পুত্রহারা। দেবাশিসের শোকার্ত মা। ইনসেটে, দেবাশিস ভৌমিক। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
নিয়মিত মদের আড্ডায় বসত ওরা। মদ কেনার টাকা নিয়েই মৃদু খটাখটি। হঠাৎ আঁতে লেগে যাওয়া। তার পরেই খুনের পরিকল্পনা।
১৫-১৭ বছরের তিন কিশোর, পাড়ার লোকে যাদের হরিহর আত্মা বলে জানত— তাদের মধ্যে খুন হয়ে গেল এক জন। ১৫ বছরের দেবাশিস ভৌমিক। খুনের অভিযোগ উঠল অন্য দুই বন্ধুর নামেই। পুলিশের দাবি, জেরায় দুই কিশোর কবুল করেছে, ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করেই খুন। খুনের আগেও একপ্রস্ত মদ্যপান। তার পর সেই মদের বোতল দিয়েই বন্ধুর মাথায় আঘাত।
কৃষ্ণনগরে বৃহস্পতিবারের এই ঘটনায় শনিবার রাতে দুই কিশোর গ্রেফতার হয়। রবিবার কৃষ্ণনগর জুভেনাইল আদালতে তোলা হলে বিচারক তাদের এক দিন হোমে রাখার নির্দেশ দেন। আজ, সোমবার ফের তাদের আদালতে আনা হবে।
দেশ জুড়ে নাবালক-নাবালিকাদের মধ্যে নৃশংস অপরাধপ্রবণতা যে ভয়াবহ হারে বাড়ছে, সংবাদমাধ্যম প্রায় রোজই তার সাক্ষী। কিন্তু কৃষ্ণনগরের হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দিল, এখনকার কৈশোর শুধু অপরাধপ্রবণ নয়, নেশায় চুরও। মদ খাওয়া নিয়ে বচসা, মারামারি, খুনখারাপির চেনা ছবিটা আর শুধু প্রাপ্তবয়স্কের পৃথিবীতে সীমাবদ্ধ নেই।
আরও পড়ুন।
কালীঘাটে দম্পতিকে কোপানোয় অভিযুক্তের দেহ উদ্ধার হাওড়ায়
গত বছর স্কুলপড়ুয়া আবেশ দাশগুপ্তর মৃত্যুর ঘটনায় শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারে কমবয়সীদের মধ্যে নেশার বাড়বৃদ্ধি এবং উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের প্রশ্নটি আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছিল। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি নিয়ে দাপাদাপি একাধিক বার দেখেছে কলকাতা-সহ গোটা দেশ। কিন্তু মফস্সল শহরের মধ্যবিত্ত কৈশোরেও নেশা কতটা জাঁকিয়ে বসেছে, দেখাল কৃষ্ণনগর। সেই সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে গেল, নাবালকদের কাছে মদ বিক্রি রুখতে যে নজরদারি-কড়াকড়ি শুরু হয়েছিল আবেশের ঘটনার পরে, তাতে ফল হয়েছে সামান্যই। কৃষ্ণনগরে কী ভাবে ওই তিন বন্ধু নিয়মিত মদ জোগাড় করত, সেটা নিয়ে এখন ভাবতে বসেছে পুলিশ।
দেবাশিসের সঙ্গে দুই বন্ধুর মনোমালিন্যের অনেকটাই মদকে ঘিরে। জেলার পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া বলেন, ‘‘প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছি, মদের আসরে টাকাপয়সার প্রশ্ন নিয়েই খুন। আরও কিছু জড়িত কি না দেখা হচ্ছে।’’
নিহত দেবাশিস ও তার দুই বন্ধু কৃষ্ণনগরেরই বাসিন্দা। ধৃত প্রথম জনের বয়স সতেরো। নবম শ্রেণিতে অনুত্তীর্ণ হওয়ার পরে গত বছর লেখাপড়ায় ইতি টানে। বাবা ছেলেকে ফটোকপি ও মোবাইলের দোকান করে দেন। তার তুলনায় দেবাশিস এবং অন্য বন্ধুটির বাড়ির অবস্থা কমজোরি। তারা শহরের দু’টি আলাদা স্কুলে নবম শ্রেণির পড়ুয়া। এ বছর কেউই পাশ করতে পারেনি।
ধৃতদের জেরা করে পুলিশ জেনেছে, মাঝেমধ্যেই তিন জন নবদ্বীপ রোড লাগোয়া দিঘির পাড়ে মদ খেত। দিন কয়েক আগে মদ কেনার টাকা কম পড়ায় দেবাশিসের কাছে দেড়শো টাকা ধার নেয় প্রথম জন। কয়েক দিন কেটে যাওয়ার পরেও টাকা শোধ করেনি। এক দিন অন্য সকলের সামনেই দেবাশিস টাকাটা চেয়ে বসায় আঁতে লেগে যায় তার। তা ছাড়া বেশ কিছু দিন থেকে দেবাশিস তাকে তেমন ‘পাত্তা’ দিচ্ছিল না বলে চটেই ছিল সে।
দেবাশিসকে ‘চরম শিক্ষা’ দেওয়ার পরিকল্পনা তখনই শুরু। মোবাইলের টোপ দিতে দ্বিতীয় বন্ধুও রাজি। ১ ফেব্রুয়ারি, সরস্বতী পুজোর দিন দিঘির পাড়ের জঙ্গলে দু’জনে গর্ত খোঁড়ে। তার পর গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দেবাশিসকে সেখানে ডেকে নিয়ে গিয়ে তিন জনেই মদ খায়। দেবাশিসকে বেশি মদ খাইয়ে দিয়ে প্রথমে এক জন তার মাথায় মদের বোতল দিয়ে মারে। তার পর গলায় হাঁটু দিয়ে চেপে শ্বাসরোধ করে সেই গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেয়। উপরে বিছিয়ে দেয় শুকনো ডালপালা।
দেবাশিস সন্ধের পরেও না ফেরায় বাড়ির লোকজন তাকে খুঁজতে শুরু করেন। তাঁরা জানতে পারেন, দুই বন্ধুর সঙ্গে দেবাশিসকে দেখা গিয়েছে। তখন দু’জন জানায়, তারা হেলিপ্যাডের মাঠে একসঙ্গে বসে এগরোল খেয়েছে। তার পর তারা চলে এলেও দেবাশিস থেকে গিয়েছিল। শুক্রবার থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করে দেবাশিসের পরিবার। দুই বন্ধুর সঙ্গে ফের কথা বলার পরে সন্দেহ বাড়ে তাঁদের।
শুক্রবার বিকেলে পুলিশও দু’জনকে ডেকে পাঠায়। সন্দেহজনক কিছু খুঁজে না পেয়ে ছেড়েও দেওয়া হয়। শনিবার বিকেলে নির্জন দিঘির পাড়ে দেবাশিসের সাইকেলটি খুঁজে পান এলাকার লোকজন। তখন ফের ওই দু’জনকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। টানা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ম্যারাথন জেরার পরে সব কথা কবুল করে দু’জনে।
পরিবার এবং এলাকাবাসীরা হতবাক, দুই কিশোরের আপাত স্বাভাবিক আচরণ দেখে। এক জনের মা বলছেন, ‘‘ছেলেটা ক’দিন ধরেই একটা মোবাইলের জন্য বায়না করছিল ঠিকই। কিন্তু ও যদি কাউকে খুনই করে তা হলে কি এত স্বাভাবিক থাকতে পারে? বাড়ি ফিরে চা করে আমাদের দিল, নিজে খেল। রাতে ঘুমিয়ে পরের দিন স্কুলে গেল।’’ মায়ের বিশ্বাস, তাঁর ছেলেকে ফাঁসানো হচ্ছে। দুই কিশোরের স্নায়ুর জোর দেখে অবাক দুঁদে পুলিশ কর্তারাও। জেলা পুলিশের এক জনের কথায়, ‘‘বিশ বছরের চাকরি জীবনে এমন এই প্রথম দেখছি। বয়স ওদের আঠেরোর নীচে ঠিকই। কিন্তু ওদের মদের নেশা, খুনের পরিকল্পনা, মাথা ঠান্ডা রাখার ক্ষমতা দাগি অপরাধীদের হার মানায়।’’
মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিদরাও ঘটনাটিকে শুধু একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ হিসেবে না দেখে সমাজজীবনে ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন এবং উচ্ছৃঙ্খলতা এবং কিশোর-মনে তার প্রতিফলন বলেই মনে করছেন। সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায় জানান, ‘‘এটা একটা অস্থির সময়। চারপাশে এমন অনেক কিছু হচ্ছে যা মানসিক গঠনের জন্য ঠিক নয়। রাগকে কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সেটা শেখানো যাচ্ছে না।’’ মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম মনে করাচ্ছেন, নেশা না করলে বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারব না, সবাই বোকা বলবে এমন সব ভাবনা থেকেই অল্পবয়সীরা মদ খাওয়া শুরু করে। কিন্তু সকলেই ইদানীং নজর করছেন যে, বিযয়টা আর নিছক কৈশোরের অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয়তার মধ্যে আটকে থাকছে না। কখনও নেশা, কখনও যৌনতা, কখনও মোবাইলের লোভ, কখনও ইন্টারনেটে নানা হাতছানিকে কেন্দ্র করে ঘটে যাচ্ছে ভয়াবহ সব অপরাধ।
দেবাশিসের বাবা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন পাঁচ বছর আগে। মা ঝিমলিদেবী একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে আয়ার কাজ করেন। তাঁর অভিযোগ, ‘‘ওদের (ধৃত) এক জনের জামাইবাবু বাড়িতে এসে আমায় শাসিয়ে গিয়েছে। আমার ছেলের খুনিরা শাস্তি পাবে তো?’’ দেবাশিসের পরিবারের কাউকে না জানিয়েই পুলিশ দেহ উদ্ধার করায় ক্ষুব্ধ এলাকার লোকজনের একাংশও। কৃষ্ণনগর রোড স্টেশন এলাকায় এ দিন প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা নবদ্বীপ-বর্ধমান রাজ্য সড়ক অবরোধ
করেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy