Advertisement
০৭ মে ২০২৪

সংস্কৃতি চর্চায় অনন্য ভূমিকা ছিল সেন-র‌্যালে সংস্থার

স্বাধীনতার পরে শিল্প স্থাপনের মধ্য দিয়ে দেশ গঠনের যে উদ্দীপনা, সেই উদ্দীপনারই এক উজ্জ্বল অভিজ্ঞান আসানসোলের সেন-র‌্যালের সাইকেল কারখানা।

সেন-র‌্যালের কারখানা আজ খণ্ডহর। ছবি: শৈলেন সরকার

সেন-র‌্যালের কারখানা আজ খণ্ডহর। ছবি: শৈলেন সরকার

অরুণাভ সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:১৩
Share: Save:

স্বাধীনতার পরে শিল্প স্থাপনের মধ্য দিয়ে দেশ গঠনের যে উদ্দীপনা, সেই উদ্দীপনারই এক উজ্জ্বল অভিজ্ঞান আসানসোলের সেন-র‌্যালের সাইকেল কারখানা। বিলেতের র‌্যালে কারখানার সহযোগিতায় শিল্পোদ্যোগী সুবীর সেন এবং পরে তাঁর পুত্র অভিজিৎ ও সঞ্জয় সেনের উদ্যোগে এশিয়ার বৃহত্তম ও অন্যতম প্রাচীন এক সাইকেল নির্মাণের কারখানা হিসাবে এটি গড়ে ওঠে। ১৯৫১ সালে কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়। সাড়ে চার হাজারের মতো কর্মী কাজ করেছেন এখানে। এই কারখানায় উৎপাদিত ‘র‌্যালে’, ‘রবিনহুড’, ‘হাম্বার’ ইত্যাদি নামের সাইকেল বাঙালি তথা ভারতীয়দের জীবনযাপনের অঙ্গ হয়ে উঠতে পেরেছিল। সাইকেল রফতানি হতো বাংলাদেশ বা দক্ষিণ আফ্রিকাতেও।

প্রথমে কিছু যন্ত্রাংশ বিলেত, জার্মানি থেকে এলেও পরে সাইকেলের প্রায় প্রতিটি যন্ত্রাংশ তৈরি হতো এখানেই। অতএব গড়ে উঠেছিল চেন, প্যাডেল, হ্যান্ডেলবার, ব্যারেলিং-সহ অনেক অনেক বিভাগ বা ডিপার্টমেন্ট। সঙ্গে ক্যান্টিন, গ্যারাজ, স্পোর্টস, মেনটেনেন্স, আভিজাত্যমণ্ডিত জেনারেল অফিস ইত্যাদি নিয়ে এক বিশাল এলাকা জুড়ে যেন ময়দানবের শিল্পকীর্তি। কারখানার গেটের সামনে ছিল রেল সাইডিং, যেখান থেকে কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের মালগাড়িতে পরিবহণের ব্যবস্থা ছিল।

কারখানা ও রেললাইনের অন্য পাশে অফিসার্স কলোনি। গাছের ছায়া মাখানো রাস্তার দু’পাশে সাজানো বাংলো, কোয়ার্টার্স, বিরল উদ্ভিদের সমাহার নিয়ে সিএমডি-বাংলো, অফিসার্স হস্টেল, বনেদি অফিসার্স ক্লাব ইত্যাদি। পুরো জায়গাটিতে ছড়ানো ছিল আভিজাত্য। আর কাছেই ছিল অ্যাথলেটিক ক্লাব—কারখানার কর্মীদের পরিচালনায় বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে তা ছিল সব সময় প্রাণময়তায় ঋদ্ধ।

সেন-র‌্যালের উপনগরীটির প্রধান অংশ তথা ওয়ার্কার্স কলোনিটি তৈরি হয়েছিল কোম্পানির জমিতে, ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল হাউসিং বোর্ড’-এর উদ্যোগে। সেটি ঘাসের মখমলে মোড়া খেলার মাঠ আর গাছগাছালির সবুজে ডুবে থাকা এক প্রাণিত জনপদ, যেখানে নেই বহুতলের অমার্জিত অনুপ্রবেশ। কারখানার কর্মীরা বেশিরভাগই ছিলেন বাঙালি, যাঁরা এসেছিলেন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। তাঁরা তাঁদের রুচি, সহবত ও সংস্কৃতি দিয়ে ঋদ্ধ করেছিলেন এই শিল্পাঞ্চলের সংস্কৃতিগত অবস্থানটিকে।

আসানসোলে খেলাধুলো, সংস্কৃতিচর্চায় সেন-র‌্যালে অ্যাথলেটিক ক্লাবটির ভূমিকা ছিল অনন্য। এই ক্লাবের অনেক খেলোয়াড়ই ছিলেন বর্ধমান জেলা দলের খেলোয়াড়। ফুটবলে ডিস্ট্রিক্ট কাপের আয়োজন, বহু প্রতিযোগিতা জয়ের শিরোপা, সর্বভারতীয় স্তরে সাফল্যের মতো বহু গৌরবের পালক রয়েছে তার মুকুটে।

অ্যাথলেটিক ক্লাব শুরুতে খেলাধুলোপ্রধান হলেও পরে গ্রন্থাগার স্থাপন, নাট্য আন্দোলনে যোগ দেয়। গড়ে ওঠে সেন-র‌্যালে কালচারাল ইউনিট। আসানসোল শিল্পাঞ্চলে এখানেই প্রথম নারী চরিত্রে পুরুষের পরিবর্তে অভিনয় করেন নারীরাই—কর্মীদের পরিবারের মহিলারা। অ্যাথলেটিক ক্লাবের মঞ্চেই হতো কারখানার আন্তঃবিভাগীয় একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা, যেখানে বিভিন্ন বিভাগ নিজস্ব নাট্যদল তৈরি করে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করত। বুদ্ধিদীপ্ত উদ্ভাবনী পরিচয় দিয়ে অপূর্ব শিল্পসুষমায় মঞ্চ তৈরি করতেন কারখানার কর্মীরাই। একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার পক্ষে এক অনন্য প্রয়াস বইকি! অতিথি হিসাবে এসেছেন বহু ব্যক্তিত্ত্ব—বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, তাপস সেন, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। সেন-র‌্যালের ক্রমবর্ধমান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সামাল দেওয়ার জন্য কলোনির বি-ব্লকেও রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে গড়ে ওঠে আর একটি মঞ্চ।

এর পরে কারখানাটি ক্রমশ রুগ‌্ণ হতে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকার কারখানার পরিচালন বিভাগ অধিগ্রহণ করে ১৯৭৫-এ, ১৯৮০ সালে পুরোটা। নতুন নাম হয় ‘সাইকেল কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড’। কারখানার স্বাস্থ্য ফেরেনি। ২০০১-এ সেটি বন্ধ হয়ে যায়।

এখন না আছে কারখানার সীমানা প্রাচীর বা মূল ফটক, না রয়েছে জেনারেল অফিসের দোতলা বাড়ি। অফিসার্স ক্লাব, সিএমডি-র বাংলো-সহ অধিকাংশ আবাসনই মাটিতে মিশে গিয়েছে। অ্যাথলেটিক ক্লাবের দরজা-জানলা না থাকলেও দেওয়ালগুলো দাঁড়িয়ে আছে। বহু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের স্মৃতিবিজড়িত মঞ্চটি অবলুপ্ত।

ওয়ার্কার্স কলোনি বা সেন-র‌্যালের মূল জনপদটির ছবি অবশ্য আলাদা। এটি হাউসিং বোর্ডের অধীন, যার দায় নিয়েছেন অপেক্ষাকৃত কমবয়সী প্রাক্তন কর্মীরা এবং উত্তর প্রজন্ম। অনেক সংগ্রামের ইতিহাস বয়ে তাঁরা এখন পরিবর্ত জীবিকার আশ্রয়ে। তাই পিতৃপ্রতিম কারখানার আশ্রয়ের ছায়াটি সরে গেলেও জনপদটি চলিষ্ণুতায় জারিত। আর সংস্কৃতির শেকড় বুঝি ছড়িয়ে আছে, তাঁদের অস্তিত্বের গভীরে। তাই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উদ্যমে চোখে পড়ে সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁদের প্রয়াস।

লেখক আসানসোলের চিকিৎসক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sen-Raleigh Bicycle Factory Sen-Raleigh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE