Advertisement
০৫ মে ২০২৪

বদলে যাওয়া মেয়েবেলা

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে অপ্রতিরোধ্য মেয়েদের কথা। মধুমন্তী পৈত চৌধুরীর কলমে।ভারতীয় নারী বললে কোন্ কোন্ ছবি আপনার মাথায় আসে? পতিব্রতা সহধর্মিণী না কি ‘কয়’ গার্লফ্রেন্ড, না কি মাদার ইন্ডিয়া? বিয়ে, স্বামী-সংসার আর মাতৃত্ব যদি ভারতীয় নারীর পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়, তবে এই সবটাই এখন ক্লিশে। চেনা সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির চোখ রাঙানিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নতুন সমাজের জেহাদ ঘোষণা করেছেন ভারতীয় মহিলাদের একাংশ।

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৬ ০০:০৮
Share: Save:

ভারতীয় নারী বললে কোন্ কোন্ ছবি আপনার মাথায় আসে? পতিব্রতা সহধর্মিণী না কি ‘কয়’ গার্লফ্রেন্ড, না কি মাদার ইন্ডিয়া? বিয়ে, স্বামী-সংসার আর মাতৃত্ব যদি ভারতীয় নারীর পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়, তবে এই সবটাই এখন ক্লিশে। চেনা সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির চোখ রাঙানিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নতুন সমাজের জেহাদ ঘোষণা করেছেন ভারতীয় মহিলাদের একাংশ। আগেও করেছেন, এখনও করছেন। নিজ নিজ সময়-স্থান-কাল-পাত্রের নিরিখে। তবে নারীর দায়বদ্ধতা শুধু সামাজিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। রাজনীতির মঞ্চেও সে সমান ভাবেই উজ্জ্বল। ফিরে দেখা যাক তাঁদের এক ঝলক!

ষাট হয়েছে? বিয়ে করুন

পাত্র টল, ডার্ক হলেও, বিয়ের বাজারে পাত্রী কিন্তু চাই ফর্সা, তন্বী।. এই স্টিরিওটাইপ ধারণার শিকড়ে নাড়া দিতেই নন্দিতা দাসের ক্যাম্পেন ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’। নিজেকে ফর্সা দেখানোর জন্য বলিউড অভিনেত্রীরা যখন নানা এক্সপেরিমেন্টে ব্যস্ত, বিজ্ঞাপন করেন নানা ফেয়ারনেস ক্রিমের, এই অভিনেত্রী তখন নিজের ডক্টরেট বোনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে সমাজকে বললেন, ‘‘পুরুষদের দোষ দিয়ে কি লাভ? আমরাই তো এই ট্রেন্ড শুরু করেছি।’’

পাত্রী যদি রূপবতীও হয়, বয়স ত্রিশ ছুঁইছুঁই করলেই ভাঁজ পড়ে হবু শ্বশুরশাশুড়ির কপালে। মাথা নামায় মেয়ের বাবা। তবে ‘এজ ইজ জাস্ট আ নাম্বার’ মুখে বলা যত সহজ, কাজে নয়।.ষাট বছরেও নতুন ইনিংস শুরু করা যে শুধু পুরুষের কাজ নয়, বুঝিয়েছেন মরাঠি অভিনেত্রী সুহাসিনী মুলে। সোশ্যাল মিডিয়ায় খুঁজে পেয়েছেন তাঁর জীবনসঙ্গীকে। সেলুলয়েডে ঠাকুমা-দিদিমার চরিত্রে অভিনয় করলেও, তিনিই বলতে পারেন ‘সিক্সটি ইজ দ্য নিউ থার্টি।’

সিঙ্গল মাদার

আশির দশকে কুমারী অবস্থায় মা হয়েছিলেন নীনা গুপ্ত। তারকা ক্রিকেটার ভিভিয়ান রিচার্ডকে বিয়ে না করেই তিনি বড় করে তুলেছেন কন্যা মাসাবাকে। ২০১৫ সালে কুমারী মায়ের একক অভিভাবকত্বের আইনি স্বীকৃতি এলেও, ‘সাঁস’ ধারাবাহিকের এই জনপ্রিয় অভিনেত্রীর কাছে বাধা হয়নি সমাজ বা আইন।

২৫ বছর বয়সে কেরিয়ার সামলে বাচ্চা? অনেক চাকুরিরতা মহিলার আপত্তির বিষয়! তবে এই বয়সেই কন্যা রেনিকে দত্তক নিয়েছিলেন বিশ্বসুন্দরী সুস্মিতা সেন।. বছর দশেক পরে তিনি দত্তক নেন আর এক কন্যা আলিশাকে। ভারতে সেলিব্রিটি সিঙ্গল মাদারের তালিকায় সুস্মিতার নামের পাশে আছে আরও এক বলিউড অভিনেত্রীর নাম। রবিনা টন্ডন, ২১ বছর বয়সে তিনি দত্তক নিয়েছিলেন দুই কন্যা পূজা ও ছায়াকে। সম্প্রতি এক কন্যার বিয়েও দিলেন নব্বইয়ের সেক্সি সিরিন।

বিয়ের আগেই প্রেগনেন্ট হয়েছিলেন অভিনেত্রী কঙ্কনা সেনশর্মা। কোনও রকম রাখ়়ঢাক না করেই মিডিয়াকে জানিয়েছিলেন সে কথা।

আইভিএফের সাহায্যে এখন মা হন অনেক মহিলাই। সেলিব্রিটি মহিলাদের মধ্যে সম্ভবত প্রথম পরিচালক ফারহা খান এই চিকিত্সার সাহায্য নিয়েছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি জন্ম দেন ট্রিপলেটের।

মাতৃত্ব বদলায়নি। কিন্তু এই মহিলারা পাল্টেছেন তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জটিল সামাজিক সমীকরণ।

প্রতিবাদ গ্রাস-রুট লেবেলেও

যদি বলেন, নিয়ম ভাঙার সাহস দেখান শুধু সমাজের প্রিভিলেজড মহিলারা, সেটা কিন্তু পুরোটা ঠিক নয়। আর্থিক-সামাজিক-শিক্ষা-সংস্কারের বৈষম্যকে পিছনে ফেলে এগিয়ে এসেছেন সম্পত পাল, ভানওয়ারি দেবী, সুনীতা কৃষ্ণন। গুলাবি গ্যঙের নেত্রী সম্পত পাল। উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখন্ডের গ্রামে লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে তিনি ও তাঁর দল পথে এনেছেন সে সব স্বামীদের যাদের অত্যাচারের শিকার হত গ্রামের সাধারণ বউ-মেয়েরা। ১৬ বছর বয়সে গণধর্ষণ করা হয়েছিল সুনীতা কৃষ্ণনকে। তার পর থেকে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় পাচার হওয়া মেয়েদের পুনর্বাসনের কাজ করছেন। বার বার প্রাণনাশের হুমকি উপেক্ষা করেও। রাজস্থানের ভানওয়ারি দেবী শিশু বিবাহের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন।.পরিণতি গণধর্ষণ। কিন্তু সেই যন্ত্রণা ছিনিয়ে নিতে পারেনি প্রতিবাদের ভাষা, দমিয়ে রাখতে পারেনি তাঁকে।

হোয়াই শুড বয়েজ হ্যাভ অল দ্য ফান?

অ্যাডভেঞ্চার কি শুধু পুরুষের বিলাসিতা? ভারতের স্টিরিওটাইপ মহিলাচিত গুণের মধ্যে কিন্তু তা পড়ে না। তা হলে শুনুন এঁদের কথা। ইশিতা মালব্য ভারতের প্রথম মহিলা সার্ফার। ট্যান হওয়ার ভয়কে তোয়াক্কা না করে ২৫ বছরের এই তনয়া ডুব দিয়েছিলেন সাগরের সেই অতলে যা কি না ‘মেল ডোমেন’ বলেই পরিচিত। বাইকে চড়ে কন্যাকুমারী থেকে লেহ্‌ ভ্রমণ করে লাইমলাইটে এসেছেন রোশনি শর্মা। পাহাড় হোক কি হিমবাহ, গিরিখাত হোক বা চড়াই- ডর কে আগে জিত হে, এটাই ছিল রোশনির মন্ত্র। তবে অনুপ্রেরণা আগেও ছিল। প্রথম ভারতীয় মহিলা বাচেন্দ্রি পাল ১৯৮৪ সালে এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখেছিলেন। এখন তিনি ছোট ছোট মেয়েদের প্রশিক্ষণের কাজে ব্যস্ত।

লড়াই জারি

মাওবাদীদের সাহায্য করার অভিযোগে ছত্তীসগঢ় পুলিশের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন আদিবাসী স্কুল শিক্ষিকা সোনি সোরি। পরবর্তী কালে তিনি রাজনীতিতেও আসেন। আছে ভয়, শাসানি আর হুমকি। তবে থামেনি লড়াই।

১৪ বছরের অনশন ভাঙেনি মণিপুরের ‘লৌহ মানবীর।’ ইরম শর্মিলা নামে যাঁকে আমারা চিনি। ‘এএফএসপিএ’ রদ করার জন্য তাঁর লড়াই চলছে। মহিলা মানেই কি ‘উইকার সেক্স?’ শারীরিক ক্ষমতার পরীক্ষায় পুরুষদের টেক্কা দিয়েছেন ভারতীয় সেনাবিভাগের প্রথম মহিলা কমব্যাট সেনা শান্তি টিগ্গা। তখন তাঁর বয়স ৩৫, দুই সন্তানের মা।

ভাবে ও ভাবতে শেখায়

ছবির তাগিদে নেড়া হওয়া বা নিজের স্বাধীন চিন্তাকে অ্যাওয়ার্ডের মঞ্চেও তুলে ধরতে পারেন ভারতের খুব কম বলিউড অভিনেত্রী। শাবানা আজমি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ‘ফায়ার’ ছবিতে সমকামী কিংবা ‘সতী’ ছবিতে মূক গ্রাম্য মহিলার চরিত্রে তাঁর অভিনয় যতটা অনবদ্য, ততটাই সমুজ্জ্বল তিনি পর্দার বাইরেও। মহিলাদের অধিকার, সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে সব সময় সরব তিনি। কিছুটা তাঁরই উত্তরসূরি বলা যায় আজকের প্রজন্মের অভিনেত্রী কলকি কোয়েচিলিনকে। পর্দায় তিনি লায়লা, আর পর্দার বাইরে সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি নারীবাদী। একাঙ্ক অভিনয় ও নিজের লেখা কবিতার মধ্যে দিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন মিডিয়ার নারী দেহ প্রদর্শনের হিপোক্রিসি, সমাজের নারীদের প্রতি হিপোক্রিসি।

আমার শরীর, আমার যৌনতা

যৌনতা নিয়ে যে মেয়ে কথা বলে, সে সর্বনেশি. আর যে ছবি আঁকে, সেও বা কম কি! ভারতের ফ্রিদা কাহলো নামে পরিচিত শিল্পী অমৃতা শেরগিল ছিলেন এক মুক্তমনা। নারী-পুরুষের প্রতি তাঁর ভালবাসা তিনি সর্বসমক্ষে স্বীকার করেছেন।. সালটা ছিল ১৯০০। ইতালি থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই শিল্পীর আঁকা ছবিতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছিল। ছবিতে নগ্ন নারী অবয়ব তুলে ধরতেও পিছপা হননি তিনি।

বেঁচে আছি নিজের জোরেই

১৫ বছর বয়সে অ্যাসিডে ঝলসে গিয়েছিল মুখটা। তবে সেই ঝলসে যাওয়া মুখটাই সৌন্দর্যের প্রতীক, সাহসের প্রতীক, আর অন্যদের বাঁচিয়ে রাখার ভরসা। লক্ষ্মী শা, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ডিরেক্টর। কাজ করেন অ্যাসিডে আক্রান্ত মহিলাদের জন্য। শীর্ষ ফ্যাশন ব্র্যান্ডের মুখ হয়েও, লক্ষ্মী বাঁচেন নিজের শর্তে। রূপে-গুণে তিনি স্বামী সোহাগিনী লক্ষ্মীই বটে!

এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এমন মেয়ে ও মহিলাদেরই কথা উঠুক কফিশপে, পিত্জা ঠেকে বা অফিস ক্যান্টিনে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE