উত্তরে এক। দক্ষিণে অন্য। উত্তর নাকানিচোবানি খাচ্ছে টানা বর্ষণে। শেষ আশ্বিনে হেমন্তের পদধ্বনি শুনছে দক্ষিণ। আবহাওয়ার খামখেয়ালে বাংলার দুই প্রান্ত এতটাই আলাদা হয়ে গিয়েছে, পরস্পরকে চিনতে যেন কষ্ট হচ্ছে!
বৃষ্টির হানাদারির মধ্যে পুজো সাঙ্গ হতে না-হতেই বৃহস্পতিবার সকালে খোলা জানলা দিয়ে শুকনো ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে আসায় চমকে উঠেছিলেন দমদমের প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। বেলা বাড়তেই তাঁর ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে ঢুকে পড়েছে চড়া রোদ্দুর। অফিসে পৌঁছনোর পরে সহকর্মীদের অনেকে জানালেন, আবহাওয়ার পরিবর্তনটা ধরতে পারছেন তাঁরাও। শীত কত দিনে পড়বে, তা নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা জুড়ে দিলেন প্রশান্তবাবু। হেমন্ত নামে একটা ঋতু যে এই বাংলারই ঋতুচক্রের সদস্য, সেটা মনে করিয়ে দিয়ে কেউ কেউ তার দুর্লভ ছোঁয়ার সম্ভাবনাতেই শিহরিত।
দক্ষিণবঙ্গে হিমের এমন পুলকিত আভাস মিললে কী হবে, উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে নাছোড় বৃষ্টি চলছেই। বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় ধসের দাপটে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। ভারী বর্ষণে ব্যাহত হচ্ছে জীবনযাত্রা। সমতলের অনেকে শারদীয় ছুটি কাটাতে পাহাড়ে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন। ঘোরাঘুরি শিকেয় তুলে দুর্যোগে প্রায় হোটেলবন্দি থাকতে হচ্ছে তাঁদের। বাড়ি ফেরার পথেও কাঁটা ছড়িয়ে দিয়েছে প্রকৃতি।
একই রাজ্যের দু’প্রান্তে এক সময়ের আবহাওয়ায় এত তফাত কেন? আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, দক্ষিণবঙ্গ থেকে জোড়া ঘূর্ণাবর্ত বিদায় নিতেই এক ঝটকায় বদলে গিয়েছে এখানকার আবহাওয়া। শুরু হয়েছে বর্ষা-বিদায়ের পালা। শরৎ-হেমন্তের সন্ধিক্ষণে আবহাওয়া যেমন হওয়া উচিত, বাংলার দক্ষিণে এ বার অন্তত সেটাই হচ্ছে। হেমন্ত বেঁচে আছে কি না, তা নিয়ে যখন গবেষণার তোড়জোড় চলছে, হাওয়ায় হাওয়ায় তখনই তার চরণধ্বনি। শীত কাল কবে আসবে, সেই জল্পনার মধ্যেই টান ধরতে শুরু করেছে চামড়ায়।
কিন্তু উত্তরের পরিস্থিতি হঠাৎ এত আলাদা হয়ে গেল কী ভাবে?
উত্তরবঙ্গের উপর দিয়ে সিকিম পর্যন্ত একটাই নিম্নচাপ অক্ষরেখা রয়েছে। তার প্রভাবে উত্তরবঙ্গে টানা বৃষ্টি হচ্ছে, জানাচ্ছে হাওয়া অফিস। জোড়া ঘূর্ণাবর্ত দক্ষিণে দৌরাত্ম্য চালালেও উত্তরে তার দাপট তেমন ছিল না। কিন্তু বর্ষাশেষের একটি নিম্নচাপই চাপ বাড়িয়েছে সেখানে।
দক্ষিণবঙ্গে ষষ্ঠী থেকেই পুজোয় সমানে হানা দিয়েছে ঘূর্ণাবর্ত ওরফে ঘূর্ণাসুর। ওড়িশায় ঘাঁটি গেড়ে সে এ রাজ্যে বৃষ্টি ঝরালেও পুজোপাগল বাঙালিকে দমাতে পারেনি। শেষে ঝাড়খণ্ডে পৌঁছে মিলিয়ে গিয়েছে সে। তার দোসর অন্য একটি ঘূর্ণাবর্ত মহানবমীর রাতে জোরালো বৃষ্টি নামিয়েছিল কলকাতা-সহ সারা দক্ষিণবঙ্গে। সেই দু’নম্বর ঘূর্ণাসুরের দাপটে বর্ষা দীর্ঘ হবে বলেও আশঙ্কা করছিলেন অনেকে। কিন্তু দেবী কৈলাসে পাড়ি দিতেই তাঁর পিছনে পিছনে বাংলা ছেড়েছে ঘূর্ণাসুর নম্বর টু-ও। আর তার বিদায়েই পথ পেয়ে গিয়েছে শুকনো হিম-হিম হাওয়া।
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গণেশকুমার দাশ বলেন, ‘‘ঘূর্ণাবর্ত বিদায় নিতেই আবহাওয়া এক ঝটকায় অনেক বদলে গিয়েছে। সেই বদলটাই চোখে পড়ছে।’’
বদলটা কী?
আবহবিদের ব্যাখ্যা, ঘূর্ণাসুর টু-এর দাপটে জলীয় বাষ্প মেঘ হয়েছে। সেই মেঘ থেকে সমানে ঝরেছে বৃষ্টি। আর সেই ঘূর্ণাবর্ত রাজ্য ছাড়তেই সাগর থেকে জোলো হাওয়া ঢোকা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। উল্টে বর্ষার বিদায় নেওয়ার পালা শুরু হওয়ায় মধ্য ভারত থেকে শুকনো এবং তুলনায় বেশ খানিকটা ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পড়ছে। এ দিন বিকেলে সূর্য পাটে ঢলতেই একটা হিমেল ভাব চেপে বসেছে। গভীর রাতে অনেকেই আর ফুল স্পিডে ফ্যান চালাননি। হাওয়া অফিসও মেনে নিয়েছে, ঘূর্ণাসুর বিদায় নিতেই পারদ নেমেছে। এ দিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাভাবিকের তুলনায় দু’ডিগ্রি কম। আবহবিদেরা বলছেন, আকাশে মেঘ নেই। সেই জন্য দিনে চড়া রোদ মিলবে, গরমও হবে। রাতে কিন্তু মাটির তাপ দ্রুত বিকিরিত হয়ে নেমে যাবে তাপমাত্রা। দিন ও রাতের তাপমাত্রার এই হেরফেরের ফাঁকেই বজায় থাকবে হিম-হিম ভাব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy