Advertisement
১৮ মে ২০২৪

ঠান্ডা মাথার খুনি, ভাগ্যিস ছেলেকে মারেনি, বললেন আকাঙ্ক্ষার বাবা

মেয়ে খুন হয়েছে, সদ্য জানতে পেরেছেন। ছেলে যে রক্ষা পেয়েছে, সেটাই বিরাট ভাগ্য বলে মনে করছেন বাঁকুড়ার নিহত তরুণী আকাঙ্ক্ষা শর্মার বাবা-মা।ভোপালের যুবক উদয়ন দাস গত বছর পুজোর আগে দু’টি রাত বাঁকুড়ার রবীন্দ্র সরণিতে আকাঙ্ক্ষা বাড়িতে কাটিয়ে গিয়েছিল।

আকাঙ্ক্ষার বাবা-মা, বাঁকুড়ার বাড়িতে। রবিবার অভিজিৎ সিংহের তোলা ছবি।

আকাঙ্ক্ষার বাবা-মা, বাঁকুড়ার বাড়িতে। রবিবার অভিজিৎ সিংহের তোলা ছবি।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০২:৪৩
Share: Save:

মেয়ে খুন হয়েছে, সদ্য জানতে পেরেছেন। ছেলে যে রক্ষা পেয়েছে, সেটাই বিরাট ভাগ্য বলে মনে করছেন বাঁকুড়ার নিহত তরুণী আকাঙ্ক্ষা শর্মার বাবা-মা।

ভোপালের যুবক উদয়ন দাস গত বছর পুজোর আগে দু’টি রাত বাঁকুড়ার রবীন্দ্র সরণিতে আকাঙ্ক্ষা বাড়িতে কাটিয়ে গিয়েছিল। এবং নিজের আসার কথা ওই যুবক আকাঙ্ক্ষারই মোবাইল থেকে জানিয়েছিল। যাতে মনে হয়, আকাঙ্ক্ষা ওই মেসেজ করেছেন। দু’রাত সে শুয়েছিল আকাঙ্ক্ষার দাদা আয়ুষের সঙ্গে এক ঘরে। সে কথা ভেবেই এখন ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন নিহত তরুণীর বাবা শিবেন্দ্র শর্মা। রবিবার দুপুরে নিজের বাড়িতে বসে কপালে হাত ঠেকিয়ে আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘ভাবলে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে!’’

আকাঙ্ক্ষাকে যে খুন করে সাকেতনগরের বাড়িতে পুঁতে দিয়েছে উদয়ন, বৃহস্পতিবার রাতে সে কথা জানতে পারেন এই দম্পতি। তার পর থেকেই ঘরের দরজা বন্ধ করে বাড়িতে বসেছিলেন তাঁরা। প্রতিবেশীদের জন্যও এমনকী, সেই দরজা সামান্য ফাঁক হয়নি গত ৪৮ ঘণ্টায়। শেষে অনেক অনুরোধের পরে রবিবার মুখ খোলেন তাঁরা। বাঁকুড়ার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চিফ ম্যানেজার শিবেন্দ্রবাবু বলেন, ‘‘উদয়ন বলেছিল, আমেরিকায় সে আকাঙ্ক্ষার সহকর্মী। এই পরিচয় দিয়েই আমাদের বাড়িতে ঢুকেছিল সে।’’ এ বারে যখন জানতে পারেন, সে-ই ছেলেটিই তাঁদের মেয়েকে খুন করেছে, তখন অবাক হয়েছিলেন। বললেন, ‘‘এখন তো দেখছি সে কয়েক বছর আগে নিজের বাবা-মা’কেও খুন করেছে!’’ তার পরেই মন্তব্য, ‘‘উদয়ন আমার একমাত্র ছেলে আয়ুষের সঙ্গে দুই রাত এক বিছানায় কাটিয়েছে, ভেবেই শিউরে উঠছি। ও তো ঠান্ডা মাথার খুনি!’’

বাঁকুড়ায় কেন এসেছিল উদয়ন?

দোতলা ভাড়াবাড়ির প্রায়ান্ধকার একটা ঘরের কোণে জড়োসড়ো হয়ে খাটে বসেছিলেন পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই শিবেন্দ্রবাবু। পরনে ফুলহাতা সোয়েটার। গালে দু-তিন দিনের না-কাটা কাঁচা-পাকা দাড়ি। চোখ-মুখ বসে গিয়েছে। পাশে ছিলেন তাঁর শ্যালক রাজেশ সিংহ ও পারিবারিক বন্ধু, বাঁকুড়া পুলিশ হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার প্রবীরকুমার চক্রবর্তী। যা কথা বলার শিবেন্দ্রবাবুই বলছিলেন। পাশের ঘরে বিছানায় মেয়ের ছেলেবেলার ছবি আঁকড়ে শুয়েছিলেন আকাঙ্ক্ষার মা শশীবালা। কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়েছেন তিনি। শিবেন্দ্রবাবু পাশে গিয়ে বসতে এক বার শুধু বললেন, ‘‘যা-ই হয়ে যাক, আমার মেয়েটা তো আর কোনও ভাবে আমাদের কাছে ফিরে আসবে না!’’

আদতে পটনার বাসিন্দা শিবেন্দ্রবাবু হিন্দিতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলছিলেন, ‘‘আকাঙ্ক্ষাকে মেরে মনে হয়, আমাদের সবাইকে খুন করতেই ছেলেটা বাঁকুড়া এসেছিল। শেষে হয়তো সেই সুযোগ পায়নি।’’ তাঁর ধারণা, তাঁদের মেরে চলে গেলে কাকপক্ষীতেও টের পেত না। কারণ, উদয়ন যে তাঁদের বাড়িতে এসেছে, তা আশপাশের কেউই জানতেন না।

শিবেন্দ্রবাবু জানান, রাজস্থানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পাশ করে আকাঙ্ক্ষা জুন মাসে বাড়ি ছাড়েন। যাওয়ার আগে বাবাকে জানিয়েছিলেন, আমেরিকায় যাচ্ছেন। ইউনিসেফে চাকরির নিয়োগপত্রও তিনি বাবাকে দেখিয়েছিলেন। শিবেন্দ্রবাবুর কথায়, ‘‘নিয়োগপত্রে বেতনের উল্লেখ না থাকায় প্রথমটায় বেশ খটকা লেগেছিল। প্রশ্নের উত্তরে মেয়ে তখন বলেছিল, আমেরিকায় গেলেই বেতন ঠিক হয়ে যাবে। এখন মনে হচ্ছে, ওই চিঠিটা পুরোপুরি জাল। উদয়নই হয়তো তৈরি করে দিয়েছিল।’’ মেয়ের কথা সরল মনেই বিশ্বাস করেছিলেন তিনি।

বাঁকুড়া ছাড়ার কয়েক দিন পরে আকাঙ্ক্ষা ফোন করে বাড়িতে জানান, আমেরিকায় পৌঁছে গিয়েছেন। এর পর থেকে তিনি শুধু হোয়্যাটসঅ্যাপেই যোগাযোগ রাখছিলেন। জানিয়েছিলেন, আমেরিকার নতুন সিম কার্ড পেলে তখন বাড়ির সঙ্গে কথা বলবেন।

শিবেন্দ্রবাবু বলেন, ‘‘পুজোর কিছু আগে আকাঙ্ক্ষার মোবাইল থেকে মেসেজ আসে, উদয়ন বাঁকুড়ায় আসছে।
বছরখানেক আগেই অবশ্য উদয়নের নাম মেয়ের কাছে শুনেছিলাম।’’ তিনি জানান, উদয়নকে দেখে তাঁদের কোনও রকম সন্দেহ জাগেনি। ইংরেজি, হিন্দি তো বটেই, তার বাংলাও বেশ ঝরঝরে। উদয়ন বলে, আকাঙ্ক্ষার মা, বাবা এবং দাদাকেও আমেরিকায় নিয়ে যাবে। সে ভিসার ব্যবস্থা করে দিল্লিতে অপেক্ষা করবে। সে কথায় বিশ্বাস করে পুজোর পরে শর্মা দম্পতি দিল্লি যান। কিন্তু সেখানে তার দেখা মেলেনি। ফোনও ধরেনি।

সেই থেকে শুরু হয় সন্দেহ। শিবেন্দ্রবাবু সে কথা জানান পুলিশ হাসপাতালের চিকিৎসক প্রবীরবাবুকে। তিনিই ডিসেম্বরের গোড়ায় শিবেন্দ্রকে পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরার কাছে নিয়ে যান। ৫ ডিসেম্বর আকাঙ্ক্ষার নামে নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়। এর পর পুলিশ তদন্তে নেমে আকাঙ্ক্ষার মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন পায় ভোপালের সাকেতনগরে। সেখানে উদয়নের ডেরায় পুজোর বেদি খুঁড়ে মেলে নরকঙ্কাল। উদয়নের কথায়, এ-ই আকাঙ্ক্ষা।

প্রবীরবাবু এ দিন বলেন, ‘‘শিবেন্দ্রবাবুকে আশ্বাস দিয়েছিলাম, পুলিশ দরকার হলে মাটির তলা থেকেও আপনার মেয়েকে খুঁজে নিয়ে আসবে। কিন্তু মাটির নীচেই যে আকাঙ্ক্ষার দেহ পুঁতে রাখা হয়েছে, ভাবতে পারিনি!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Udayan Das Bhopal Murder Case
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE