Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সরকারি ভবনের কাজেও ভাটা

নগদ-কাঁটায় থমকে রাস্তা নির্মাণ, ধুলো জমছে দরপত্রে

ভারত-নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। সেই নরেন্দ্র মোদীরই নোট-নাকচের ধাক্কায় রাজ্য জুড়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে রাস্তা ও সরকারি ভবন নির্মাণের কাজ।

দেবজিৎ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:১৭
Share: Save:

ভারত-নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। সেই নরেন্দ্র মোদীরই নোট-নাকচের ধাক্কায় রাজ্য জুড়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে রাস্তা ও সরকারি ভবন নির্মাণের কাজ।

বাংলায় পুজোর ঠিক পরে পরেই রাস্তার কাজ শুরু হয়ে যায় পুরোদমে। তারও বেশ কিছুটা আগে দরপত্র ডেকে কোথাও ঠিকাদার, কোথাও বা বেসরকারি নির্মাণ সংস্থার সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত করে রাখে রাজ্যের পূর্ত দফতর। রাস্তা তৈরি বা সংস্কারের প্রাথমিক পর্বের সেই সমস্ত প্রক্রিয়া এ বারেও সারা। কিন্তু নোট বাতিলের ধাক্কায় বহু নতুন রাস্তার কাজ শুরুই করতে পারেনি পূর্ত দফতর। আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে কাজে নেমেও হাত গুটিয়ে নিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ারেরা।

জেলা-শহরে রাস্তার কাজই শুধু নয়, কলকাতার একাধিক ভবন নির্মাণের কাজেও ছন্নছাড়া অবস্থা। কোনও রকমে এক বেলা কাজ করিয়ে শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন ঠিকাদারেরা। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের একটি নির্মাণ সংস্থা বিদ্যাসাগর সেতুর নীচে তাদের সিমেন্ট-বালি মেশানোর প্লান্ট সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। পূর্ত দফতরের এক কর্তা কথায়, ‘‘কাজই যখন বন্ধ, প্লান্ট চালিয়ে কী হবে?’’

পাঁচশো-হাজার টাকার পুরনো নোট বাতিলের চোটে চালু কাজ তো মার খাচ্ছেই। নতুন কাজের টেন্ডার বা দরপত্রেও যোগ দিচ্ছেন না কেউ। ফলে পূর্ত ও আবাসনের মতো নির্মাণ-নির্ভর দফতরগুলি কিছু ক্ষেত্রে টেন্ডারে যোগ দেওয়ার সময়সীমা বাড়িয়ে দিয়েছে। পূর্ত দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘গত সপ্তাহে যে-সব দরপত্র খোলার কথা ছিল, তার অনেক খাম বন্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ডিসেম্বরের গোড়ায় সেগুলো খোলা হবে।’’ কেন? তাঁর উত্তর, এখন ই-টেন্ডারে সরকারি কাজের বরাত মেলে। অনলাইন ব্যবস্থার সুবাদে ‘সিকিওরিটি ডিপোজিট’ থেকে ‘পেমেন্ট অর্ডার’ সবই হয় ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। নোট-নাকচের ধাক্কায় ব্যাঙ্কগুলির নাকানিচোবানি অবস্থা। তাই দরপত্র খোলাও মুলতুবি।

সরকারের বক্তব্য, অধিকাংশ নির্মাণ ঠিকাদার-নির্ভর। এখন বহু প্রকল্পই রূপায়ণ করা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে। সেখানে বরাত পাওয়া নির্মাতা সংস্থাগুলোই মূল কারিগর। নোট বাতিলের ধাক্কায় তাদের দিনমজুরেরা রাতারাতি প্রকল্পের কাজ ছেড়ে ‘দেশের বাড়ি’‌তে অর্থাৎ গাঁয়ের ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। কেন? কাকদ্বীপ মহকুমার রাস্তার কাজ করছেন, এমন এক জন ঠিকাদার বললেন, ‘‘আমরা সরাসরি শ্রমিক নিয়োগ করি না। এজেন্সি থেকে লোক নিই। প্রতিদিন নগদে মজুরি দিতে হয়। হাতে খুচরো টাকা না-থাকলে এজেন্সিকে টাকা দেব কী ভাবে?’’ ওই ঠিকাদারকে শ্রমিক জোগান দিয়েছিলেন ডায়মন্ড হারবারের বিশ্বপতি গায়েন। তাঁর বক্তব্য, শ্রমিকেরা মূলত মালদহ, মুর্শিদাবাদের। অধিকাংশেরই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। কাঁচা টাকাই সম্বল। রাস্তার কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকে গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। কাজ শুরু হলেও তাঁরা আর আদৌ ফিরে আসবেন কি না, সেই দুশ্চিন্তায় ঘুম ছুটে গিয়েছে বিশ্বপতিবাবুর।

ইঞ্জিনিয়ারদের হিসেব বলছে, এক কিলোমিটার রাস্তা বানাতে কমবেশি ৬০ জন শ্রমিক লাগে। রোজই কিছু নতুন মুখ আসে। সকলকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কাজ দিতে হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের এক কর্তা বলেন, ‘‘সামনেই গঙ্গাসাগর মেলা। ফি-বছর এই সময় জোরকদমে রাস্তার কাজ চলে। কিন্তু এ বার মেলার আগে কাজ গুটিয়ে নেওয়া যাবে কি না, তা এখনও বলা যাচ্ছে না।’’ সেচ দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ার জানাচ্ছেন, শীতকালেই সুন্দরবনের বাঁধে মেরামতির কাজকর্ম হয়। উত্তর ২৪ পরগনায় পাঁচটি বাঁধের কাজ চালু করেও বন্ধ রাখতে হয়েছে।

এর কারণ হিসেবে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে ইট শিল্পে অস্থিরতার কথাও বলা হচ্ছে। বেঙ্গল ব্রিকফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অশোক তিওয়ারি বলেন, ‘‘অক্টোবরের গোড়া থেকেই ভাটায় কাজ শুরু হয়ে যায়। চলে টানা ছ’মাস। নোট বাতিলের জেরে অনেক ভাটায় মাঝপথেই কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মজুরি মিলবে না বুঝে কোথাও শ্রমিকেরা আসছেন না, কোথাও বা চলে গিয়েছেন।’’ অশোকবাবুর হিসেব, রাজ্যের সাড়ে ১২ হাজার ভাটায় ২৫ লক্ষ শ্রমিক কাজ করেন। ছ’মাসে ৬০০ কোটি ইট তৈরি হয়। নোটের চোটে এ বার ২৫ শতাংশের মতো ব্যবসা মার খাবে।

হাওড়ার নাজিরগ়ঞ্জ থেকে পাঁচপাড়া— গঙ্গার পাড় ঘেঁষে এই তিন কিলোমিটারের মধ্যে ২৪-২৫টি ইটভাটা আছে। পুজো শেষ হতে না-হতেই ভাটার শ্রমিকেরা দলে দলে কাজে নেমে পড়েছেন— এটাই সেখানকার চেনা ছবি। এ বার কিছুটা হলেও সেই ছবি আলাদা। বিস্কো মোড়ের এক ইটভাটার ম্যানেজার বললেন, ‘‘খরিফ শস্য মাঠ থেকে ওঠার পরেই শ্রমিকেরা ভাটায় আসেন। এ বার অনেক শস্য এখনও মাঠেই পড়ে আছে। তাই শ্রমিকের জোগানও কম।’’ পাঁচপাড়ার এক ভাটা-মালিক জানান, এক-এক জন শ্রমিক প্রতিদিন ন্যূনতম ৩০০ টাকা আয় করেন। এ বার মজুরি বাড়িয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Demonetisation Bharat Nirman Project
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE