Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

একানব্বইতেও প্লে ব্যাক

ছয় বছর পরেও রিলিজ করল না মান্না দে-র গাওয়া শেষ প্লে ব্যাক সঙ্গীত, লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী একানব্বই বছর বয়সে মান্নাদা প্লে-ব্যাক করলেন ‘চামেলি-চন্দন’ ছবিতে। অনেকেই হয়তো এই লাইনটা আর একবার পড়বেন এই ভেবে যে, ছাপার ভুল নয় তো? ঠিকই আছে। ২০১০-এর প্রথম দিকে মান্নাদা শেষ বারের মতো গাইলেন সিনেমার গান—ভিক্টর ব্যানার্জি-র লিপে, ‘আমার ভারত, অমর ভারত’/ মানবপ্রেমের স্বর্গধাম’।

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

একানব্বই বছর বয়সে মান্নাদা প্লে-ব্যাক করলেন ‘চামেলি-চন্দন’ ছবিতে। অনেকেই হয়তো এই লাইনটা আর একবার পড়বেন এই ভেবে যে, ছাপার ভুল নয় তো? ঠিকই আছে। ২০১০-এর প্রথম দিকে মান্নাদা শেষ বারের মতো গাইলেন সিনেমার গান—ভিক্টর ব্যানার্জি-র লিপে, ‘আমার ভারত, অমর ভারত’/ মানবপ্রেমের স্বর্গধাম’।

উল্টোডাঙার ‘ধুন স্টুডিও’য় মান্নাদা এলেন সকাল এগারোটা নাগাদ। মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুর। মান্নাদা’র বহু কালজয়ী গানের সুরকার। বাকি সবাই প্রথম কাজ করছেন। গীতিকার তরুণ মল্লিককে বললেন, ‘‘গানের কথা ভালই লিখেছেন, তবে কয়েকটা শব্দ পরিবর্তন করতে পারেন কি না দেখুন। মনে হয়, তাতে বেটার হবে।’’ সত্যিই, মান্নাদার সাজেশনমত একটু ঘষামাজা করতেই কথাগুলো আরও জোরদার হল। সারা জীবন ধরে লাইভ রেকর্ডিং করেছেন। কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মান্নাদা তখন আগে থেকে তৈরি মিউজিক ট্র্যাকের সঙ্গে গাইছেন। এখানেও সে ব্যাপার। যন্ত্রসঙ্গীত পরিচালক রামকৃষ্ণ পাল টালিগঞ্জের ফিল্মসার্ভিস স্টুডিওতে আগেই এ গানের মিউজিক ট্র্যাক তৈরি করে রেখেছেন একটি ‘এফ’ আর একটি ‘এফ-শার্প’ স্কেলে। যাতে মান্নাদা পছন্দমত স্কেলে গাইতে পারেন। গানের সুর শুনলেন। পরিচালক সুব্রত লাহিড়ীর কাছ থেকে সিচ্যুয়েশন জেনে নিলেন। বহু দিনের সহযোগী এবং বন্ধু মৃণালদাকে পেয়ে মান্নাদাও খুব খুশি। চা-বিস্কুট খেতে খেতে বললেন, ‘‘মাঝেমাঝে মিউজিক ট্র্যাকের সঙ্গে গাইছি ঠিকই, কিন্তু এ ভাবে গাইতে আমার একেবারে ভাল লাগে না। কিছু জানলাম না, শুনলাম না। ধরে বেঁধে একটা মিউজিক দিয়ে দিলেন। গাইতেও হবে একদম মেকানিক্যালি, ইম্প্রোভাইজেশনে তাই আপনি আটকে যাচ্ছেন একটা লিমিটেশনের মধ্যে। কিন্তু কী আর করা যাবে। আমি রিজিড থাকলে তো নতুন গান আর গাওয়াই হয় না।’’ একটু থেমে মান্নাদা বললেন, ‘‘কিশোরের সঙ্গে ‘এক চতুর নার’ গানটার কথা ভাবুন। ছবিতে আপনারা একটা মজার দৃশ্যে গানটা শুনেছেন। ভাবতে পারবেন না, এর জন্য আমাদের ক’দিনের প্রিপারেশন ছিল। কিশোর, পঞ্চম, মেহমুদ আর মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে দিনের পর দিন রিহার্সাল। এ ভাবেই তো এক-একটা ভাল গান তৈরি হয়। এত পরিশ্রম ছিল বলেই মানুষ এখনও ওই সব গান শোনে।’’

মান্নাদা’র শরীরটা খুব একটা ভাল ছিল না। নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, অন্য কোনও শিল্পী হলে সে দিন রেকর্ডিং ক্যানসেল করতেন। আগেও লিখেছি, মান্নাদা নিজেকে নিয়ে কম ভাবতেন। সব সময় তাঁর চিন্তা থাকত, অন্য কারও যেন ক্ষতি না হয়। শুটিংয়ের শিডিউল ঠিক হয়ে আছে, আবার কবে কলকাতা আসবেন তার নিশ্চয়তা নেই। মান্নাদা ঠিক করলেন: যত কষ্টই হোক, তিনি সে দিনই গানটি রেকর্ড করবেন। আপার স্কেলটাই পছন্দ করলেন— মান্নাদা যেমনটা করেন। গানটাকে অন্তরে গেঁথে নিয়ে, গাইলেন প্রাণ ঢেলে। সবাই নির্বাক। কাউকে কিছু বলতে হল না। এক ঘণ্টার মধ্যেই রেকর্ডিং শেষ। একানব্বই বছরে প্লে-ব্যাক! আমি নিশ্চিত, ভারতে এমন ঘটনা আগেও ঘটেনি, পরেও ঘটবে না। কেউ কি জানাবেন—পৃথিবীতেও এমন ঘটনা আর ঘটেছে কি না!

মান্না দে কিনা তাঁর লেখা গান গেয়েছেন! এ নিয়ে মান্নাদার কোনও রিজার্ভেশন না থাকলেও আনন্দে গীতিকার তরুণ মল্লিকের চোখে জল! বোধহয় নজর এড়ায়নি মান্নাদা’রও। যাওয়ার সময় গীতিকার তরুণ মল্লিক এবং মিউজিক অ্যারেঞ্জার রামকৃষ্ণকে ডেকে বলে গেলেন—‘‘ভারত আমার ভারতবর্ষ’র মতো এই গানটাও সবাই শুনবে।’’ আর মৃণালদাকে মজা করে বললেন, ‘‘আমরা দু’জন ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডও পেতে পারি। হা-হা-হা!’’

দুঃখের কথা কী জানেন? আজ ছ’বছর হয়ে গেল, ছবিটার কাজ এখনও শেষ হল না। মান্নাদার গাওয়া সিনেমার সেই শেষ অসাধারণ গান কেউ আর শুনতে পেল না।

মান্নাদা কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজেকে। এই পথ চলা যে কত কষ্টকর তিনি ভাল করেই জানতেন। শুনলে হয়তো অবাক লাগবে, কিন্তু সত্যি বলতে কী— মান্নাদা কখনও চাইতেন না, তাঁর নিকটজন কেউ এই অনিশ্চিত প্রফেশনকে আশ্রয় করুক। স্বপ্নের কথা তিনি জানতেন ঠিকই, আবার পাশাপাশি এটাও বুঝতেন, স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা কতটা কষ্টকর। রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তখন এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের মেধাবী ছাত্র। কিন্তু আসল নেশাটা গানে। তবলায় তালিম নিয়েছেন স্বয়ং রাধাকান্ত নন্দীর কাছে। গানটাও ভালই করেন। আর সময় পেলেই ছুটে আসেন মান্নাদার কাছে। রজতের চোখ যতই কেতাবি ডাক্তারি বইয়ের দিকে থাকুক না কেন, মন পড়ে থাকে মদন ঘোষ লেনে মান্নাদার বাড়িতে। কবে তিনি আসবেন! মান্নাদা তো মানুষের মন পড়তে পারেন। একদিন রজতকে বললেন, ‘তুমি ডাক্তারিটা ভাল করে পড়ো। ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করতে হবে। তোমার মতো ক’জন ডাক্তারি প়ড়ার সুযোগ পায় বলো? এই গান গান করে নিজের কেরিয়ারটা নষ্ট কোরো না। তা ছাড়া একটা ব্যাপার মনে রাখবে, তোমার মা-বাবার কিন্তু তোমার উপর অনেক আশা।’’ সে দিন মান্নাদার ওই কথা শুনে রজতের হয়তো একটু দুঃখ হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে যখন ইংল্যান্ডে ওই ডাক্তারিতেই খুব নাম করে সেখানেই সেটল্‌ড হন রজত, মনে মনে প্রণাম করেছিলেন মান্নাদাকে। শুধু মান্নাদার একটি উপদেশেই যে উনি এ ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন জীবনে! কিন্তু রক্তে গানের নেশা থাকলে সে কি যায় কখনও? মান্নাদার গাওয়া কয়েকটা গানই নিজে গেয়ে রেকর্ড করে পাঠালেন মান্নাদার কাছে। আর তার পর দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা। ফোন এল অবশেষে কয়েক দিন পরে, এবং স্বয়ং মান্নাদার কাছ থেকেই—‘ইয়েস রজত, ইউ হ্যাভ ডান ইট ইন রাইট টাইম। ডাক্তারিটা কমপ্লিট করেছ, কাজেই এ বার তোমার গান আমি মন দিয়ে শুনলাম। এ ভাবেই গেয়ে যাও। কারও সঙ্গে কোনও কম্পিটিশন নয়, শুধু নিজের জন্যই গেয়ে যাও। কোনও অর্কেস্ট্রেশন রেখো না। এতেই আনন্দ পাবে বেশি।’ রজতশুভ্র ইংল্যান্ডে, মান্নাদা এখানে—ফোনে ফোনে তালিম দিতেন। ভাবতে পারেন? এই হল মান্নাদা!

মাঝে মাঝে কাগজে এবং পত্র-পত্রিকায় ছবি দেখি কোনও সেলিব্রিটি দুঃস্থ কোনও শিল্পীকে চেক দিচ্ছেন সাহায্য হিসেবে। পরিমাণ কত বোঝা যায় না, চেক-টা ক্যাশ হল কি না, তাও জানা যায় না। শুধু ঢাকঢোল পিটিয়ে সাংবাদিকদের আগে থেকেই খবর দেওয়া থাকে। কাগজে কাগজে সেই ছবি—শিল্পীর ভাঙাচোরা মুখ আর দাতা-সেলিব্রিটির তৃপ্তির হাসির ছবি বেরোয়। বর্তমান ঘটনাটি মান্নাদার এক শুভানুধ্যায়ীর কাছে শোনা। যদও তিনি মান্নাদার কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এই ঘটনাটি কোনও দিন কারও কাছে বলবেন না। কিন্তু মান্নাদা চলে যাওয়ার পরে একদিন এক আবেগঘন মুহূর্তে সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রাখতে পারেননি। মান্নার এক সিনিয়র পারকাসনিস্ট বেশ কিছু দিন ধরে অসুস্থ। আর বাজাতেও পারেন না। কারও কাছে মান্নাদা শুনেছিলেন, সেই শিল্পী খুবই আর্থিক কষ্টে আছেন। এর পর যখন কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে এলেন মান্নাদা, সেই শুভানুধ্যায়ী ভদ্রলোকের কাছে বেশ মোটা অঙ্কের টাকার একটা খাম দিয়ে, ওই প্রবীণ যন্ত্রশিল্পী ভদ্রলোককে দিয়ে আসতে বললেন। হ্যাঁ, মান্নাদা ওঁকেও একটি কঠিন শর্ত দিয়ে রেখেছিলেন বইকী। এবং তা এই যে, মান্নাদার এই টাকা পাঠানোর কথাটা যেন কেউ কোনও দিন জানতে না পারে! ‌

মান্নাদা ছিলেন ঈশ্বরের মতো। প্রতিদানের আশা না রেখে, সময়ে-অসময়ে অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন নীরবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE