Advertisement
১৮ মে ২০২৪

ছাত্র হস্টেলে জোড়া তরুণী নিয়ে মদ-চক্র

মাস চারেক আগে মদের বোতল নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকায় ১০ জন পড়ুয়াকে সেমেস্টার থেকে সাসপেন্ড, হস্টেল থেকে বহিষ্কারের মতো শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত হয়েছিল শিবপুরের আইআইইএসটি। তার পরেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কী ভাবে মদ-মাদকে ভেসে যায়, উঠছিল প্রশ্ন।

সৌভিক চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:১১
Share: Save:

মাস চারেক আগে মদের বোতল নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকায় ১০ জন পড়ুয়াকে সেমেস্টার থেকে সাসপেন্ড, হস্টেল থেকে বহিষ্কারের মতো শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত হয়েছিল শিবপুরের আইআইইএসটি। তার পরেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কী ভাবে মদ-মাদকে ভেসে যায়, উঠছিল প্রশ্ন।

এ বার ভেসে যাওয়ার সেই প্রবণতায় প্রায় সকলকেই ছাপিয়ে গেল ঐতিহ্যবাহী প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়। ওই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে রাত কাটালেন দুই বহিরাগত তরুণী ছাত্রী। এবং তাঁদের নিয়েই হস্টেলের মধ্যে চলল অবাধ মদ্যপান। ওই দুই তরুণীর মধ্যে এক জন যাদবপুরের প্রাক্তনী!

এই ঘটনার কথা জানাজানি হওয়ার পরেই হইচই শুরু হয়েছে প্রেসিডেন্সির অন্দরে। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে একটি ‘ডিসিপ্লিনারি কমিটি’ বা শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি গড়ে পুরো ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ।

প্রেসিডেন্সির পাঁচ পড়ুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সম্প্রতি তাঁরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন ছাত্রী এবং স্কটিশ চার্চ কলেজের এক ছাত্রীকে নিয়ে রাতে হস্টেলে ঢুকেছিলেন। তার পরে হস্টেলের ক্যাম্পাসের ভিতরেই নেশা এবং নানাবিধ অশালীন কাজকর্ম করেন। হস্টেলের আবাসিকদের একাংশ প্রতিবাদ করায় তাঁদের সঙ্গে বচসা বাধে ওঁদের। শেষে নিউ টাউন থানার পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই পাঁচ পড়ুয়ার মধ্যে এক জন ওই হস্টেলেরই আবাসিক।

ঐতিহ্যবাহী প্রেসিডেন্সির বেশ কিছু ঘটনা চিন্তায় ফেলেছে শিক্ষাজগৎকে। সম্প্রতি ঘেরাওয়ের নামে উপাচার্যের ঘরে ঢুকে কার্যত তাণ্ডব চালিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সির কিছু পড়ুয়া। উপাচার্যের ঘরেই চলেছিল ক্যানেস্তারা বাজানো, ধূমপান, এমনকী অশালীন আচরণও। সেই ঘটনায় আরও কালি ছিটিয়েছিল মহিলাদের অন্তর্বাস পরিহিত এক বহিরাগত তরুণের উপস্থিতি। এ বার বহিরাগতেরা হস্টেলে ঢুকে প্রকাশ্যে মদ্যপান করায় আরও এক বার প্রেসিডেন্সির মুখ পুড়ল বলেই মনে করছেন শিক্ষা শিবিরের একাংশ।

প্রেসিডেন্সির হস্টেল দু’টি। মেয়েদের হস্টেলটি বিধাননগরে। ছেলেরা এত দিন থাকতেন হিন্দু হস্টেলে। মাস ছয়েক আগে শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িটির সংস্কারের প্রয়োজনে আবাসিকদের রাজারহাটের এক নম্বর অ্যাকশন এরিয়ায় হিডকোর একটি আবাসনে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনাটি ঘটেছে সেখানেই।

কী ঘটেছিল সে-দিন?

হস্টেলের আবাসিকেরা জানাচ্ছেন, ৪ ডিসেম্বর রাত ১০টা নাগাদ এক আবাসিক প্রেসিডেন্সির অন্য চার পড়ুয়া এবং দুই তরুণীকে নিয়ে হস্টেলে ঢোকেন। অন্য আবাসিকেরা তৎক্ষণাৎ তাঁদের চলে যেতে বলেন। সে-কথায় কান না-দিয়ে তাঁরা হস্টেলের করিডরে এবং মাঠে বসে গভীর রাত পর্যন্ত প্রায় অর্ধনগ্ন অবস্থায় মদ্যপান চালিয়ে যান। সঙ্গে সমানে চলতে থাকে হইহল্লা এবং অশালীন আচরণ। কয়েক জন আবাসিক সেই ঘটনার প্রতিবাদ করলে ওই সাত জন মারমুখী হয়ে ওঠেন। পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে হস্টেলেরই কিছু আবাসিক নিউ টাউন থানায় ফোন করেন। পুলিশ এসে অবস্থা সামাল দেয়। ইতিমধ্যে অত্যন্ত বেশি মদ্যপানের জেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন দুই ছাত্রী। হস্টেলের আবাসিকেরাই তাঁদের শুশ্রূষা করে পরের দিন সকালে বাড়ি পৌঁছে দেন।

এই ঘটনা নিয়ে কোনও পক্ষ পুলিশের কাছে লিখিত ভাবে অভিযোগ দায়ের করেনি। তবে আবাসিকদের অভিযোগের ভিত্তিতে ‘ডিসিপ্লিনারি কমিটি’ বসান বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ।

হস্টেলের আবাসিকদের একাংশের অভিযোগ, রাজারহাটের নতুন হস্টেলে আসার পর থেকেই আবাসিকদের মধ্যে নেশার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। এক আবাসিকের কথায়, ‘‘হিন্দু হস্টেলেও ছেলেরা কমবেশি নেশা করত। কিন্তু এখানে কিছু কিছু ঘরে তল্লাশি চালালে এত গাঁজা আর চরস পাওয়া যাবে যে, আবগারি দফতর চমকে যেতে পারে।’’

এই অবস্থা হল কেন?

আবাসিকদের একাংশের মতে, এর জন্য হস্টেলের পরিবেশই কিছুটা দায়ী। হিন্দু হস্টেলের পরিবেশ ছিল অনেক জমজমাট। বড় বড় ঘর, টানা বারান্দা এবং সেখানে দেদার আড্ডা। সব মিলিয়ে একটা যৌথ জীবনের পরিবেশ। হস্টেলের উল্টো দিকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। ফলে কলেজ এবং হস্টেলের মধ্যে একটি নিয়মিত মানসিক এবং সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ছিল। কিন্তু রাজারহাটের হস্টেলে সব এক কামরার ঘর। হস্টেল-চত্বরটিও বড়ই নির্জন। পড়াশোনা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করার নেই এখানে। হিন্দু হস্টেলের মতো নিত্য পারস্পরিক আদানপ্রদানের সুযোগ নেই। আর সেই নিঃসঙ্গতা থেকেই হয়তো নেশার প্রবণতা বৃদ্ধি।

ব্যাখ্যা যা-ই হোক, পড়ুয়াদের এমন আচরণ সমর্থন করছেন না ছাত্র থেকে শিক্ষক কেউই। হস্টেল সুপার প্রবেশ তামাঙ্গ বলেন, ‘‘ওরা যা করেছে, তা একেবারেই নিয়মবিরুদ্ধ। এ ধরনের কাজকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। ওদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ এই ধরনের কাজ কোনও ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধি নভোজিৎ দে-ও তিনি বলেন, ‘‘ওদের শাস্তি হওয়া উচিত। ডিসিপ্লিনারি কমিটির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাব।’’

এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে হস্টেলের নিরাপত্তা নিয়ে। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও এত জন বহিরাগত কী ভাবে হস্টেলের ভিতরে ঢুকলেন? নিরাপত্তারক্ষীদের নজর এড়িয়ে কী ভাবেই বা তাঁরা প্রকাশ্যে মদ্যপান চালিয়ে গেলেন?

কর্তৃপক্ষের তরফে এর সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তবে এটাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে রেজিস্ট্রার দেবজ্যোতি কোনার বলেন, ‘‘খবর পাওয়া মাত্রই ওই পাঁচ পড়ুয়ার বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি কমিটি বসানো হয়েছে। সেই কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE