Advertisement
১০ মে ২০২৪

আক্রান্ত উর্দি, তবু গুটিয়ে পুলিশ

দুবরাজপুরের টাউন ওসি অমিত চক্রবর্তীকে বোমা মারার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত তিনি। কিন্তু ৫৫ দিন ধরে চোখের সামনে ঘোরা সত্ত্বেও তৃণমূল নেতা তথা দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ শেখ আলিমকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। গত শনিবারেও তাঁকে দেখা গিয়েছে পঞ্চায়েত অফিসে। সোমবার থেকে তিনি অবশ্য বেপাত্তা।

শেখ আলিম

শেখ আলিম

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৪ ০৩:২৯
Share: Save:

দুবরাজপুরের টাউন ওসি অমিত চক্রবর্তীকে বোমা মারার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত তিনি। কিন্তু ৫৫ দিন ধরে চোখের সামনে ঘোরা সত্ত্বেও তৃণমূল নেতা তথা দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ শেখ আলিমকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। গত শনিবারেও তাঁকে দেখা গিয়েছে পঞ্চায়েত অফিসে। সোমবার থেকে তিনি অবশ্য বেপাত্তা।

গ্রামবাসীদের বক্তব্য, বোমার আঘাতে টাউন থানার ওসি অমিত চক্রবর্তীর মৃত্যুর খবর দুবরাজপুরে পৌঁছনোর পরেই গা ঢাকা দিয়েছেন আলিম। পুলিশের একাংশও ওই বক্তব্যে সায় দিয়েছে। যদিও বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেছেন, “আলিম পলাতক। আমরা তাঁকে খুঁজছি।” কিন্তু গ্রামের লোক তো বলছেন, দু’দিন আগেও ওই তৃণমূল নেতাকে অফিসে দেখেছেন? পুলিশ সুপারের জবাব, “এমন খবর আমার কাছে নেই।” এলাকাবাসীদের অভিযোগ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে পুলিশ এতটাই গুটিয়ে গিয়েছে যে, সহকর্মী আক্রান্ত হলেও ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস দেখাতে পারছে না তারা।

পুলিশ জানাচ্ছে, গত ৩ জুন দুবরাজপুরের যশপুর এলাকার গোপালপুরে একটি পুকুর সংস্কারকে কেন্দ্র করে সিপিএম এবং তৃণমূলের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। সেই গোলমাল থামাতে গিয়ে বোমার ঘায়ে গুরুতর জখম হন অমিতবাবু। তাঁকে দুর্গাপুরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে এ দিন সকালে তাঁর মৃত্যু হয়।

অমিতের উপরে বোমা মারার ঘটনায় তৃণমূল এবং সিপিএম একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ করেছিল। দুবরাজপুর থানার তৎকালীন ওসি ত্রিদিব প্রামাণিক দু’পক্ষের ৫০ জনের নামে এফআইআর দায়েরও করেন। তার ভিত্তিতে এ পর্যন্ত ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হলেও এফআইআরের একেবারে প্রথম নামটি যাঁর ছিল, সেই আলিম কিন্তু অধরাই! অথচ ওই তৃণমূল নেতাকে রোজ পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে দেখেছেন গ্রামবাসীরা। এমনকী, দলের নানা অনুষ্ঠানে তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি নজর এড়ায়নি পুলিশেরও। কিন্তু তাঁকে ধরা হয়নি। আর সোমবার, অমিতের মৃত্যুর দিন বেলা বাড়তেই এলাকাছাড়া আলিম।

এর পরেই প্রশ্ন উঠেছে, এফআইআরে নাম থাকা সত্ত্বেও পুলিশ এত দিন কেন ওই তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতার করেনি? পুলিশ নিজেই যখন শাসক দলের হাতে আক্রান্ত, তখনও কেন অন্যতম অভিযুক্তকে ধরার সাহস দেখাতে পারল না তারা, সেই প্রশ্নই এখন তুলছেন বিরোধীরা। পুলিশের নিচুতলার একাংশও এই অভিযোগ পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি। অনেকেই এই ঘটনার সঙ্গে মিল পেয়েছেন গত বছর গার্ডেনরিচে দুষ্কৃতীদের গুলিতে কলকাতা পুলিশের এসআই তাপস চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনার। সেই ঘটনায় অবশ্য অন্যতম অভিযুক্ত তৃণমূল কাউন্সিলর মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। কিন্তু এ বারে আলিম এখনও অধরা।

বিরোধীদের অভিযোগ, ওই জেলার তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের মুখে ‘পুলিশকে বোম মারুন’ শোনার পরেও তাঁর টিকি ছুঁতে পারেনি পুলিশ। লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম ‘পায়ের তল দিয়ে তিন ভাইকে মেরেছি’, বলে প্রকাশ্যে দাবি করার পরেও পুলিশ তাঁর নাম রাখেনি চার্জশিটে। সেই রীতিরই পুনরাবৃত্তি হয়েছে।

সহকর্মীর মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ হলেও নিচুতলার পুলিশকর্মীদের বক্তব্য, “আমরা সুশৃঙ্খল বাহিনীতে কাজ করি। তাই উপরতলার নির্দেশ ছাড়া কোনও পদক্ষেপ করতে পারি না।” জেলা পুলিশের এই ক্ষোভের কথা পৌঁছেছে নবান্নেও। তা নিয়ে এ দিন নিজেদের মধ্যে এক প্রস্ত আলোচনাও করেছেন রাজ্যের পুলিশকর্তারা।

পুলিশের এফআইআরে আলিমের নাম রাখাকে অবশ্য ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হিসেবেই দেখছেন স্থানীয় কিছু তৃণমূল নেতা। এমনকী, পুলিশকে বোমা মারার ঘটনায় তাঁরা জড়িত নন বলেও দাবি দুবরাজপুরের ব্লক সভাপতি ভোলানাথ মিশ্রের। তাঁর বক্তব্য, “একটা পুকুর কাটাকে কেন্দ্র করে যশপুরে উত্তেজনা ছিল। আমাদের লোকজনও সেখানে ছিল। কিন্তু আমরা পুলিশকে বোমা মারিনি।” তৃণমূলের অভিযোগ, গোপালপুরের সিপিএম নেতা সৈয়দ মুকতুল হোসেনের বাড়ি থেকে পুলিশকে বোমা ছোড়া হয়। পুলিশ জানাচ্ছে, গোলমালের পর থেকে মুকতুল এলাকাছাড়া। তাঁর মতো এলাকাছাড়া সিপিএমের অনেকেই।

জেলা সিপিএমের এক নেতা জানিয়েছেন, যেখানে গোলমাল হয়েছে সেই যশপুরে তাঁদের শক্তি নগণ্য। আলিম-ই ওখানে ‘শেষ কথা’। তাঁর দাপটেই সেখানকার ১৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসন ও তিনটি পঞ্চায়েত সমিতির আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি বিরোধীরা। ওই নেতার অভিযোগ, “অনুব্রত মণ্ডল পুলিশকে বোমা মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশই পালন করেছে আলিমরা।” সিপিএমের অভিযোগ শুনে অনুব্রত বলেছেন, “অমিত খুব ভাল ছেলে ছিলেন। সব কথা শুনতেন। আমার খুব স্নেহের পাত্র ছিলেন। তবে আমি জানি, এই গ্রাম্য বিবাদেও আমাকে টানা হবে। বলা হবে, কেষ্ট (অনুব্রতর ডাক নাম) মণ্ডলের জন্যই এ সব হয়েছে! কিন্তু এ ভাবে সব কিছুতে আমাকে জড়িয়ে দেওয়া ঠিক কি না, বিচার করে দেখুন।” অনুব্রতর বক্তব্য, সে দিনের ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই। পুকুরে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে কাকা ও ভাইপোর মধ্যে ঝামেলা। অমিত দুই গোষ্ঠীর মাঝে পড়ে বোমায় আহত হন। তাঁর কথায়, “নিয়তি ওঁকে টেনে নিল।”

অনুব্রত সব কিছুতে তাঁকে জড়িয়ে দেওয়ার অনুযোগ করলেও বোমার ঘায়ে পুলিশের মৃত্যুর পিছনে ওই তৃণমূল নেতারই উস্কানি দেখছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি বলেন, “বলতেই হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীর ‘কেষ্টা’ বলে এক জন আছেন, যিনি পুলিশকে বোমা মারতে বলেছিলেন! আর আছেন মনিরত্ন! সেখানে এমন ঘটনা তো ঘটবেই।”

বিরোধী দলনেতার আরও অভিযোগ, “এই সরকারের আমলে বিরাটিতে এক জন পুলিশকর্মী মারা গিয়েছেন। তার পরে গার্ডেনরিচ এবং দুবরাজপুর। মুখ্যমন্ত্রী অন্তত তাঁর পুলিশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন, এটুকু আশা করা যায়। কিন্তু এখানে মহিলা, সাধারণ নাগরিক থেকে পুলিশ কেউই নিরাপদ নন।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও বলেছেন, “তৃণমূলের নেতারাই তো পুলিশকে বোমা মারতে বলেছেন! দিদির স্নেহের ভাইদের দৌরাত্ম্যে পুলিশও নিরাপদ নয়!’’

আর বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের মন্তব্য, “তৃণমূলের নেতাই যদি পুলিশকে বোমা মারতে বলেন, এ ঘটনা বারবার ঘটবে। মস্তানদের হিম্মত বাড়বে। পুলিশের মনোবল কমবে।”

বিরোধীদের অভিযোগকে অবশ্য গুরুত্ব দেননি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। অনুব্রত-আলিমকে নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন করতেই মুকুলবাবু বলেন, “বারবার মনগড়া অভিযোগ করছে আনন্দবাজার। সব অভিযোগ মিথ্যে।” কিন্তু কংগ্রেস, বিজেপি, বাম সকলেই তো একই অভিযোগ করছে? মুকুলবাবু এ বারও বলেন, “বলছি তো, সব মিথ্যে অভিযোগ। এই অভিযোগ নিয়ে বিরোধীরা বাংলায় দু’দু’টো নির্বাচনে লড়েছে। একটি পঞ্চায়েত, অন্যটি লোকসভা। মানুষ দু’বারই রায় দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, অভিযোগ যথার্থ নয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amit chakrabartys death sekh alim
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE