Advertisement
১৫ মে ২০২৪

ইস্তাহার যাই বলুক, পাচার-ধর্ষণে রাজ্যই প্রথম

নির্বাচনী ইস্তাহারে নিজের আমলে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিজেই ঢালাও প্রশংসা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে মমতার দাবি— এ রাজ্যে ধর্ষণ, রাজনৈতিক হত্যা ও জঙ্গলমহলে খুনখারাবি কমেছে।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায় ও শিবাজী দে সরকার
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৬ ০৩:২৪
Share: Save:

নির্বাচনী ইস্তাহারে নিজের আমলে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিজেই ঢালাও প্রশংসা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে মমতার দাবি— এ রাজ্যে ধর্ষণ, রাজনৈতিক হত্যা ও জঙ্গলমহলে খুনখারাবি কমেছে। এবং কতটা কমেছে, তা বোঝাতে বাম আমলের নেতাই, নন্দীগ্রাম, নানুর ও সাঁইবাড়ি-কাণ্ডের মতো কিছু ঘটনার সঙ্গে তুলনা টেনেছেন তিনি। মমতা দাবি করেছেন— রাজ্যে নারীদের উপরে অপরাধের ঘটনাও ক্রমশ কমছে।

কিন্তু যে এনসিআরবি-র তথ্য উদ্ধৃত করে এই দাবি তৃণমূল নেত্রীর, তাদেরই রিপোর্ট জানিয়েছিল— ২০১১-এ ক্ষমতায় আসার পরের বছর মমতার বাংলাই নারী নির্যাতনে দেশে সবার উপরে ছিল। ওই কেন্দ্রীয় সংস্থার তথ্য বলছে, ২০১১-তে এ রাজ্যে নারী নির্যাতন সংক্রান্ত ২৯,১৩৩ টি মামলা দায়ের হয়েছিল। ২০১২ সালে সেটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৩০,৯৪২। নবান্নের খবর, পর পর দু’বার নারী নির্যাতনে দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করায় ক্ষুব্ধ হয়ে এনসিআরবি-কে তথ্য পাঠাতেই নিষেধ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতার বিকল্প প্রস্তাব ছিল, রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে তাঁর পুলিশই যথেষ্ট। তাই রাজ্য সরকার নিজেই অপরাধের পরিসংখ্যান তুলে ধরে ‘ক্রাইম ইন বেঙ্গল’ তৈরি করবে। কিন্তু সেই প্রস্তাব আর দিনের আলো দেখেনি।

পরবর্তী কালে অবশ্য ‘ক্রাইম ইন বেঙ্গল’ প্রকাশের আশা ছেড়ে এনসিআরবি-কে অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য ফের পাঠানো শুরু করে নবান্ন। সেই তথ্যের উপরে দাঁড়িয়ে এনসিআরবি-ই বলছে, নারী নির্যাতনে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থান না-পেলেও গর্ব করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কারণ তাদের স্থান দ্বিতীয়। পুলিশ কর্তাদেরও একাংশ মানছেন, এ রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে শাসক দলের দাবি বাস্তব থেকে অনেকটাই দূরে।

নারী নির্যাতনে এক ধাপ নেমে এলেও ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনায় অবশ্য সর্বোচ্চ স্থানই ধরে রেখেছে পশ্চিমবঙ্গ। পুলিশকর্তারা বলছেন, ‘‘ধর্যণ একটা গুরুতর অপরাধ। ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা ঘটতে থাকলে বুঝতে হবে রাস্তাঘাটে মহিলারা নিরাপদ নন।’’ ওই পুলিশকর্তাদের বক্তব্য, কোথাও ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা ঘটলে ধরে নিতে হবে সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ততটা আঁটোসাঁটো নয়, যে কারণে দুষ্কৃতীরা ওই অপরাধ করার সুযোগ পাচ্ছে।

এ রাজ্যের পুলিশকর্তাদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে নারী নির্যাতনের সংখ্যা বেড়ে চলার অন্যতম প্রধান কারণ, ধর্ষণের মামলায় সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে ঢিলেমি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হরিভাই পারথিভাই চৌধুরী এ বছরই লোকসভায় জানিয়েছেন, ধর্ষণের মামলায় সাজা দেওয়ায় দেশের ২৯টি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ২৮তম।

শুধু ধর্ষণ মামলাতেই নয়, সার্বিক ভাবে সব ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রেই সাজা দেওয়ার ব্যাপারে পিছিয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গ। এনসিআরবি-র রিপোর্টই বলছে, অপরাধীদের সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে এ রাজ্যের স্থান পিছনের সারিতে। সেটাও ২৮ নম্বরেই। নবান্নের একাংশ বলছেন, শাস্তিদান মূলত নির্ভর করে আদালতে পেশ করা পুলিশি নথির (কেস ডায়েরি) ওপরে। তদন্তের শেষে যুক্তিগ্রাহ্য চার্জশিটও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু এই আমলে বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, জামিন-অযোগ্য ধারা দেওয়া সত্ত্বেও পুলিশের তরফে সরকারি কৌঁসুলিদের একাংশ অভিযুক্তকে নিজেদের হেফাজতে চাননি। এমনকী, রাজনৈতিক সংঘর্ষে জড়িত অভিযুক্তদের জামিনেরও বিরোধিতা করেননি। ফলে, বহু ক্ষেত্রে জামিন পেয়ে তাঁরাই আবার অসামাজিক কাজে মেতেছেন। এগুলোই সুষ্ঠু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার অন্তরায় বলে মত একাধিক পুলিশকর্তার।

মানুষ পাচারেও এ রাজ্য দেশের মধ্যে এক নম্বরে। এমনকী দ্বিতীয় স্থানে থাকা তামিলনাড়ুর থেকে দ্বিগুণ পাচারের ঘটনা ঘটেছে এ রাজ্যে। পরিস্থিতি এতোটাই ঘোরাল যে এ রাজ্যের মানুষ পাচার নিয়ে ২০১৩ সালে তাদের রিপোর্টে উদ্বেগ

প্রকাশ করেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। এনসিআরবির-ই তথ্য বলছে, বিদেশিরা এসে অপরাধ করছে, এমন ঘটনাও এই রাজ্যে সব থেকে বেশি। শিশুদের উপরে অত্যাচারের ক্ষেত্রেও বাংলা প্রথম সারিতে।

তৃণমূল নেত্রীর ‘পরিবর্তন’-এর জমানায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি করলেও গত পাঁচ বছরে এ রাজ্যের রাজনীতি সব চেয়ে বেশি উত্তাল হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা নিয়েই। গত পঞ্চায়েত ভোটের আগে দলের সভায় পুলিশকে বোমা মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন বীরভূমের তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল। তাঁর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করার সাহস দেখায়নি পুলিশ। একই ভাবে প্রকাশ্যে একাধিক খুনের কথা কবুল করেও পার পেয়েছেন লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম। কোনও ক্ষেত্রেই প্রশাসন নড়ে বসেনি।

পুলিশের অনেকেই বলছেন, প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের এমন মনোভাবেই দাপট বেড়েছে সমাজবিরোধীদের। গত আট মাসে কলকাতা ও লাগোয়া এলাকায় অন্তত ১৩টি গুলি চলার ঘটনা ঘটেছে। পাঁচটি ঘটনায় মৃত্যুও হয়েছে। আইনরক্ষা করতে গিয়ে শাসক দলের রোষে পড়েছে পুলিশ। বহু থানায় ঢুকে হামলা চালিয়েছে শাসক দলের কর্মীরা। গার্ডেনরিচে কলকাতা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর তাপস চৌধুরীকে গুলি করে খুন কিংবা বীরভূমের দুবরাজপুরে সাব-ইন্সপেক্টর অমিত চক্রবর্তীকে বোমা মেরে খুনের ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল শাসক দলের। কলকাতার পুরভোটে এসআই জগন্নাথ মণ্ডলকে গুলি করার ঘটনায় শাসক দল ঘনিষ্ঠ গোপাল তিওয়ারিকে পাকড়াও করলেও দোষী নেতাদের ছোঁয়নি লালবাজার।

অনেকেরই প্রশ্ন, রাজ্যে নারী নির্যাতন কমেছে, কি কমেনি, পরিসংখ্যানের উপরে দাঁড়িয়ে সেই বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু মমতার ‘সুশাসন’-এ মুচিপাড়া থানার পুলিশ যখন বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে বিবাদের এফআইআরে অভিযুক্ত কিশোরীর নাম বদলে ‘ধর্ষিতা’ নাম দেন, তখনই প্রশ্ন ওঠে— আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি কি শুধুই ইস্তাহারে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE