Advertisement
১১ মে ২০২৪

শাসক দলের কর্মী খুনে অভিযুক্তরা দলে কেন, প্রশ্ন তৃণমূলের অন্দরে

যাঁদের বিরুদ্ধে শাসক দলের কর্মী খুনের মামলা চলছে, তাঁদেরই সাদর বরণ করে নিলেন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব!

কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিলেন সবংয়ের বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার ভাই তথা পশ্চিম মেদিনীপুর কংগ্রেসের জেলা সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়া। বৃহস্পতিবার দলবদলের পরে তৃণমূলের কার্যালয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিকাশবাবু। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিলেন সবংয়ের বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার ভাই তথা পশ্চিম মেদিনীপুর কংগ্রেসের জেলা সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়া। বৃহস্পতিবার দলবদলের পরে তৃণমূলের কার্যালয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিকাশবাবু। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৩৫
Share: Save:

যাঁদের বিরুদ্ধে শাসক দলের কর্মী খুনের মামলা চলছে, তাঁদেরই সাদর বরণ করে নিলেন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব!

পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ে বিধানসভা ভোটের দু’দিন আগে তৃণমূলের কর্মী জয়দেব জানার খুনের ঘটনায় এফআইআর হয়েছিল সেখানকার স্থানীয় কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া, তাঁর ভাই তথা পশ্চিম মেদিনীপুর কংগ্রেসের জেলা সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়া, সবং ব্লকের সভাপতি অমল পণ্ডা, সবং ব্লকের সাধারণ সম্পাদক আবু কালাম বক্স-সহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে। মানসবাবু-সহ ৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। বিচারাধীন সেই মামলার অভিযুক্তদেরই বৃহস্পতিবার নিজেদের দলের সদস্য করে নিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায় এবং যুব সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বিকাশবাবুদের যোগদানে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা পরিষদে তৃণমূলের শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি সবং পঞ্চায়েত সমিতিও দখলে এল। বিকাশবাবুদের সঙ্গে তৃণমূলে যোগ দিলেন মানসবাবুর আইনজীবী হরিসাধন ভট্টাচার্যও। যিনি এই খুনের মামলায় মানসবাবুর হয়ে লড়ছিলেন!

মানসবাবুদের দাবি, তাঁদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বিকাশ-অমলবাবুদের যোগদান নিয়ে নৈতিক প্রশ্ন তুলছেন। নিহত জয়দেবের স্ত্রী মানসী জানা যেমন এ দিন সরাসরিই বলেছেন, ‘‘যাঁরা আমার স্বামীকে খুন করলেন, তাঁদের দলে নেওয়ার আগে দিদির যাচাই করে নেওয়া উচিত ছিল! ওঁরা ভাবছেন, তৃণমূলে যোগ দিলে মামলা থেকে বেঁচে যাবেন। আমারও সন্দেহ, এর পরে আর আমার স্বামীর মৃত্যুর সুবিচার হবে না!’’

কেন তাঁরা তৃণমূলের কর্মী খুনে ‘অভিযুক্ত’দের নিজেদের দলে নিলেন, সেই প্রশ্নের জবাবে যুব সভাপতি অভিষেক বলেছেন, ‘‘বিচারাধীন বিষয়ে কিছু বলব না। আইন আইনের পথে চলবে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘রাজনৈতিক ভাবে কেউ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন-যজ্ঞে সামিল হতে চাইলে তাঁদের স্বাগত জানাই আমরা। এই যোগদানের সঙ্গে প্রশাসনের কোনও যোগ নেই।’’

বস্তুত, নবান্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই জেলায় জেলায় যে ভাবে বিরোধীদের দল ভাঙানোর হিড়িক পড়েছে, তাতে নৈতিকতার প্রশ্নই বারে বারে উঠছে। মালদহ ও জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদ ইতিমধ্যে কংগ্রেস ও বামেদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে শাসক দল। কংগ্রেসের ঘাঁটি মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদও ভাঙিয়ে নেওয়ার সব রকম চেষ্টা চলছে। ওই জেলার নওদায় এ দিনই তৃণমূলের পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারীর সভায় বেলডাঙা-১ ব্লকের তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতের কিছু কংগ্রেস ও বাম সদস্যদের হাতে শাসক দলের পতাকা ধরানো হয়েছে। তৃণমূল ভবনে ঘোষণা করে দখল নেওয়া হয়েছে জলপাইগুড়ি সদর ও ডায়মন্ড হারবার-২ পঞ্চায়েত সমিতি। কলকাতা ও শিলিগুড়ি পুরসভার দুই ফরওয়ার্ড ব্লক কাউন্সিলর শামিমা রেহান খান ও দুর্গা সিংহও যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে।

প্রশ্ন উঠছে, বিধানসভা ভোটের পরে রাজ্যের সর্বত্র তৃণমূলের দাপট এখন একচ্ছত্র। তার পরেও বিরোধীদের হাতে থাকা সব পুরসভা বা পঞ্চায়েত ভাঙিয়ে নিতে হচ্ছে কেন? বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী যেমন এ দিন বলেছেন, ‘‘তৃণমূলের প্রযোজনায় অনৈতিক ঘোড়া কেনাবেচা চালিয়ে মানুষের রায়কে লাগাতার অমর্যাদা করা হচ্ছে। মানুষ এই রাজনীতির যোগ্য জবাব দেবেন!’’

তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুকুল রায় অবশ্য বোঝাতে চেয়েছেন, তাঁরা কাউকে ভাঙাচ্ছেন না। গণতন্ত্রে দলবদল সংবিধান সম্মত। তিনি উদাহরণ দিয়েছেন, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়বেন বলে চিকমাগালুরে যিনি ইন্দিরা গাঁধীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, পরবর্তী কালে তিনিই ইন্দিরার দিকে এসেছিলেন। রাজনীতিতে এমন ঘটনা ঘটেই থাকে। কেউ কেউ এই প্রশ্নও তুলছেন— মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামের এক সাধারণ পঞ্চায়েত সদস্য টুম্পা মারজিতকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছিল। তার পরেও তাঁকে কংগ্রেস ছাড়তে রাজি করানো যায়নি। এক সাধারণ মহিলা যদি এমন নৈতিক দৃঢ়তা দেখাতে পারেন, মিথ্যা মামলা করা হয়েছে জেনেও মানস বা বিকাশবাবুরা পারছেন না কেন?

তাঁরা কি ‘মিথ্যা মামলা’ থেকে নিষ্কৃতির আশ্বাস পেয়েছেন? বিকাশবাবু এ দিন জবাব দিয়েছেন, ‘‘তখন (ভোটের সময়) যা বলার, বলেছিলাম। এখন শুধু সবংয়ের উন্নয়নের জন্য তৃণমূলে এসেছি, এটুকুই বলতে চাই।’’ মুকুল-অভিষেকের পাশে বসে বিকাশবাবু যখন নিজেদের ‘তৃণমূলের শরিক’ বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, তখন দু’চারটে চেয়ার দূরে অমলবাবুর মাথা নিচু। চোখ-মুখ থমথমে। মামলার হেনস্থা থেকে বাঁচতেই তাঁরা তৃণমূলের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছেন বলে একান্ত আলাপচারিতায় স্বীকার করে নিয়েছেন মানসবাবুর দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধারা। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতাও ঘরোয়া আলাপচারিতায় বলেই ফেলেছেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন তো ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, মামলাটা ভুয়ো। ওই মামলার জন্য সবংয়ের ১৩ জন ওসি বদল হয়েছে!’’

এর পরের প্রশ্ন, মানসবাবুর দলবদলও কি সময়ের অপেক্ষা? সবংয়ের বিধায়ককে কোনও আক্রমণ এড়িয়ে অভিষেক বলেন, ‘‘মানসবাবু বিচক্ষণ ও পরিণত রাজনীতিক। উনি যা করার, ভেবেচিন্তেই করবেন।’’ মানসবাবু অবশ্য এ দিন মন্তব্য করেছেন, ‘‘আমি এখনও কংগ্রেসে আছি। কিন্তু প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরীর নির্দেশে আজও পরিষদীয় দলের নেতা আব্দুল মান্নান আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দিল্লিতে কংগ্রেস নেতাদের কাছে তদ্বির করেছেন। প্রদেশ নেতৃত্ব যে ভাবে আমাকে নির্যাতন ও অসম্মান করছেন, ভবিষ্যতে কী হবে জানি না!’’ বিধানসভার অধিবেশন শুরুর দিন, আজ, শুক্রবারই কংগ্রেসের পরিষদীয় দলের বৈঠকে মানসবাবুকে নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ‘অসম্মানিত’ মানসবাবু অবশ্য বৈঠকে যাচ্ছেন না।

প্রদেশ সভাপতি অধীর যদিও বিকাশবাবুদের তৃণমূলে যোগদানে বিস্মিত নন। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘ওঁরা দীর্ঘ দিন ধরেই তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। ওঁদের মাথাও যোগাযোগ রাখছেন! মুখ্যমন্ত্রীর কথায় তিনি যে চলছেন, তা-ও স্পষ্ট। কেউ কংগ্রেস ছেড়ে চলে যেতে চাইলে যেতেই পারেন। কংগ্রেসে আসা ও কংগ্রেস থেকে যাওয়া সহজ। কিন্তু কংগ্রেসে টিকে থাকাটাই সব চেয়ে কঠিন!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

TMC murder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE