প্রথম বার হেমাকে দেখে আমিও হা হয়ে গিয়েছিলাম। মুখে এতটুকু মেকআপ নেই, তবু যেন পর্দার থেকেও সুন্দর দেখাচ্ছিল হেমাকে। ফোটোশ্যুটের পুরো শিডিউলটাই দেখছিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আর প্রতিটা পোশাকের সঙ্গেই একটা করে পরচুলা বেছে রাখছিলেন। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত উইগ দিয়ে কী হবে! তাঁর নিজের চুলই তো যথেষ্ট। হেসে আমাকে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘উইগ পরাটা আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। শুধু লুক পাল্টানোর জন্য নয়, নিজের চুল বাঁচানোর জন্য। শ্যুটের ওই চড়া আলো আর আউটডোর শ্যুট হলে ধুলো — ওগুলো চুল খারাপ করে দেয়।’’
তার পর যত বার সাক্ষাৎকারের জন্য ওঁর কাছে গেছি, তত বারই অবাক হয়েছি। সব সময় নতুন নতুন অনেক কিছু শিখেছি ওঁর কাছে। একবার গেছি, হেমা তখন মায়ের ভূমিকায়। এষা আর অহনার পিছনে পিছনে গোটা ড্রয়িং রুম জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন। ডিম খাওয়ানোর জন্য আর পাঁচটা মায়ের মতো ঝুলোঝুলি করছেন বাচ্চার কাছে। আর সে কাজ করতে পেরে হাসিতে ঝলমল করে উঠছে হেমার মুখ। বলছিলেন, ‘‘আমি ভেজ খেলে কী হবে, মেয়েদের খাবারে ডিমটা দিই। যাতে ওদের ডায়েটে কোনও কমতি না থাকে। (হেসে) ওদের বাবা তো পাক্কা নন-ভেজিটেরিয়ান।’’
সত্যিই, সুপুরুষ ধর্মেন্দ্রকে আগলেও রাখতেন হেমা। প্রযোজক গুলশন রাইয়ের সঙ্গে একবার আলাপ হয়েছিল। এষার জন্মদিনের পার্টি থেকে ফিরছেন। হাতে দেখলাম একটা উপহারের বাক্স। গুলশন নিজেই হাসতে হাসতে জানিয়েছিলেন, ‘‘হেমা আর ধর্মেন্দ্রর জন্য শ্যাম্পেন নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু হেমা নিল তো না-ই, বরং আমার হাত দিয়েই বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। ধর্মেন্দ্র যাতে বেশি মদ না-খায়, সে দিকে কড়া নজর হেমার!’’
আর একদিন কথা হচ্ছিল হেমার সঙ্গে। ড্রয়িং রুমে বসে বলছিলেন এষা বা অহনার পড়াশোনার খুঁটিনাটি ব্যাপারেও কতটা নজর তাঁর। ‘‘স্কুলের সব মিটিংয়ে যোগ দিই। ওদের হোমওয়ার্ক দেখিয়ে দিই। কিন্তু কী করব, লোকে তো আর আমাকে বউ বা মা হিসেবে দেখেই না! শুধু আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। একবার সেনাবাহিনীর স্ত্রীদের এক ফাংশনে গিয়েছিলাম। আমি যতই সাধারণ কথাবার্তা বলতে যাই না কেন, ওরা খালি জানতে চাই আমার সিনেমা নিয়ে! উফ্... কী বোরিং!’’
একটা ঘটনা তো আমি জীবনে ভুলব না। একবার ঠিক করেছিলাম হেমা আর ডিম্পল — দু’জনকে একসঙ্গে নিয়ে ফোটোশ্যুট করব। দু’জনেই তো দুই ‘দেওল’য়ের সঙ্গে যুক্ত — ধর্মেন্দ্র আর সানি। কিন্তু ওঁদের নামই প্রথমে আসে। যখন আমি ইন্টারভিউয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্য হেমার বাড়ি গেলাম, দেখলাম ড্রয়িংরুমে বসে আছেন ধর্মেন্দ্র। হেমা উপরের তলায় নিজের ঘরে। ধর্মেন্দ্র এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। আমার তো গলা শুকিয়ে কাঠ। ইন্টারভিউয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে কী বলব! আমার ভয় সত্যি করে প্রশ্নটা করলেনও ধর্মেন্দ্র।
কোনও মতে তোতলাতে তোতলাতে কিছু একটা বললাম। সত্যি কথাটা বলার সাহস আমার ছিল না। ধর্মেন্দ্র বুঝলেন কি না কে জানে, মিষ্টি করে বললেন, ‘‘যাই হোক না কেন, যা লেখো, ভাল লিখো। ম্যাগাজিনটা যেন কফি টেবিলে রেখে দিতে পারি।’’
ধর্মেন্দ্র চলে গেলে আমি উপরের তলায় হেমার কাছে গেলাম। হেমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী বলছিল?’’ আমি বললাম যে, ধর্মেন্দ্রকে বলতে পারিনি হেমা আর ডিম্পলকে নিয়ে লিখছি। হেমা হেসে বললেন, ‘‘ভালই করেছ। আমিও সব কিছু ওকে জানাই না। যখন আর্টিকলটা বেরোবে তখন দেখতে পাবে। আমি ভুল তো কিছু করছি না!’’ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে হেমা বরাবর গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন।
কিন্তু ডিম্পলকে খুবই পছন্দ করতেন হেমা। বলছিলেন, ‘‘রাজেশ খন্না তো সহ-অভিনেতা। তো যখন শুনলাম ডিম্পলের বাচ্চা হবে, দেখতে গিয়েছিলাম ওকে। কিন্তু দেখে
অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ডিম্পল নিজেই তো বাচ্চা। তার আবার বাচ্চা হবে কি!’’ এটাও বলছিলেন, ডিম্পলের সঙ্গে থাকার সময়টাই রাজেশের জীবনের সেরা সময় ছিল। ‘‘ওদের ছাড়াছাড়ির পর যখন রাজেশের সঙ্গে দেখা হয়েছিল,
আমার মনে হল রাজেশ খন্না কোথায়! এ তো পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়ানো একটা লোক।’’
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে হয়েছে দেব আনন্দের ছবিতে হেমাকে কেন অন্য রকম লাগে? গোপন কথাটা এখানে ফাঁস করছি। আসলে, দেব আনন্দ ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজনের একজন যে হেমাকেও ‘বুলি’ করতে পারে। ‘‘আরে, দেবসাব যা খুশি তাই করতে বলে। কিন্তু কী করব! দেবসাব তো! পর্দায় অদ্ভুত দেখতে লাগবে জানি, কিন্তু দেবসাবকে না বলতে পারতাম না,’’ স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে বলছিলেন হেমা।
সবাই জানে, হেমার কেরিয়ারে সব কিছু কেমন নিজের হাতে যত্ন করে গুছিয়ে রাখতেন হেমার মা জয়া চক্রবর্তী। কিন্তু অনেকেই জানেন না, হেমার জীবনে আরও দু’জন অপ্রশংসিত হিরো ছিলেন। একজন, হেমার কাকিমা, শান্তা। যিনি হেমার পাশে ছিলেন সব সময়, আর যাঁকে ছাড়া হেমা কিছুই করতে পারতেন না। আর অন্যজন হলেন হেমার বাবা ভিএসআর চক্রবর্তী, যিনি হেমাকে দিয়েছিলেন ওঁর কঠিন ব্যক্তিত্ব। বাবার থেকে হেমা জীবনের প্রায় সবক্ষেত্রেই উপদেশ নিতেন, ভালবাসতেন খুব বাবাকে।
ভিএসআর মারা যাওয়ার পর, সেটাই মনে হয় হেমা সব থেকে বেশি মিস করেন। এত দিন দেখার পর এটাই বুঝেছি, ওঁর কাছে আপনি মাত্রা ছাড়াতে পারবেন না।
তবুও প্রাথমিক জড়তাটা কাটিয়ে উঠতে পারলে দেখবেন, হেমা মালিনী সাঙ্ঘাতিক বাস্তব ও মাটির কাছাকাছি থাকা একজন মানুষ।
যে বয়সে সহজেই সকলের মাথা ঘুরে যায়, সেই বয়সে ‘ড্রিম গার্ল’ নাম পেয়েও হেমার কিন্তু মাথা ঘুরে যায়নি। বরং ভিতরের মানুষটা থেকে গেছে একই রকম।
অভিনেত্রী, কন্যা, মা, স্ত্রী, নৃত্যশিল্পী, এমনকী পরিচালক — জীবনের প্রত্যেকটা ভূমিকা পালন করেছেন নিখুঁতভাবে, নিজের সবটা দিয়ে। তবু ডাকসাইটে ব্যক্তিত্বটা রয়ে গিয়েছে অটুটভাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy