থেকে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি কেউই। গঙ্গাধরের বাবা ওঙ্কারনাথবাবু বলেন, ‘‘অনেক কষ্ট করে ছেলেকে পড়াশোনা শিখিয়েছিলাম। এত দিন ওর বেতনের টাকা সেই ধারদেনা শোধ করতেই চলে গেল। সবে ভাবছিলাম, এ বার অবস্থা একটু ফিরবে।’’

টালির চালের দু’কামরার জীর্ণ বাড়িতে দুই ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। গঙ্গাধর বড়। ছোট বরুণ একাদশ শ্রেণির ছাত্র। গ্রামের অনেকেই সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। তাঁদের দেখাদেখি জগৎবল্লভপুর শোভারানি কলেজে বিএ প্রথম বর্ষে পড়তে পড়তেই সেনাবাহিনীতে পরীক্ষা দেন গঙ্গাধর। শিকে ছেঁড়ে। পড়া ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণের পরে তাঁর জায়গা হয় সেনাবাহিনীর বিহার রেজিমেন্টে। প্রথম পোস্টিং দানাপুর। তার পরে শিলিগুড়ি। ১৫ অগস্ট চলে যান উরি সেনাঘাঁটিতে। যেখানেই থাকুন, নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে ফোন করতেন গঙ্গাধর। শেষ ফোন করেছিলেন গত বৃহস্পতিবার। অনেক ক্ষণ কথা বলেছিলেন মা শিখাদেবীর সঙ্গে।

তরতাজা ছেলেটির মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সোমবার বাড়িতে ভিড় করে এসেছেন পড়শিরা। বারান্দায় বসে কপাল চাপড়াচ্ছিলেন মা, ‘‘আমাকে ও বলেছিল, বাবাকে আর দিনমজুরি করতে দেবে না। এই বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি করবে। ছ’মাস পরে ছুটি পেলে দু’মাস এসে থাকবে!’’ কিছুই হল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে এ দিন গঙ্গাধরের বাড়িতে গিয়ে সমবেদনা জানিয়ে আসেন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, শেষকৃত্য মিটলে দুই শহিদের পরিবারের পাশে কী ভাবে দাঁড়ানো যায়, সে বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী চিন্তাভাবনা করছেন।

শোকার্ত গঙ্গাধর দলুইয়ের মা। জগৎবল্লভপুরে। ছবি: সুব্রত জানা

সাগরের বিশ্বজিৎ অবশ্য ছোট থেকেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তিন বার পরীক্ষা দেওয়ার পরে তাঁর স্বপ্নপূরণ হয়। বছর দুয়েক আগে সাগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে প্রথম বর্ষে পড়ার সময়েই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। তাঁরও স্থান হয় বিহার রেজিমেন্টে। প্রথম পোস্টিং ছিল বিহারেই। গত জুলাইয়ে বাড়ি এসেছিলেন। এক মাস ছুটি কাটিয়ে ২১ অগস্ট বিহারে ফেরেন। দিন সতেরো আগে পোস্টিং হয় উরিতে।

তিন ভাইবোনের মধ্যে বিশ্বজিৎ মেজো। দাদা রণজিৎ স্থায়ী কোনও কাজ করেন না। বোন বুল্টি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। মূলত বিশ্বজিতের বেতনেই এত দিন সংসার চলছিল। রবিবার খবরটা ফোনে প্রথম জানতে পারেন বুল্টি। তিনি বড়দাকে সব বলেন। এ দিন সকলে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, বিশ্বজিতের ইচ্ছে ছিল ধুমধাম করে বোনের বিয়ে দেওয়ার। সে জন্য বাবা রবীন্দ্রনাথবাবুকে ভাল পাত্র দেখতেও বলেছিলেন। শোকের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথবাবু ছেলের জন্য গর্বিত। বললেন, ‘‘ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। সুযোগ থাকলে বড় ছেলেকেও সেনাবাহিনীতে পাঠাব।’’

আরও পড়ুন: আনন্দ উৎসব ফিরে এলো নতুন দুর্গা পূজা তথ্য নিয়ে

পুজোয় অন্য রকম গিফ্‌ট দিয়ে মন জিতে নিন

গর্বিত গোটা গঙ্গাসাগরই। এ দিন বিভিন্ন রাস্তার মোড় এবং টোটো-অটোর পিছনে বিশ্বজিতের ছবি দেখা গিয়েছে। দুপুরে বিশ্বজিতের বাড়িতে যান সাগরের বিধায়ক বঙ্কিম হাজরা। গঙ্গাসাগর পঞ্চায়েতের প্রধান হরিপদ মণ্ডল জানান, কপিলমুনির আশ্রমের সামনে বিশ্বজিতের স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির পরিকল্পনা করছেন তাঁরা।

এ দিন রাতে দুই শহিদের দেহ কলকাতায় এনে রাখা হয়েছে কমান্ড হাসপাতালের মর্গে। আজ, মঙ্গলবার সকালে গঙ্গাসাগরের শহিদ বিশ্বজিতের দেহ দমদম বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারে গঙ্গাসাগর পৌঁছে দেওয়া হবে। গঙ্গাধরের দেহ সড়কপথে নিয়ে যাওয়া হবে জগৎবল্লভপুরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE