Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘বড় বড় দাবি আমি করি না’

সেই সঙ্গে প্রচারের পিছনে ছুটতেও তাঁর ঘোরতর অনীহা। তিনি তরুণ মজুমদার। তাঁর ছবি নিয়ে বাঙালি আজও নস্ট্যালজিকসেই সঙ্গে প্রচারের পিছনে ছুটতেও তাঁর ঘোরতর অনীহা। তিনি তরুণ মজুমদার। তাঁর ছবি নিয়ে বাঙালি আজও নস্ট্যালজিক

তরুণ মজুমদার

তরুণ মজুমদার

পারমিতা সাহা
শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৬:২০
Share: Save:

প্র: তরুণ মজুমদারের ছবি মানেই সাহিত্যনির্ভর ছবি... সেটা ‘ভালবাসার বাড়ি’ হোক বা ‘দাদার কীর্তি’, ‘গণদেবতা’... গল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে কী কী বিষয় আপনার কাছে গুরুত্ব পায়?

উ: এক একটা গল্পের জন্য এক এক রকম ভাবনা। তবে আমার ছবিতে সব সময় একটা আশার আলো দিতে চেষ্টা করেছি। আসলে জীবনকে পরিপূর্ণ ভাবে দেখতে গেলে কুড়িটা চোখ দরকার। সাহিত্যিকরা প্রকৃতি ও মানুষকে কোন অ্যাঙ্গেলে দেখেছেন, তা জানতে পরিচালককে ক্রমাগত পড়ে যেতে হবে। তবেই না সে জীবনকে বুঝতে পারবে।

প্র: আপনার এমন অনেক ছবিই আছে, যেখানে মূল কাহিনি শেষ, সেখানে আপনার ছবি শুরু...

উ: গল্প পড়ে কোথাও একটা ভাল লাগা তৈরি হয়। মনে হয় এই গল্পে ছবি হতে পারে, কিন্তু তা বাড়াতে হবে। ‘দাদার কীর্তি’তে কেদার চরিত্রটা আসলে ছিল উপরচালাক ধরনের, আমি তাকে বদলে দিয়েছিলাম। ‘পলাতক’ গল্পটা যেখানে শেষ, সেখানে আমার ছবির ইন্টারভ্যাল। তার পর পুরোটা বাড়ানো। সে জন্য প্রথম থেকেই আরও কিছু নতুন চরিত্র যোগ করতে থাকি, যা নিয়ে গল্প বুনতে বুনতে সেকেন্ড হাফে চলে যাই। ‘বালিকা বধূ’র চিত্রনাট্য যখন চিফ টেকনিশিয়ানদের সামনে পড়লাম, তখন অনেকেই আমাকে বলল, ‘কী আছে এর মধ্যে?’ একটা তেরো বছরের মেয়ের সঙ্গে সতেরো বছরের ছেলের বিয়ে, মেয়েটি শুধু বাপের বাড়ি চলে যেতে চায়। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল এর মধ্যে এমন একটা মাধুর্য আছে, যা নিয়ে ছবি হতে পারে। শুধু আমার আর্ট ডিরেক্টর বংশী (চন্দ্রগুপ্ত) বলেছিল, ‘আপনি যদি এই ছবিটা না করেন, জীবনে আপনার সঙ্গে ছবি করব না।’ আবার ‘সংসার সীমান্তে’ গল্পটির শেষে ছিল অসীম হতাশা। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, শেষে মানুষের বেঁচে থাকার খোরাক রেখে যাব। এক দৈনিকে প্রচেত গুপ্তর ‘ভালবাসার বাড়ি’ গল্পটা পড়ে ভাল লাগে। তাই ছবিটা বানালাম।

প্র: মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, মহুয়া রায়চৌধুরী, তাপস পাল, দেবশ্রী রায়... কত অভিনেতা আপনার হাত ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেছেন...

উ: হ্যাঁ। মৌসুমী যখন ‘বালিকা বধূ’ করে, তখন ওর বয়স তেরো। ওর মধ্যে অদ্ভুত প্রাণচঞ্চলতা ছিল। যা বলতাম, চট করে তুলে নিত। খুব দুষ্টুও ছিল। বহু বার এমন হয়েছে, ফ্লোরে শুটিং চলছে, ও দুষ্টুমি করছে। এক কোণে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। যখন শট, তখন ওকে ডেকে নিয়ে শুটিং করাচ্ছি। করতে করতে ব্যাপারটা এমন হল যে, শট দিয়ে ও নিজে থেকেই ওই জায়গায় গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে পড়ত। এগুলোই ছিল ওর সরলতার প্রতীক। ‘কুহেলি’তে দেবশ্রী যখন কাজ করে, তখন ওর বয়স আড়াই-তিন বছর। আমার আর সৌমেন্দুর (রায়) কোলে কোলে ঘুরত। তার পর আবার ‘দাদার কীর্তি’-তে কাজ করে। এই ছবিতেই তাপসের আগে প্রায় তিরিশ জনের অডিশন নিয়েছিলাম। তার পর আমার এক সহকারী একদিন চন্দননগর থেকে তাপসকে নিয়ে এল। ওকে দেখে মনে হল, অভিনয় না করেও অনেক কিছু প্রকাশ করা যায়, ওর মধ্যে সেই জিনিসটা আছে। আমি দু’দিন ওকে আমার টেবলের উল্টো দিকে বসিয়ে রেখেছিলাম। কোনও কথা বলিনি। শুধু ওর হাবভাব খেয়াল করছিলাম। তার পর ওকে নিই। ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এ আবার মহুয়ার চরিত্রটায় অন্য আর এক জনের অভিনয় করার কথা ছিল। কিন্তু মহুয়াকে দেখেই মনে হয়েছিল, চোখ দুটো ভারী অদ্ভুত! তার পর ওকেই সিলেক্ট করি। আসলে মহুয়ার মধ্যে যা ছিল, তা অন্য কারও মধ্যে ছিল না। ‘দাদার কীর্তি’তে হিরোর সঙ্গে ওর বেশি কথা নেই। শুধু সাইলেন্ট অ্যাটিটিউড। একজন আর্টিস্টকে বোঝা যায়, এ সব থেকেই।

প্র: আপনার ছবিতে রবীন্দ্র সংগীতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

উ: আমি ছবিতে প্রথম রবীন্দ্র সংগীত ব্যবহার করি ‘কাঁচের স্বর্গ’ ছবিতে। তখন রবীন্দ্র সংগীতের কথা শুনলে ডিস্ট্রিবিউটররা আঁতকে উঠতেন, অত আস্তে গান চলছে। দেখা গেল, দর্শক গানগুলো খুব ভাল ভাবে নিচ্ছেন। গান আমার ছবিতে চিত্রনাট্যের অংশ হিসেবে আসে। সাধ্য-বুদ্ধি মতো ছবিতে ফোক, অতুলপ্রসাদ, ডি এল রায়, মুকুল দত্তের গান ব্যবহার করেছি।

প্র: আপনার শেষ কয়েকটি ছবি দেখে অনেকেরই মত, তাতে যেন ফেলে আসা সময়ের হাতছানি...

উ: দেখুন, আধুনিক কাকে বলে তা নিয়ে আমার একটা মত আছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘সেটাই আধুনিক যেটা চিরকালীন’। আমিও তাতে বিশ্বাস করি। আমার আধুনিকতা ইউনিভার্সাল।

প্র: এত বছর ধরে ছবি বানিয়ে গেলেও আপনি প্রচারের আলো থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। এর কি কোনও কারণ আছে?

উ: প্রচারের জোরে অনেকের ভাল হয় ঠিকই। কিন্তু প্রচারের পিছনে না ছুটেও দর্শকের মনে বেঁচে থাকতে পারি কি না, আমি এই পরীক্ষাটা করে যেতে চাই। টিভিতে বাইট দিই না। অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো ডেকেছিল, আমি যাইনি। ফিল্মি পার্টিতে আমাকে দেখতে পাবেন না। এতে আমার কোনও ক্ষতি হয়নি। আমি নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার। বড়-বড় দাবি আমি করি না। খুব সাধারণ ভাবে ছবি তৈরির চেষ্টা করেছি। আর দর্শক আমাকে সমর্থন করেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

তরুণ মজুমদার Tarun Majumdar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE