Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

বড় ঘড়ির ডাক

যুগ যুগ ধরে দেখা-না দেখার যত গল্প স্টেশনের ভিড়ে। বুড়ো ঘড়িটার জোড়ামাথার নীচে। কান পাতলেন ঋজু বসুতেপান্তরের মাঠ বা ময়নামতীর পথের ধার নয়! শেষমেশ শিকে ছিঁড়ল ওই বড় ঘড়ির কপালে। কী যেন এক পত্রিকায় দিল্লিবাসী শিল্পী-কাম-লেখকের গল্প পড়ে ‘ক্লিন বোল্ড’ যাদবপুরী কম্পারেটিভ লিটারেচার-কন্যে। চিঠি-পাল্টা চিঠিতেই সম্পর্কটা বেশ গাঢ়। যুবকটি কালকা মেলের টিকিট কেটে বসলে মেয়েটিও হাওড়াতেই আসবে বলে নাছোড় হয়ে উঠল। অগত্যা বড় ঘড়ি ছাড়া আর গতি কী!

মডেল: সৌমিলি ঘোষ বিশ্বাস। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

মডেল: সৌমিলি ঘোষ বিশ্বাস। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

তেপান্তরের মাঠ বা ময়নামতীর পথের ধার নয়! শেষমেশ শিকে ছিঁড়ল ওই বড় ঘড়ির কপালে।

কী যেন এক পত্রিকায় দিল্লিবাসী শিল্পী-কাম-লেখকের গল্প পড়ে ‘ক্লিন বোল্ড’ যাদবপুরী কম্পারেটিভ লিটারেচার-কন্যে। চিঠি-পাল্টা চিঠিতেই সম্পর্কটা বেশ গাঢ়। যুবকটি কালকা মেলের টিকিট কেটে বসলে মেয়েটিও হাওড়াতেই আসবে বলে নাছোড় হয়ে উঠল। অগত্যা বড় ঘড়ি ছাড়া আর গতি কী!

সেটা গত শতকের সত্তরের দশক। হতচ্ছাড়া মোবাইল এসে তখনও অপেক্ষার বারোটা বাজিয়ে দেয়নি। ঘন ঘন চলভাষে গুজগুজ করে বা ফেসবুক আপডেটে চোখ রেখে প্রেমিকের ট্রেন হাঁটি-হাঁটি এগিয়ে কখন কোন স্টেশনে এসে ঠেকল, কে বুঝবে? জেনেশুনে ঠিক সময়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখা করতে যাওয়ার তাই জো ছিল না। মেয়েটিকে সে-দিন দু’ঘণ্টা বড় ঘড়ির নীচে অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

দু’জনে দু’জনকে তার আগে দেখেনি পর্যন্ত।

দেখা না-দেখায় মেশা...

চিঠিতে বলা ছিল, শাড়িসজ্জিত জোড়াবিনুনিধারী, বুকের কাছে দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ ধরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। যুবকটির অঙ্গে নীল শার্ট থাকবার কথা ছিল। আর কিছুটা চেহারার বিবরণ ভরসা--- ‘ফর্সা, গালময় দাড়ি--- পঞ্জাবি বলে ভুল হতে পারে।’ ঘোঁট পাকাল, সেই চিঠির বিবরণেই।

ভিড়ের মধ্যে জোড়া বিনুনিধারীকে চিনতে ভুল হয়নি। কিন্তু মেয়েটি তত ক্ষণে আর এক টকটকে দীর্ঘদেহীকে দেখে, ‘এই যে শুনছেন’-করে বসেছেন। অ-বাংলাভাষী সেই যুবক বেশ থতমত! আর আর্টিস্ট প্রেমিকপ্রবরেরও ভুল হয়েছে ভেবে গুগলিতে ঠকে যাওয়ার দশা!

সে-যাত্রা হাতে-ধরা ডিভাইন কমেডিই সেই জুটিকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।

বড় ঘড়ি এখনও আছে। কিন্তু প্রযুক্তির কল্যাণে এমন অনেক কমেডিই জীবন থেকে উধাও। “মানতেই হবে, অপেক্ষার রোম্যান্সটা এখন অনেকটাই ফিকে!”--- বললেন লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ‘শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়’ হয়ে ওঠার প্রাক্-পর্বে তাঁর যুবাবয়সেরও কিছু বড় ঘড়ি-স্মৃতি উজ্জ্বল।

হবু স্ত্রী সোনামন তখন বৈঁচিগ্রামে স্কুলমাস্টারি করেন। শীর্ষেন্দু কলকাতায় মেসবাসী। সপ্তাহান্তে কোনও কোনও সন্ধেয় লোকাল ট্রেনে চেপে সোনামন আসতেন দেখা করতে। বড় ঘড়ির নীচে দাঁড়িয়ে শীর্ষেন্দু তাঁর অপেক্ষায়। বড় ঘড়ির সামনেটা তখন ঠিক এ রকম ছিল না। হাওড়া স্টেশনের নর্থ কনকোর্স বা বড় ঘড়ির দালান জুড়ে মোটা থামের নীচে গুচ্ছগুচ্ছ ঘুপচি দোকান। হকারের ভিড়। তবু চারিচক্ষের চাওয়ায় অসুবিধে হত না।

শীর্ষেন্দু অবিশ্যি এর মধ্যে কাব্যি খুঁজতে রাজি নন। দেখা হওয়ার সুবিধের দিকটাই বড় ঘড়ির মাহাত্ম্য।

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্যও কিন্তু একদা প্রায়ই এক তরুণী বড় ঘড়ির নীচটায় অপেক্ষায় থাকতেন। মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে এসে দাঁড়াতেন। “যথারীতি বেশির ভাগ দিন ওরই আসতে দেরি হত! তবে আসব বলে আসেনি, এমন হয়নি...এই যা!” --- বললেন শক্তিজায়া মীনাক্ষী। শক্তি এলে যে কোনও একটা ট্রেন ধরে দু’জনে কোথাও একটা চলে যাওয়া হত। খানিক দূরের কোনও স্টেশন অবধি যাওয়া...ফিরতি ট্রেনে হাওড়াতেই ফেরা! এ ভাবেই দু’জনের জীবনভর একসঙ্গে হাঁটার সিদ্ধান্তটা আরও পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে।

কালের যাত্রা

বড় ঘড়ির তলায় এমন অনেক পথ চলারই সূচনা। কৈশোর শেষে বন্ধুরা দল বেঁধে প্রথম পুরীযাত্রা যেমন! লায়েক হওয়ার অনুভূতি ফলাও করে বলতে অনেকেই মুখিয়ে থাকবেন। কিন্তু অধুনা কলেজশিক্ষিকা কৃতী বান্ধবীর বড় ঘড়ি-অভিজ্ঞতা জানতে চেয়ে যে ধাক্কাটা আসবে তার জন্য তৈরি ছিলাম না। সে তখন ক্লাস সিক্স। মাসির সঙ্গে লোকাল ট্রেনে শ্রীরামপুরে যাচ্ছে। সদ্য কিশোরীকে বড় ঘড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে মাসি ওষুধ না কী কিনতে গিয়েছিলেন। “জটলার মধ্যে সেই প্রথম একটা লোক আমার সঙ্গে অসভ্যতা করে। সেই প্রথম!” সে-দিন যে জামাটা পরেছিল, সেটা অবধি স্মৃতিতে দগদগে হয়ে আছে অপমানিতা মেয়েটির।

অধুনা উত্তর কলকাতার ইমাম বক্স লেনের বাসিন্দা ‘রিনা’ও তখন বড় ঘড়ি ছাড়া এ শহরের কিছুই চিনতেন না। প্রেমিকের ডাকে ট্রেনে মেদিনীপুর থেকে হাওড়ায় নেমে বড় ঘড়িতেই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। চোরাপথের বাঁকে ঘোল খেয়ে তথাকথিত নিষিদ্ধপল্লিতে নতুন জীবন খুঁজে পান এখন প্রৌঢ়া, সেই মহিলা। বড় ঘড়ি এমন অজস্র আখ্যানের সাক্ষী।

মিট মি আন্ডার দ্য ক্লক

এ কালের সিধুজ্যাঠা গুগ্ল বাবাজির শরণাপন্ন হতেই বেরিয়ে এল আরও অনেক কিস্সা। ইস্টিশানের ঘড়ির মহিমা আমাদের একচেটিয়া নয়। কোপেনহেগেন, মেলবোর্ন, লন্ডন... লন্ডনের ওয়াটারলু স্টেশনের ঘড়িটি চতুরানন। বয়স দেড়শোরও বেশি। দেখিগে, ছবি শেয়ার করার ওয়েবসাইট ফ্লিকারে ওয়াটারলুর ঘড়ির নীচে দাঁড়িয়ে জনৈক বঙ্গসন্তানের ছবির ক্যাপশন, ‘বড় ঘড়ি...লাইক আওয়ার হাওড়া স্টেশন।’

বন্ধু সুস্মিতা ধর লুকাসের কাছে শোনা ফ্রাঙ্কফুর্টের খাস স্টেশন বা হপ্টবানহফের ঘড়িটিকে মনে পড়ল। একটু মফস্সল থেকে শহরে ঢুকে কেনা-কাটা ঘোরাফেরার মতলবে দেখা-সাক্ষাৎ ওই ঘড়ির নীচেই। তবে ফ্রাঙ্কফুর্টের ঘড়িটা স্টেশনের বাইরে। নিউ ইয়র্কের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনের চারমুখো ঘড়িটা বরং ছাদের নীচে, চার দেওয়ালের ভিতরে। কনকনে ঠান্ডাতেও দেখা করাটা সেখানেই আরামের। বন্ধু দম্পতি, তখন নিউ ইয়র্কে গবেষণারত দূর্বা ও পৃথ্বীরাজের সেটা ‘অ্যাপো’ করার ঠেক। আর এক বন্ধু শকুন্তলা ভাদুড়ী এখন নিউ ইয়র্কেই থিতু। গ্র্যান্ড সেন্ট্রালের ঘড়িটা বার বার তার কাছেও কলকাতাকে উসকে দেয়। ওখানে দাঁড়ালে এখনও শীর্ষেন্দুর ‘যাও পাখি’-র একটি চরিত্রের বার বার বড় ঘড়ির নীচে অপেক্ষার কথা মনে পড়ে প্রবাসী বাঙালিনীর।

নিউ ইয়র্কের চোখজুড়োনো ঘড়িটা বার বার সেলুলয়েডে ধরা পড়েছে। হিচককের নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট, দ্য গডফাদার...। ভাবতে ভাবতেই মনটা খারাপ হল হাওড়ার বড় ঘড়ির জন্য। নিউ ইয়র্কের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল ক্লকের মতো আমাদের বড় ঘড়িরও তো প্রায় ১০০ বছর বয়স হল।

না-দেখিলাম তারে

বড় ঘড়িকে কি আদৌ কোনও ছবিতে দেখা গিয়েছে?

ফিল্ম স্টাডিজের চেনা মাস্টারমশাই, টালিগঞ্জের প্রবীণ অভিনেতা কেউই মনে করতে পারলেন না। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র নেপথ্য-কাহিনিটিতে সে-দিনের কলকাতার চার বোহেমিয়ান যুবকও তো বড় ঘড়ির নীচেই জড়ো হয়েছিলেন। হঠাৎ ধলভূমগড় স্টেশনে যাঁরা নেমে পড়বেন। সত্যজিতের ছবিতে গল্পটাই বদলে গেল।

তবে ‘সোনার কেল্লা’-য় ফেলু-তোপসের রাজস্থান যাত্রার আগে হাওড়া স্টেশনে একটা টুকরো সি-অফ দৃশ্য ছিল বটে। স্টেশনের ঘড়িরও কিছু শট ছিল। সেটা অবশ্য বড় ঘড়ি নয়।

‘সোনার কেল্লা’-র আউটডোর যাত্রা ট্রেনেই ঘটেছিল! হাসলেন নতুন ফেলুদার পরিচালক সন্দীপ রায়। তখন অনেক ছবিতেই লটবহরসুদ্ধ গোটা ইউনিট বড় ঘড়ির নীচে জড়ো হত। এখন সে-সব প্রায় অলীক। অভিনেতা দীপঙ্কর দে-র মনে পড়ে গেল, বহু বছর আগের এক বড় ঘড়ি-কাহিনি।

‘পরিচয়’ বলে একটি ছবির আউটডোরে শিমুলতলা যাওয়া হচ্ছিল। দীপঙ্কর, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়, সন্তু মুখোপাধ্যায়রা বড় ঘড়ির নীচে ঠায় দাঁড়িয়ে। মহুয়া রায়চৌধুরী ও তাঁর মা এলেন একেবারে শেষ মুহূর্তে! গোটা ইউনিটের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।

ফুটবলার গৌতম সরকারের কাছে শোনা গেল, সে-যুগে বড় ক্লাবের ডুরান্ড, রোভার্স-অভিযানের পথে বড় ঘড়ির সম্মেলনের গপ্পো। কোনও কোনও তারকার জন্য কর্মকর্তাদের রক্তচাপ বেড়ে যেত। হয়তো সুভাষ ভৌমিক, শ্যাম থাপা বা সুব্রত ভট্টাচার্য শেষ মুহূর্তে ছুটতে ছুটতে এসে কামরায় উঠছেন! গৌতম নিজেও ট্রেন ফেল করেছেন।

এই রোকো...পৃথিবীর গাড়িটা থামাও

ট্রেন ফেল হওয়ার কথা উঠতে সে-কালের ব্রিটিশ পাংচুয়ালিটির কথাও উঠল। মার্বেল প্যালেসের রাজেন মল্লিকদের বাড়ির কর্তা হীরেন মল্লিক শোনালেন সাহেবদের আমলের ‘সময়ানুবর্তিতা’র কথা।

বেলিলিয়াস রোডে ঘাঁটি গাড়া রেলের সাহেব বা বেলিলিয়াস গ্রুপ অব পিপ্লদের সঙ্গে খানদানি বাঙালি বাবুদের তখন দারুণ খাতিরদারি। কত্তাবাবু পশ্চিমে চেঞ্জে যাচ্ছেন। নিশ্চিত ট্রেন ফেল করবেন। এই পরিস্থিতিতে বড় ঘড়ির নীচে দাঁড়িয়েই তাঁর সরকারবাবু স্টেশন ম্যানেজারকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলতেন।

ট্রেনও অপেক্ষা করত। এমনকী, ট্রেন ছেড়ে দিলেও পরের স্টেশনে তা থামানোর ব্যবস্থা হত। বাবু হয়তো মোটরে বা ছ্যাকরা গাড়িতে চেপে সটান পরের স্টেশনে গিয়েই ট্রেনে উঠলেন। “তখন মানী লোকের মান ছিল। এখনকার মতো টম-ডিক-হ্যারি সব এক ছিল না।”--- বললেন হীরেনবাবু।

তবে বড়-বাড়ির বড় ঘড়ির নীচে জমায়েতের একটা বিশেষ তাৎপর্য ছিল! টিনের বাক্স, ফুলওয়ালা বাক্স, বেডিং গুছিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর ঢের আগে পাঁজি দেখে যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক হত। ট্রেনের টাইম-টেবিল তো পাঁজির ধার ধারে না। অতএব বাড়ি থেকেই শুভ ক্ষণ দেখে বেরোতে হবে। সেটা হয়তো ট্রেন ছাড়ার বেশ কিছু ক্ষণ আগে। সুতরাং বড় ঘড়ির সামনে জড়ো হওয়াটা অনিবার্য। যাঁরা যাবেন, তাঁরা তো বটেই! গোটা পরিবার, বন্ধুবান্ধব সক্কলে বড় ঘড়িতেই দেখা করত। ঠিক যেন আজকের পারিবারিক টিভি সিরিয়ালের দৃশ্য।

চলতি হাওয়ার পন্থী

এই বড় ঘড়ির কনফারেন্স যে কত জীবন পাল্টে দিয়েছে। স্কুলের বন্ধুদের টা-টা করতে এসে প্রৌঢ় বয়সেও অবধারিত ফাঁদে পড়তেন দুঁদে উকিল অমরেন্দ্রনাথ দে। পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের পুনর্মিলন উৎসবের এক দিন আগেই হাওড়া-চক্রধরপুর ধরে স্কুলে চলে যাবেন প্রাক্তন ছাত্রদের কয়েকজন পান্ডা। অমরবাবুর কলকাতায় বিস্তর কাজ। কিছুতেই যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু স্কুলতুতো দাদা-ভাইদের হাত থেকে ছাড়ান নেই। ধ্রুব মার্জিত, স্বামী গৌতমেশানন্দ, সমীর পাইন প্রমুখ সমসাময়িক থেকে শুরু করে স্কুলতুতো ভাই হাঁটুর বয়সী রানা সেনগুপ্ত, অনিন্দ্য ঘোষ, সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়রা চক্রান্তে একজোট হতেন। তীব্র প্ররোচনায় অতএব বিনা টিকিটেই ওই ট্রেনে উঠতে বাধ্য হতেন অমরবাবু। পরে টিটি-কে ম্যানেজ করা হত। একটা বার্থ পাওয়া গেল তো ভাল, নইলে সিনিয়র দাদাকে শোওয়ার জায়গা ছেড়ে জুনিয়ররা বসে-বসে আড্ডাতেই রাত কাবার করে দিতেন। অমর/অমরদা এখন নেই ভাবলে মনটা খারাপ হয়ে যায় সেই সহযাত্রীদের।

তবে বড় ঘড়ি চেনেন না, কদাচিৎ এমন মানুষেরও দেখা মেলে। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব প্রসাদরঞ্জন রায় ফিরে গেলেন তাঁর কলেজ-জীবনের দিনগুলোয়। কী একটা স্কলারশিপ পেয়ে দল বেঁধে দক্ষিণ ভারতে যাচ্ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার এক ঝাঁক পড়ুয়া। সক্কলে বড় ঘড়ির নীচে জড়ো হলেও একটি ছেলের দেখা নেই। শেষটা অপেক্ষা করে-করে হাল ছেড়ে দিয়ে সবাই ট্রেনে উঠে দেখেন, ওই যুবক আগেভাগেই নির্দিষ্ট আসনে বহাল। বন্ধুরা রে-রে করে উঠলে তাঁর ব্যাখ্যা, ‘আমি তো প্ল্যাটফর্মের ভিতরের একটা ঘড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিলাম।’ “মোবাইল থাকলে, অবিশ্যি সে-দিনও এ ভুল হত না!”--- বললেন প্রসাদবাবু।

সেইখানে হবে দেখা...

তবে প্রাক্-মোবাইল যুগেও অন্তত একটি নিশ্চিত বিচ্ছেদ রুখে দেওয়ার সাক্ষী বড় ঘড়ি। বাঙালি প্রেমিকাকে শেষ চিঠি লিখে মাদ্রাজে চাকরি নিয়ে চিরতরে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তাঁর দক্ষিণ ভারতীয় প্রেমিক। পদ্মনাভন রাও বলে গিয়েছিলেন, অমুক সময়ে ট্রেন ছাড়বে। শেষ দেখা দেখতে হলে বড় ঘড়ির নীচে ‘এসো’। পরের দৃশ্যটা হাল আমলের অনেক বলিউডি ছবির মতোই। উত্তর কলকাতা থেকে পোস্তার বিখ্যাত ট্র্যাফিক জ্যাম পার হয়ে নায়িকা যখন স্টেশনে এসে পৌঁছলেন, তখন ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।

বড় ঘড়ির নীচে মেয়েটি হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করার পরেই তাঁর পিঠে হাত রাখলেন পদ্মনাভন। ঠিক যেন সৌমিত্র-অপর্ণার হিট ছবি ‘বসন্ত বিলাপ’-এর দৃশ্য। তফাত সেটা মফস্সলি স্টেশন ছিল। এইটে খাস হাওড়া স্টেশন। সৌমিত্রর মতো মিষ্টি হেসে পদ্মনাভন তাঁর ভাঙা-ভাঙা বাংলায় ‘আমি যাইনি’ বলেছিলেন বুঝি? এখন দক্ষিণী ঘরের গিন্নি প্রৌঢ়া সুস্মিতা বসু শুনে হেসে কুটিপাটি!

সব পাখি ঘরে আসে...

মিলনের সাঁকোতেই আঁকা হয় বিচ্ছেদেরও ছবি। বড় ঘড়ি-কাহিনি শুরু হয়েছিল যে জুটির গল্পে, বড় ঘড়ির নীচেই তাঁদের ফের দেখা হল। আর্টিস্ট প্রেমিককে বিদায় জানাতে এসে ‘ট্রেনে উঠে দেখো’ বলে মেয়েটি তাঁর হাতে তুলে দেন এক চিঠির টুকরো। বোধহয় অনেকটা ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্যর ধাঁচে লেখা। পড়তে পড়তে যুবকটির যা বিষের পুঁটলি মনে হয়েছিল।

এর অনেক বছর বাদে, এই তো সে-দিন উড়ান বাতিল হওয়ায় ট্রেনে কলকাতা ফিরছিলেন পাকাচুল বৃদ্ধ। বড় ঘড়ির সামনের কনকোর্সটায় টাইল্স বসে এখন বেশ তকতকে। পুরনো ফোয়ারাটা সরানো হয়েছে। প্রচুর বসার জায়গা। দোকানগুলো সুশৃঙ্খল। সে-দিনের হাওড়া স্টেশনকে চেনাই যায় না।

পুরনো কাটার দাগ মিলিয়েই গিয়েছে ভেবে নিয়েছিলেন! সাবেক বিলিতি ঘড়িটার দিকে তাকাতেই স্মৃতি-পিপীলিকার কুরকুরি শুরু হয়ে গেল। ‘থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি’।

সালভাদর দালির ছবিতে ‘গলানো সময়ে’র কথা মনে হল আর্টিস্ট বৃদ্ধের। ক্যানভাসময় গলিত মাখনের আদলে পড়ে-থাকা ঘড়ির শব। ইচ্ছে হচ্ছিল, বড় ঘড়িটাকে ঝেড়ে কাপড় কেচে নিংড়ে রিক্ততার ডালে শুকোতে দিই পারলে। ঘটনাটা বলতে বলতেই বৃদ্ধের অনুরোধ, “বড় ঘড়ি নিয়ে যা খুশি লিখুন, আমার নামটা প্লিজ লিখবেন না।”

ধুর ধুর, কে বলে...সময় সব কিছু ভোলাতে পারে! শুধু বড় ঘড়ি নট আউট থেকে যায়...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE