Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পরেশ মৃত, স্ত্রী খোঁজ নিলেন সুনীতাদের

তিন দিন ধরে বোধহয় মনটা একটু-একটু করে প্রস্তুত করে ফেলেছিলেন। বুধবার স্বামীকে মৃত ঘোষণা করার খবর তাই যেন তেমন টলাতে পারল না তাঁকে।

কান্নায় ভাঙলেন সবিতাদেবী। বুধবার রাতে। নিজস্ব চিত্র।

কান্নায় ভাঙলেন সবিতাদেবী। বুধবার রাতে। নিজস্ব চিত্র।

সুব্রত সীট
দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৬ ০০:৫৯
Share: Save:

তিন দিন ধরে বোধহয় মনটা একটু-একটু করে প্রস্তুত করে ফেলেছিলেন। বুধবার স্বামীকে মৃত ঘোষণা করার খবর তাই যেন তেমন টলাতে পারল না তাঁকে। এভারেস্ট অভিযানে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া দুর্গাপুরের পরেশচন্দ্র নাথের স্ত্রী সবিতাদেবী খবর জানার পরে উল্টে জানতে চাইলেন, ‘‘সেই মেয়েটি (সুনীতা হাজরা) এখন কেমন আছেন? আর এক জন যিনি নিখোঁজ ছিলেন, তাঁর কোনও খবর আছে?’’

পাহাড়ে অভিযানে গিয়ে তিন দিনের বেশি নিখোঁজ থাকায় নিয়মমাফিক পরেশবাবুকে মৃত ঘোষণা করেছে নেপাল সরকার। ২১ মে থেকে নিখোঁজ তিনি। তাঁকে মৃত ঘোষণা করার খবর বুধবার দুপুরেই এসে পৌঁছেছিল শহরের অনেকের কাছে। কিন্তু ইস্পাতনগরীর বি-জোনের শরৎচন্দ্র রোডের ডিএসপি আবাসনের বাসিন্দা সবিতাদেবীকে তা তখনই জানানো হয়নি। শেষে রাত ৮টা নাগাদ এই পরিবারের ঘনিষ্ঠ রণজিৎ গুহ বাড়িতে গিয়ে সবিতাদেবীকে খবর দেন। ভেবেছিলেন, হয়তো সবিতাদেবী চমকে উঠবেন। কিন্তু চোখের কোন সামান্য ছলছল করে ওঠা ছাড়া তাঁর চোখমুখ ছিল আপাত নির্লিপ্ত। স্বামীর খবর শুনে সবিতাদেবী পাল্টা জানতে চান সুনীতা ও স্বামীর আর এক সহযাত্রী সুভাষ পালের কথা।

এভারেস্ট অভিযানে গিয়ে শনিবার থেকে নিখোঁজ প্রতিবন্ধী পর্বতারোহী, বছর আটান্নর পরেশবাবু। বারো বছর বয়সে দীপাবলিতে বাজি ফাটানারো সময়ে উড়ে গিয়েছিল বাঁ হাতের পাঞ্জা। পর্বতারোহী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত সরোজ দে-র সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরে পেশায় দর্জি পরেশবাবুর পাহাড়ে চড়ার নেশা পেয়ে বসে। জম্মু-কাশ্মিরের পহেলগাঁও-এর জহর ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং এবং দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৯৯১ সাল থেকে এক হাত সম্বল করেই পরপর অভিযানে গিয়েছেন। হিমাচল প্রদেশের সিটিধর, গাড়োয়াল হিমালয়ের ঠালু, কোটেশ্বর, হিমালয়ের গঙ্গোত্রী ২, চন্দ্র প্রভাত, কেদার ডোম-এর মতো শৃঙ্গ জয় করেছেন। প্রায় ৩০ বার তিনি পর্বত অভিযানে বেরিয়েছেন।

পরেশবাবুর প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠদের সূত্রে জানা গিয়েছে, বরাবর তাঁর স্বপ্ন ছিল, এভারেস্টে চড়বেন। সরকারি-বেসরকারি স্তরে সাহায্য চেয়ে, দেনা করে অভিযানের বিপুল খরচ জোগাড় করে ২০১৪-র মার্চে তিনি এভারেস্ট অভিযানে বেরোন। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে সমুদ্রতট থেকে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার ফুট উচ্চতায় বরফে মোড়া বেসক্যাম্প থেকে ফিরে আসতে হয় তাঁকে। দমে না গিয়ে পরের বছরও যান। কিন্তু সে বার বাধ সাধে নেপালের ভূমিকম্প। শেষে এ বছর ৭ এপ্রিল ফের এভারেস্টের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন।

বেস ক্যাম্প থেকে উপরে ওঠার আগে ১৭ মে শেষ বার পরেশবাবু ফোনে কথা বলেন স্ত্রী সবিতার সঙ্গে। এর আগেও বহু অভিযানে গিয়েছেন। দিনের পর দিন যোগাযোগ থাকত না। এ বারও তাই কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না সবিতাদেবীর মনে। কিন্তু শনিবার দুপুর থেকে বদলে যায় ছবিটা। বুধবার সন্ধ্যায় স্বামীর মৃত ঘোষণার খবর পাওয়ার পরে প্রথমে দৃশ্যত অবিচল ছিলেন সবিতাদেবী। রাতে অবশ্য কান্নায় ভেঙে পড়েন।

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছেলে অদ্রিশিখর বাবার কাছে অভিযানের বহু গল্প শুনেছে। পরেশবাবু চাইতেন, ছেলেও তাঁর মতো অভিযাত্রী হবে। ছোট্ট অদ্রিশেখর এ দিন বলে, ‘‘বাবা জুন মাসে ফিরে আসবে বলে গিয়েছে। বড় হয়ে আমিও বাবার মতো এভারেস্টে যাব।’’ শুধু সবিতাদেবী নয়, উপস্থিত সকলেরই চোখে জল আসে তা শুনে। ‘দুর্গাপুর মাউন্টেনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক সাগরময় চৌধুরী বলেন, ‘‘পরেশবাবু আমাদের সবার গর্ব। তাঁর পরিবারের পাশে আমাদের সংগঠন থাকবে।’’ মহকুমাশাসক (দুর্গাপুর) শঙ্খ সাঁতরা বলেন, ‘‘প্রশাসনের তরফে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দেখা হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mountaineer Sunita Hazra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE