Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কলকাতার ‘নতুন’ নাগরিক

বর্ষশেষের কলকাতায় তিনি নেই। শিগগির ফিরছেনও না। স্প্যানিশ এই ভদ্রলোক এ বার ট্রফিও দেননি শহরকে। তবু তিনি, অ্যান্টোনিও হাবাস এখন কলকাতারই একজন। তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়বর্ষশেষের কলকাতায় তিনি নেই। শিগগির ফিরছেনও না। স্প্যানিশ এই ভদ্রলোক এ বার ট্রফিও দেননি শহরকে। তবু তিনি, অ্যান্টোনিও হাবাস এখন কলকাতারই একজন। তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫ ১২:২৩
Share: Save:

একটা পুরনো দিনের লেটার বক্স। গায়ে লেখা ঠিকানাটা, ২৩ বি লেক টেম্পল রোড, কলকাতা ২৯। কলকাতায় এলেই অ্যান্টোনিও লোপেজ হাবাসের হোয়াটসঅ্যাপ ডিপি বদলে হয়ে যায় লেটারবক্সের ছবিটা। প্রথম বছর ওঁর মোবাইলে ছবিটা দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। যোগাযোগটা জানতে চাইলে, বেশ রহস্যের হাসি উপহার দিয়েছিলেন। এ বছর একই ছবি। স্পেন থেকে প্রস্তুতিশিবির সেরে ফিরতেই আবার সেই লেটারবক্সটা। আমার কয়েকজন সহকর্মীকে পাঠালাম ওই ঠিকানায় খোঁজ নিতে। তারা এসে জানাল বাড়ির বাসিন্দারা হাবাসের নাম অবধি শোনেনি। যোগাযোগ তো দূরের কথা। এ বার মাদ্রিদ ফিরে যাওয়ার আগে ওই লেটারবক্সের রহস্যটা নিজেই জানিয়ে গেলেন অ্যাটলেটিকো ডি’কলকাতার কোচ।

‘‘আসলে, আমি ওই লেটার বক্সটা দিয়ে কলকাতাকে খুব ভাল কানেক্ট করতে পারি। গত বছর পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে ছিলাম। সে সময়ই দেখি ওই লেটারবক্সটা। ছবি তুলে রেখেছিলাম। আর এই ছবিটাকেই কেন জানি মনে হয় আমার কলকাতার ঠিকানা,’’ বলেন হাবাস। অবাক লাগছিল। ভিক্টোরিয়া নয়, হাওড়া ব্রিজ নয়, নিদেন পক্ষে সল্টলেক স্টেডিয়ামও নয় — হাবাসের বং কানেকশন লেক টেম্পল রোডের ওই পুরনো লেটার বক্সটা।

আসলে এটাই হয়। একটা শহরের প্রতিদিনের জীবনে, অস্তিত্বে, সংগ্রামে, মননে — যদি আন্তরিকভাবে জড়িয়ে পড়া যায়, তা হলে এটাই হয়। ভিক্টোরিয়ার বদলে শহরের মুখ হয়ে যেতে পারে কলকাতার ঠিকানা লেখা একটা ছোট্ট লেটার বক্স। আর বিশ্বাস করুন, দু’বছর এ শহরে থেকে সত্যিই কলকাতার সঙ্গে এ ভাবেই জড়িয়ে গেছেন হাবাস। সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়ার পর এ বার যে দিন মাদ্রিদে যাচ্ছেন, দেখা করতে গিয়েছিলাম ওঁর সঙ্গে। বললেন, ‘‘হ্যাঁ, আমার কাছে দু’টো আইএসএল ফ্র্যাঞ্চাইজির বড় অফার। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি বারবার ফিরে আসতে চাই আপনাদের এই শহরে। এখানকার মানুষের কাছে যে ভালবাসা পেয়েছি, কোথাও পাব না।’’ রাগী, উদ্ধত, মেজাজি মানুষটা তখন কলকাতার আবেগে ভাসছে।

সত্যিই গত দু’বছরে কলকাতাও বোধহয় উজাড় করে ভালবাসা ফিরিয়ে দিয়েছে তাঁকে। অ্যাটলেটিকো ডি’কলকাতার সঙ্গে এ শহরের মানুষের সবচেয়ে বড় কানেক্টটা যে তিনিই। একজন উদ্ধত, জেদি, একরোখা, আক্রমণাত্মক মানুষ। যিনি শুধুই জিততে চান। হারলে মেজাজ হারান। নিরীহ, আপাতশান্ত, মাছেভাতে বাঙালি কী করে যে এমন একজনকে পছন্দ করে রীতিমতো তাঁদের নায়ক বানিয়ে নিল — সত্যিই বোধগম্য নয়। বাঙালিকে খেলার মাঠে এ সব জিনিস প্রথম যিনি শিখিয়েছিলেন, তিনি নিজে হাবাসের বড় ফ্যান। প্রথম বছর রাকেশ মাসি-কে খেলানো নিয়ে চারদিকে সমালোচনার ঝড়। সৌরভের কানেও পৌছে যাচ্ছে অনেক অভিযোগ।

এটিকে মালিক বললেন, ‘‘আচ্ছা, আমি কথা বলছি হাবাসের সঙ্গে।’’ স্টেডিয়ামের পাশেই একটা হোটেলে মিটিং ফিক্স হল। সৌরভ গেলেন মিটিংয়ে। একঘণ্টা ধরে হাবাসের দুর্বোধ্য ইংরেজি শুনে বেরিয়ে এলেন। প্রায় কিছুই বললেন না। বেরিয়ে শুধু বললেন, ‘‘ওঁর প্যাশনটাকে আমি শ্রদ্ধা করি। ওঁকে কিছু বলার দরকার নেই। টিমের ভালর জন্য যা যা দরকার, উনি সবটাই করবেন।’’

এ বছরও কত বার এটিকে নিয়ে কথা হয়েছে সৌরভের সঙ্গে। প্রতিবার একটাই কথা, ‘‘আমাদের টিমের আসল লোক কিন্তু ওই লোকটাই। আমাদের লোক। জেতার জন্য যা খুশি করতে পারে।’’ যে মেজাজ, মানসিকতার কপিরাইট তাঁর নিজের হাতে, নিজের টিমে যদি কাউকে সেই পতাকাই বয়ে নিয়ে যেতে দেখেন, তা হলে আর খারাপ কোথায়! আর এই আগুনে মেজাজটাই আইএসএল-এ কলকাতার ব্র্যান্ড ফুটবল। টিমের মাঠে নামা থেকে শুরু করে ড্রেসিং রুমে ফিরে যাওয়া অবধি একটাই অলিখিত শর্ত হাবাসের টিমের। শরীরের ঘামের শেষ বিন্দুটা মাঠেই ফেলে দিয়ে আসতে হবে। তা হলেই যে কোনও ফুটবলার উঠে আসবেন হাবাসের পছন্দের তালিকায়। তা না হলে লুই গার্সিয়া, ফিকরু টাফেরাকে বাদ দিয়েও ফাইনালে মাঠে নামতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না এটিকে কোচ। আবার ওঁদের প্রতিভার ধারে কাছে না থেকেও জোয়েল রাজা, অর্ণব মন্ডল, মহম্মদ রফিকরা হয়ে যান কোচের সুইটহার্টস।

গত বছর সেমিফাইনালের আগে ফিকরুর বিষয়টাই যেমন। আইএসএলের প্রথম গোল, সামারসল্ট, চুলের স্টাইল — এ সব নিয়ে ফিকরু শুধু এটিকের ‘ফেস’ ছিলেন না, হয়ে গিয়েছিলেন গোটা আইএসএল-এর মুখ। কিন্তু আজ এর সঙ্গে মারপিট, কাল ওর সঙ্গে লড়াই — এ সব করে ফর্মটাও হারাচ্ছিলেন। তার মধ্যেই ইনজুরি হল। ডাক্তার বললেন ফিট নয়। হাবাস তাঁকে রেখেই গোয়ায় গেলেন সেমিফাইনাল খেলতে। কিন্তু ফিকরু এ সব শোনার মানুষই নন। অন্য ফ্লাইটে চলে এল গোয়া। ততক্ষণে হাবাসও হুমকি দিচ্ছেন: ‘‘ওকে যেন এই হোটেলে না দেখি। এত বড় বিশৃঙ্খলা আমার টিমে মানব না।’’ ফিকরুকে নিয়ে তুললাম গোয়ার অন্য একটা হোটেলে। সঙ্গী ব্যারেটো। ব্যারেটোর কথাই একটু আধটু শুনতেন ফিকরু। বাকিদের থোড়াই পাত্তা। সে বার ম্যাচের আগেই টিম হোটেলে যেতে চান ফিকরু। কিন্তু সেখানে তাঁর জন্য জারি ৩৫৬ ধারা। সে একটা বিরাট টেনশন। যাই হোক ফিকরুকে টিম হোটেলে যেতে দেওয়া হল না। ম্যাচটাও জিতলেন হাবাস। সে বার মাঠ থেকেই তাঁকে ছুটতে হল হাসপাতালে। ম্যাচ চলাকালীনই বুকে ব্যথা অনুভব করছিলেন। চেক আপ করিয়ে যখন হোটেলে ফিরলেন, তখন গোটা টিম রয়েছে ডিনার রুমে। স্ট্যান্ডিং ওভেশন দেওয়া হল কোচকে। কেক কাটা হল। হাবাসের মুখে হাসি, মৃদু রসিকতা, ‘‘গোয়া মানেই দেখছি নাটক। প্রথম বার প্রায় জেলে যাচ্ছিলাম। আর এ বার হাসপাতাল।’’ নাটকের তখনও বাকি ছিল। ফিকরু কোচের সঙ্গে দেখা করলেন পর দিন সকালেই। দাবি, ফাইনাল খেলতে চান। কোচ অন়ড়। ততক্ষণে লুই গার্সিয়ার নেতৃত্বে কয়েকজন স্প্যানিশ ফুটবলার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, টিমে ফিকরু থাকলে তাঁরা নেই। হাবাস সবটা শুনলেন। ফিকরু ফাইনালের টিমে ছিলেন না। সম্ভবত ফিটনেসের কারণেই ছিলেন না। ফাইনালে হাবাসের
প্রথম ১৪-তে লুই গার্সিয়াও কিন্তু ছিলেন না। কারণটা হাবাসই বলতে পারবেন!

আসলে টিমে কে আছে, কে নেই এ নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই তাঁর। এ বারই যেমন পোস্তিগা, হোসেমি, জাভিলারা— টিমের তিন স্তম্ভ বিদায় নিল শুরুতেই। সেমিফাইনালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে বোরা ফার্নান্ডেজ আর নাটো নেই। হাবাসকে এ সব নিয়ে হা-হুতাশ করতে কেউ কোনও দিন দেখেছেন? না দেখিনি। আমাদের ফুটবল আবহে যেখানে ‘শুক্তোর মশলায় বিরিয়ানি রান্না হয় না’ এই মতবাদেই অভ্যস্ত সবাই। সেদিন হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ চালাচালির মাঝে ওঁকেই বলছিলাম সে কথাটা। ‘‘আমার বাবার খেলাধুলো নিয়ে এতটা আগ্রহ নেই। কিন্তু আপনার ব্যাপারে একটাই কথা বলেন। হাবাসকে দেখে সবার শেখা উচিত। নিজের হাতে যতটুকু রিসোর্স আছে, তার কী ভাবে অপটিমাম ব্যবহার করা যায়।’’ অনেক ধন্যবাদ দিয়ে যা বললেন, সেটাও একটা জীবনদর্শনই। ‘‘আসল হল কমন সেন্স। সেটা যত দিন তোমাকে চালনা করবে, তত দিন দেখবে কোথাও কোনও সমস্যা নেই...’’

মাঠের বাইরের লোকটাই মাঠের ভেতর অন্য রকম। অদম্য, একরোখা, জেদি, উদ্ধত— সব কিছু। এ বারও শেষ ম্যাচের পর চার ম্যাচের জন্য সাসপেন্ড হয়েছেন। আমি নিশ্চিত, মাদ্রিদের বাড়িতে ফিরে এখনও জাপানি রেফারির বাপান্ত করছেন এটিকে কোচ। গত বারই যেমন গোয়াতে রবার্তো পিরেজের সঙ্গে ঝামেলা করে চার ম্যাচের জন্য সাসপেন্ড হলেন। কোচিং সামলালেন গ্যালারি থেকে। ঠিক হল ম্যাচ দেখে তাঁর অবজার্ভেশন কোনও একটা চিরকুটে লিখবেন। আমাদের ম্যানেজমেন্টের একটি ছেলে সেটা কোনও ভাবে বিরতিতে ড্রেসিংরুমে পৌঁছনোর চেষ্টা করবে। সেই মতো একটি ছেলে বসল তাঁর পাশে। হাফটাইমের আগেই সে আতঙ্কিত। ‘‘দাদা, উনি চেয়ারে বসে যে ভাবে হাত-পা চালাচ্ছেন, তাতে তো ইনজিওর্ড হয়ে যাব।’’ আসলে পুরোটাই হল জয়ের জন্য প্রবল একটা আর্তি। প্রথম বছর কলকাতায় নেমে হুলিয়া জারি করলেন, ‘‘মিডিয়ার লোকজন ধারেকাছে যেন না থাকে।’’ মানতে পারছিলাম না। গিয়ে বললাম, ‘‘মিস্টার কোচ, এটা স্পেন নয় যে মিডিয়া ফুটবলারদের মতো হামলে পড়ছে। এখানে এমনিতেই ফুটবলের বিশেষ প্রচার হয় না। তার পর আমাদের নতুন ক্লাব। ব্র্যান্ড প্রোমোশনের অনেক রকম ব্যাপার থাকে। এগুলোও আপনাকে বুঝতে হবে।’’ একটু ভাবলেন। তার পর বললেন, ‘‘আমি বলব, আমাদের টুর্নামেন্টটা জিততে দাও। দেখবে, যা যা বলছ, তার কোনওটারই অভাব হবে না।’’ আর সেটা সত্যি করেও দেখিয়েছিলেন। জেতার বাসনাটা এতটাই উগ্র ওঁর।

এই মানসিকতাটাই ছ়ড়িয়ে দিয়েছেন গোটা টিমে। টিম এটিকে ব্র্যান্ডটাই ‘উইনিং ইজ এভরিথিং’-এর মার্গে বিচরণ করছে। সেমিফাইনালে হারের পর দিনই দেখেছিলাম এটিকে-সচিব সুব্রত তালুকদার তাঁর টিম নিয়ে বসে পড়লেন পরের বারের টিমবিল্ডিং মিটিংয়ে। হাবাস ফেরার আগে বসে প়়ড়লেন তাঁর সঙ্গে মিটিংয়ে। দিয়ে গেলেন তাঁর পছন্দের তালিকা। এ বার হয়নি তো কী হয়েছে! সামনের বার হবে। সামনের বার কিন্তু আবার জিততেই হবে। আর এই অদৃশ্য লড়ব-জিতব ট্যাগলাইনের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখটা এখন এটিকে কোচ নিজেই। ক্রমাগত হারতে থাকা, হেরিটেজ সিটি হওয়ার দিকে পা বাড়ানো শহরটার পালস্-টা বোধহয় তিনিই সবচেয়ে ভাল ধরতে পেরেছেন।

ল়ড়তে হবে-মারতে হবে-জিততে হবে — এই শহরটার জন্য। যে কোনও মূল্যে। ঠিক তাঁর মালিকের মতো। যিনি গোটা দেশকে শিখিয়েছিলেন, ক্রিকেট মাঠে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE