সেভেন টোম্বস্-এ
এঁর চোখে চশমা।
এঁর চুল ধবধবে সাদা।
এঁর শরীর সামান্য ভারী।
ইনি বেশিক্ষণ হাঁটলে হাঁফিয়ে ওঠেন।
ইনি জানেন না এ বার জাতীয় লিগে কারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
ইনি সব প্রশ্নেই বলেন, ‘মুশকিল আচে।’
জাম্পকাট—
এঁর অভিধানে ‘পারব না’ শব্দটাই নেই।
ইনি তাঁর মহাগুরুর মাস্টারপ্ল্যান পাল্টে দিয়েছেন বড় ম্যাচে সেই ঐতিহাসিক ১৭ সেকেন্ডের গোলে।
এঁকেই তো ময়দানে ধরা হয় সংযম আর শৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে।
দু’জনই মহম্মদ হাবিব।
এক জন ২০১৫-র। অন্য জন ১৯৭৬-এর।
দু’হাজার পনেরোর হাবিবকে তাঁর পরিবার বাদ দিয়ে কেউ বিশেষ দেখতেটেখতে পান না। তাঁর গলা প্রায় কেউ শোনে না।
এই হাবিব হায়দরাবাদে টলিচৌকির মতো দিনভর জমজমাট জায়গায় বসবাস করেও বেশির ভাগ সময় একটা আট বাই ছয় ফুট ঘুপচি ঘরে স্বেচ্ছা-নির্বাসিত থাকতে ভালবাসেন।
বেশি প্রশ্ন করলে বিরক্ত হন। কোনও অতিথি দশ মিনিটের বেশি তাঁর বাড়িতে থাকলে নিজেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে বুঝিয়ে দেন— এ বার আপনি আসতে পারেন!
যাঁর সঙ্গে হায়দরাবাদে দিনকয়েক কাটানোর পরও চার দশক আগের সেই ময়দান কাঁপানো সুপারস্টার ফুটবলারের চার শতাংশও মিল খুঁজে পাওয়া গেল না।
যে হাবিব কিনা পিকেরও মাস্টারপ্ল্যানের ঘাড়ে নিজের ভাবনা চাপিয়ে দিয়েছিলেন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে আকবরের সেই ১৭ সেকেন্ডের গোলে!
‘‘প্রদীপদা ম্যাচটার ক’দিন আগে থেকে কিক-অফের সঙ্গে ওই অ্যাটাকটার স্ট্র্যাটেজি আমাদের প্র্যাকটিস করাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি প্রত্যেকবারই ওঁকে বলতাম, আপনার প্ল্যানে আমি ইস্টবেঙ্গল বক্সের মিডলে আকবরের মাথা টার্গেট করে উঁচু সেন্টার করার বদলে লেফট উইংয়ে ছুটন্ত উলগার পায়ে উঁচু ক্রস পাঠালে মনে হয় বেশি কাজ দেবে। উলগা যদি সুধীরকে টপকে একেবারে কর্নার ফ্ল্যাগ থেকে বক্সের মাঝখানে সেন্টার তোলে ততক্ষণে আকবরের পাশে আমিও পৌঁছে যাব হেড নিতে। মানে গোলের ডাবল চান্স।’’
ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা হাবিব কথাগুলো বলার সময় জানকীনগরে ‘মইন হাইটস’-এর একতলায় তাঁর মেয়ের ফ্ল্যাটে বসে যেন একটু-একটু করে ফ্ল্যাশব্যাকে সত্তরের দশক দেখতে পাচ্ছিলেন!
আকবরের সেই সতেরো সেকেন্ডের গোলের ৩৯ বছর পর স্কোরারের দাদা সটান দাবি করলেন, ‘‘সেদিন প্রদীপদার স্ট্র্যাটেজি ফলো করলে আকবরভাইয়ার গোলটা না-ও হতে পারত। প্রদীপদার এত দিন পরে কি মনে আছে? কে জানে!’’
কয়েক সেকেন্ড থেমে একষট্টির প্রবীণ হাবিব লম্বা নিশ্বাস টেনে বলে চললেন, ‘‘এই নিয়ে প্রদীপদা আর আমার মধ্যে সেদিন ইডেনে নামার আগে ড্রেসিংরুমে পর্যন্ত তর্কাতর্কি লেগে ছিল। আমি তখনও বলে চলেছি, ‘না প্রদীপদা। ও ভাবে হবে না।’ আসলে আমার যুক্তি ছিল, সেবার ইস্টবেঙ্গলের দুটো স্টপারই লম্বা। দু’জনেরই ফ্রন্ট হেডিং খুব ভাল। সেখানে সুধীর বরং ওই সময় টপ ফর্মে ছিল না। একটু হলেও আগের চেয়ে স্লো হয়ে গিয়েছিল। আমি তার আগের বছর মহমেডানে থাকায় সুধীরের বিরুদ্ধে গোটাকয়েক ম্যাচ খেলে ব্যাপারটা আরও ভাল বুঝেছিলাম।
যেটা প্রদীপদার পক্ষে হয়তো অতটা বোঝা সম্ভব ছিল না, দু’জনেই পঁচাত্তরে ইস্টবেঙ্গলে থাকায়। কিন্তু প্রদীপটাকে ছিয়াত্তরের ওই বড় ম্যাচের আগে সেটা বোঝাতে আমার কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। তবে সেদিন ম্যাচের পর ড্রেসিংরুমে প্রদীপদা আমাকে সবার আগে জড়িয়ে ধরে মজা করে কান মুলে দেওয়ার ভান করে বলেছিলেন, ‘আকবরের গোলটা না হলে কিন্তু এই কান মলাটা সত্যি খেতিস তুই।’ প্রদীপদা আর অমলদায় এখানেই তফাত। প্রদীপদা নিজের ভুল স্বীকার করতে জানতেন। সেই স্পিরিটটা ছিল। যেটা অমলদার ছিল না।’’
টানা স্মৃতিচারণ করে চলা এই হাবিব তখন যেন সত্তরের দশকের সেই জেদি হাবিব। যে হাবিব-সংস্কৃতি বলতে ময়দান জানত নিখাদ সততা-নিষ্ঠা-পেশাদারিত্ব।
যে নিষ্ঠা নিয়ে সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন ফুটবলার হয়ে ওঠার তীব্র বাসনা, আকাঙ্খাকে চার দশক আগের হাবিব তাড়া করেছিলেন। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহমেডান অনেকবার পাল্টাপাল্টি করলেও যখন যে প্রধানের জার্সি গায়ে চড়িয়েছেন, চূড়ান্ত সততায় সেই জার্সিকে নিজের মায়ের মতো সম্মান দিয়েছেন হাবিব। চরম পেশাদারিত্ব দেখিয়ে বছরের পর বছর প্রতিটা ম্যাচে হয়ে উঠেছেন দুর্বার।
কিন্তু দু’হাজার পনেরোয় কলকাতা ময়দান থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে বসে কি হাবিবের নিজেরই এখন মনে হয় হাবিব-সংস্কৃতি এই হাইটেক যুগে ডায়নোসরের মতো বিলুপ্ত অধ্যায়?
‘‘সাচ বাত বোলা!’’ পেঁয়াজের একটা-একটা করে খোসা ছাড়িয়ে ভেতরটা স্পষ্ট দেখতে পাওয়ার মতো যেন হাবিবকেও দেখাচ্ছে তখন! ‘‘এখন তো এ দিক-সে দিক থেকে মাঝেমধ্যে কানে আসে, বড় ম্যাচের আগে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ফুটবলাররা প্রেসের সঙ্গে নাকি কথাই বলে না! আমাদের সময়ের মতো গরমাগরম কিছু বলা তো দূরের কথা। তা হলে আর বড় ম্যাচের উত্তেজনা তৈরি হবে কোত্থেকে? এখন শুনি অনেক ফুটবলার বউ-বাচ্চা নিয়ে হোটেলে লাঞ্চ করে নাকি বড় ম্যাচে মাঠে নামে! পঁচাত্তরে একবার মোহনবাগান টিম দুপুরে মাংস-ভাত খেয়ে বিকেলে শিল্ড ফাইনাল খেলতে নেমেছিল। মনে আছে নিশ্চয়ই কী হয়েছিল সেই ম্যাচে? ইস্টবেঙ্গলের কাছে পাঁচ গোলে হারতে হয়েছিল! কিন্তু সেই কাজই এখন সব বড় দল করছে। ফলে বেশির ভাগ সময় বড় ম্যাচের স্ট্যান্ডার্ডও এখন থার্ড ক্লাস।’’
হাইটেক-সিটি হায়দরাবাদে বসেও হাবিবের গভীর দুঃখ হয়। তীব্র যন্ত্রণা পান। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের আধুনিক ফুটবল কালচারের খবরাখবর কানে এলে।
মোরাদনগরে মেহেদিপট্নমে যে আদিবাড়িতে পাঁচ ভাইয়ের তৃতীয় হাবিব কৈশোরে দুই ফুটবলার দাদা আজম আর মইনের ক্যারিশমা দেখে ফুটবল খেলাটার প্রেমে পড়েছিলেন, বছরকয়েক আগে বিক্রি হয়ে যাওয়া সেই পুরনো বাড়ি আর অধুনা হলদেটে মাল্টিস্টোরিডের ফ্ল্যাটের মতোই আকাশ-পাতাল তফাত হাবিবের চোখে নিজের ফুটবল জমানা আর বর্তমান ইস্ট-মোহন কালচারের।
ফুটবল আর নেই, সংসার-দৌড়ে আজ মিঞার সঙ্গী বিবি
এই হাবিব সাফ বলে দেন, ‘‘ব্যারেটো আসা পর্যন্ত বড় দলে বিদেশি রিক্রুটে ক্লাব অফিশিয়ালদের ভেতরে তবু কিছু নিয়ম-নিষ্ঠা, সততা ছিল। তার পর শেষ দশ-বারো বছরে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহমেডানে যেমন বিদেশি ফুটবলারদের ছিরি, তেমনই ছিরি যারা ওদের রিক্রুট করছে সেই কর্তাদের! দু’টোই থার্ড ক্লাস। আমার তো মনে হয়, মজিদ-জামশিদ-চিমা-ব্যারেটোর মতো গুটিকয়েক বাদে ময়দানে বাকি সব বিদেশি রিক্রুটের পেছনে অফিশিয়ালদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপার রয়েছে। এজেন্ট কাট-মানি না খেলে এত নিকৃষ্ট মানের বিদেশিদের ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান জার্সি পাওয়া মুশকিল আছে!’’
আবার সেই হাবিব-ই জানতেন না, তেরো বছর পরে মোহনবাগান এ বার ভারতসেরা হয়েছে! জানতেন না কলকাতায় আই লিগ প্রথম ঢুকেছে সবুজ-মেরুন তাঁবুতে। ‘‘কাগজ-টাগজ এখন সেভাবে রোজ পড়া হয় না তো! ঠিক জানতাম না,’’ ন্যূনতম অস্বস্তি ছাড়াই নির্বিবাদে বলে দেন হাবিব। যা শুনে সঙ্গী ফটোগ্রাফার উৎপল সরকার ছবি তোলা থামিয়ে দু’-এক সেকেন্ড প্রায় হাঁ করেই তাকিয়ে থাকে উল্টো দিকের সোফায় বসা হাবিবের দিকে।
এমনই এক সাক্ষাৎ কনট্রাডিকশন— মহম্মদ হাবিব!
চার দশক আগে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়েরও স্ট্র্যাটেজি খারিজ করে যিনি সতীর্থ স্ট্রাইকারকে দিয়ে মাত্র সতেরো সেকেন্ডে গোল করিয়ে ছিলেন, সেই হাবিবের ২০১৫-য় তিনতলা থেকে একতলায় নামতে সতেরো মিনিট লেগে গেল!
কিছুতেই বাড়ি থেকে গাড়িতে দশ মিনিটের দূরত্বে হায়দরাবাদের অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান ‘সেভেন টোম্বস’ যাবেন না। ‘‘ঘরেই যা ছবিটবি নেবে নাও না! বাইরে মুসকিল আচে।’’
সেই হাবিবকে শেষমেশ রাজি করিয়ে ভাই আকবর সমেত কেবল ষোড়শ শতাব্দীর হায়দরাবাদ শাসক কুতুব শাহি বংশের সাত রাজার সাত সমাধিস্থল ‘সেভেন টোম্বস’য়েই যাওয়া নয়, তার থেকে বেশ কিছু দূরে প্রসিদ্ধ গোলকুন্ডা ফোর্টেও ফটো শ্যুট করার ফাঁকে হাবিব হঠাৎ-ই সত্তরের দশকের ময়দান কাঁপানো সেই অকুতোভয় হাবিব।
এখন খেললে সনি নর্ডি, র্যান্টি মার্টিন্সদের আটকাতে কতটা বেগ পেতেন? প্রশ্নটা করতেই সেই যৌবনের কিছুতেই হার না মানা মানসিকতা ঠিকরে বেরিয়ে আসে একষট্টির প্রৌঢ় শরীর থেকে।
‘‘আরে ধুর! কসমস ম্যাচে পেলেকে কয়েক বার আটকে দিয়েছিলাম। আর এদের!’’ হায়দরাবাদে তিন দিনব্যাপী হাবিব-ইন্টারভিউ পর্বে সেই প্রথম ফোঁস করে উঠলেন বড়েমিঞাঁ।
পরক্ষণেই তিনি আবার ২০১৫-র হাবিব। যিনি মুহুর্মুহু তাগাদা দিতে থাকেন ‘‘বাড়ি চলুন, বাড়ি চলুন। অনেক তো ছবি হল!’’
ব্রেকফাস্ট? তাতেও প্রথমে ‘‘মুসকিল আচে’’ বলে হয়তো সঙ্গে ভাই আকবর আছে ভেবে বললেন, ‘‘কী আকবরভাইয়া? তোর ফেভারিট মশলা দোসা হতে পারে, কী বলিস!’’
হাবিবের ফেভারিট ডিশ যা, সেটা অত সাতসকালের মেনুর মধ্যে সাধারণত পড়ে না বলেই হয়তো আকবরকে এই ‘পাস’টা বাড়ানো তাঁর প্রিয় দাদার। কারণ হাবিবের প্রিয় মাটন বিরিয়ানি, মাটন মশালা আর চাপাটি— তিনটের কোনওটাই নিজামের শহরেও অত সকালে কোনও রেস্তোরাঁয় পাওয়া সম্ভব নয়!
ব্রেকফাস্ট টেবলে পেলে ম্যাচের কথা উঠল আবার। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেল, ১৯৬৫ থেকে ’৮৩— মহম্মদ হাবিবের দীর্ঘ আঠারো বছরের মহাউজ্জ্বল কলকাতা ময়দান আকাশে ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭-এর মোহনবাগান বনাম কসমস এক বিশাল নক্ষত্র।
‘‘বিদেশিদের বড় শরীরকে আমি একচুল ভয় পেতাম না। কেন জানেন? সব সময় অপোনেন্টের শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়তাম যে! এমন ভাবে লেগে থাকতাম, আমাকে মেরে ফেলে দিতেও পারত না কেউ। সেটার জন্যও সেই ফুটবলারের পায়ের যে সামান্য সুইংয়ের দরকার পড়ত, অতটুকু জায়গাও তাকে ছাড়তাম না। মারবে কী আমাকে? ফলে বেশির ভাগ বল আমিই কেড়ে নিতাম।’’
কসমস ম্যাচেও কি ওই ফমুর্লা ফুটবলসম্রাটের বিরুদ্ধেও ছিল? হাবিব বলে চললেন, ‘‘তিন জন মার্কার সে দিন পেলের জন্য রেখেছিলেন প্রদীপদা। পেলে নিজের হাফে বল ধরলে প্রথম ট্যাকল করব আমি। আর পেলে মোহনবাগান জোনে বল ধরলে প্রথমে গৌতম, তার পরে ভট্চা়জ (সুব্রত ভট্টাচার্য) পরপর ট্যাকলে যাবে। ততক্ষণে আমিও ওদের পাশে ডিফেন্সে নেমে আসব। কী জানেন? ওই একটা ম্যাচের কথা আমার এত বছর পরেও প্রতিটা সেকেন্ড মনে আছে। পেলের প্রতিটা মুভ এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারি।’’
আটত্রিশ বছর পরেও যেমন সেই ম্যাচের একটা ঘটনা স্পষ্ট মনে পড়ল হাবিবের— ‘‘আমার গোলের পর কিক-অফ হতেই পেলে একটা বল ধরে গৌতম আর ভট্চাজকে একসঙ্গে ছিটকে দিয়ে আমাদের বক্সে ঢুকে পড়েছিল। সামনে অসহায় পি. চৌধুরী। আর ওর পেছনে একা গোলকিপার শিবাজি। পেলে এত স্পিডে মুভটা করেছিল যে, আমি তখনও মোহনবাগানের হাফলাইনে। কিন্তু নিজের সমস্ত শক্তি আর সাহস সম্বল করে আমি সেদিন ওই অবস্থাতেও স্প্রিন্ট টেনে পেলের কাছে পৌঁছে ওর শরীরের ভেতর ঢুকে গিয়ে পা থেকে বল কেড়ে নিয়েছিলাম। আর এখন বলতে লজ্জাই করছে—তার পরেই পেলের মুখের কাছে গিয়ে বলেছিলাম, ইউ পেলে, রিমেম্বার আই অ্যাম মহম্মদ হাবিব!’’
দ্রুত বুঝলাম ২০১৫ নয়, ১৯৭৭-এ ফিরে গিয়েছি।
পেলে ম্যাচ নিয়ে আমাদের আড্ডা ঐতিহাসিক গোলকুন্ডা ফোর্ট, তার লাগোয়া মামুলি রেস্তোরাঁ পেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ঢুকে পড়ল হাবিবের বাড়ির ছোট্ট ড্রইংরুমে। তিনতলা কিংবা একতলা— দুটো ফ্ল্যাটেই আড়ম্বরের চিহ্নমাত্র নেই।
টিপিক্যাল মুসলিম বাড়ির অন্দরমহলকে আলাদা রাখতে বাইরের বসার ঘর আর ভেতরের ঘরের মাঝবরাবর ঝলমলে নেটের পর্দাটুকু ঝোলা বাদে।
হাবিব সেই বাইরের ঘরে বসে বিবি রাইসাকে ডেকে পাঠালেন। আমাদের ঝটিতি হায়দরাবাদ সফরে বড়েমিঞাঁর সেই প্রথম সত্যিকারের খোশমেজাজ! ‘‘এদের বলো পেলে ম্যাচের দিন আমি কী অবস্থায় ছিলাম!’’ ঈষৎ স্থূলকায় বিবির দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বললেন হাবিব।
হাবিব-পত্নীর সঙ্গেই ততক্ষণে সেই ঘরে লাইন দিয়ে ঢুকে পড়েছেন তাঁদের চার নাতনি— আফিফা, আতিফা, হেবা, হানা। ফুটফুটে বাচ্চাগুলোর বয়স পাঁচ থেকে পনেরোর মধ্যে। প্রথম দু’জন হাবিবের মেয়ে হারিসার কন্যাসন্তান। পরের দু’জন হাবিবের একমাত্র ছেলে মহম্মদ হাসিবের কন্যাসন্তান। হাবিবের পুত্রবধু সামরিন ফতিমার সঙ্গে যারা জেড্ডা থেকে রমজান মাসটা দাদুর বাড়িতে কাটাতে এসেছে।
হাবিবের ছেলে এম টেক। অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘ দিন উচ্চশিক্ষার খাতিরে ডনের দেশের নাগরিকত্ব পর্যন্ত রয়েছে হাবিব-পুত্রের। জেড্ডায় নামী কম্পিউটর সংস্থার উঁচু পদে রয়েছেন। আকবরেরও এক ছেলে। এমএস। নিউইয়র্কের হাসপাতালে সার্জারি করেন। আকবর-পুত্র আবার আমেরিকান নাগরিক।
ছেলেদের ফুটবলার করতে চাননি না হাবিব, না আকবর। ‘‘আসলে একটা করেই ছেলে তো! তাই কোনও ঝুঁকি নিতে চাইনি,’’ বলে হাবিব আরও যোগ করেন, ‘‘তা ছাড়া আমার শ্বশুরবাড়ির দিকে সবার প্রচুর পড়াশোনা। খুব শিক্ষিত পরিবার। ওঁদের দিক থেকেও একটা চাপ ছিল ছেলেকে অনেক দূর পড়াশোনা করানোর ব্যাপারে। আবার আমার দেখাদেখি আকবরও ওর ছেলেকে বিদেশে পড়াশোনা করতে পাঠায়।’’ হাবিবের বিবি আরও একধাপ এগিয়ে বলে দিলেন, ‘‘তা ছাড়া বাবা-কাকার মতো বড় ফুটবলার হওয়ার প্রতিভা হাসিব বা আকবরের ছেলের ভেতর ছিল না। ওরা কোনও দিনই হাবিব হতে পারত না।’’
বিবির জন্য পেলে ম্যাচের টিকিট অনেক চেষ্টা করেও ধীরেন দে-র থেকে জোগাড় করতে পারেননি হাবিব। ময়দানের অনেক ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ দেখতে হাবিবের স্ত্রী রাইসা বেশ ক’বার কলকাতায় গিয়েছেন। আমিনিয়া হোটেলে থেকেছেন। কলকাতায় তাঁর প্রিয় দুটো খাবার— নিজামের হোয়াইট চিকেন রেজালা আর তিওয়ারির কাজুবরফি অনেক খেয়েছেন।
মোহন-ইস্ট মহাযুদ্ধে, ১৯৭৭
একবার মোহন-ইস্ট রোভার্স ফাইনাল দেখতে মুম্বই গিয়ে হাবিবের চিরকালের প্রিয় নায়ক দিলীপকুমারের সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল রাইসার। কিন্তু পেলে ম্যাচের দিন ইডেনে থাকতে না পারার শোক এখনও হাবিবের বিবির যেন পুরোপুরি ঘোচেনি।
ড্রইংরুমে হাবিবের পাশের সোফায় বসে রাইসা বললেন, ‘‘তবে সে দিন সকাল থেকে ও খুব তেতে ছিল। এতটাই যে, তখনকার দিনেও কলকাতা-হায়দরাবাদ ট্রাঙ্ক কলে আমার সঙ্গে ঝাড়া পনেরো মিনিট কথা বলেছিল। কত টাকার বিল উঠছে সেই চিন্তাও ওই মুহূর্তে ছিল না ওর।
একবার তো ফোনেই চিৎকার করে উঠল, ‘আরে ছোড়িয়ে তো! পেলে ভি ফুটবলার হ্যায়, ম্যায় ভি ফুটবলার হুঁ। হাম দোনো একই খেল খেলতা হ্যায়। আউর উসকা নাম ফুটবল। পেলে কো ভি আজ ছোড়েঙ্গে নেহি।’
পেলের বিরুদ্ধে খেলতে নামার আগে গোটা পৃথিবীতে হাবিবজি ছাড়া এ রকম কথা কেউ কোনও দিন বলেছে কি না আমার সন্দেহ আছে। আসলে মাঠে নামলে ও কাউকে ভয় পেত না। সাপোর্টাররা যে জন্য বলত বাঘের বাচ্চা।’’
বিবির সার্টিফিকেট পেয়ে হাবিবের মুখে তখন অনাবিল হাসি। বললেন, ‘‘কসমস ম্যাচের পর সে দিন সন্ধেয় গ্র্যান্ড হোটেলে পার্টিতে পেলে আমাকে ধীরেনদা, প্রদীপদাদের সামনেই জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘ইউ উড বি ইন্ডিয়ান পেলে।’ সত্যি বলতে এটা আমার জীবনে একটা প্রাপ্তি।’’
অকুতোভয়। অথচ ধর্মভীরু। সত্তর দশকের ময়দান কাঁপানো ‘বাঘের বাচ্চা’ হাবিব আর দু’হাজার পনেরোয় কোল-কুঁজো, পা টেনে টেনে চলা হাবিবের মধ্যে যদি কোনও একটাও মিল খুঁজে পাওয়া যায় তো সেটা— বড়েমিঞাঁর রোজ দিনে পাঁচ বার নমাজ পড়া। ‘পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ’ ফুটবলারজীবনের মতোই এখনও নিয়মিত পড়েন হাবিব।
আর হ্যাঁ! আরও একটা বিরল মিল— সেই খেলোয়াড়জীবনের মতোই সব সময় ঝকঝকে জামাকাপড় পরার অভ্যেস হাবিবের এখনও। মহম্মদ হাবিবের পোশাকে সামান্যতম ময়লা গত অর্ধ শতকে কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি। ধোপা-বাড়ি থেকে কাচা পোশাক পরে প্রতি বার নমাজে বসা ২০১৫-র হাবিবেরও অভ্যেস। না না!
তিন নম্বর মিলও আছে— ফুটবলারজীবনের মতোই হাবিবের উচ্চারণ, কথাবার্তা এখনও খুব একটা পলিশড্ নয়। কোনও বিষয়েই গভীর জ্ঞানের ধার ধারতেন না। এখনও ধারেন না।
ব্যতিক্রম— নিজের ফুটবল নিয়ে কাটাছেঁড়া। ভাই আকবরের মতো পাঁচ ফুট ন’ইঞ্চি লম্বা নন। মেরেকেটে পাঁচ-সাড়ে পাঁচ। বডিওয়েটও আহামরি নয়। ‘‘যখন খেলতাম কোনও দিন পঁয়ষট্টি কেজির বেশি ছিল না,’’ এত দিন পরেও দিব্যি মনে আছে হাবিবের। তা সত্ত্বেও স্ট্রাইকিং জোন হোক, কিংবা নিজেদের ডিফেন্স— হাবিবের কার্যকারিতা এত মারাত্মক হত কী ভাবে?
হাবিবের মুখেই শোনা যাক। ‘‘স্কোরার হিসেবে শট বা হেড কোনওটাই অসাধারণ কিছু ছিল না আমার। না ছিল ভৌমিকের মতো প্রচণ্ড ভলি, না আকবরের মতো পাওয়ারফুল হেড। কিন্তু শট বা হেড যেটাই করতাম অসম্ভব নিখুঁত ভাবে করতাম। ভীষণ তীক্ষ্ণ ভাবে করতাম। যার জন্য আমার পঁচানব্বই ভাগ শট বা হেড থেকে গোল হত। অফুরন্ত দম ছিল আমার। সত্তর বা নব্বই মিনিট গোটা মাঠ চষে ফেললেও কোনও দিন কেউ মাঠে আমাকে এক বারের জন্যও কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখেনি। ট্যাকল করতাম অপোনেন্টের শরীরের ভেতর ঢুকে গিয়ে। ফলে বেশির ভাগ সময় আমিই উইনার হতাম বল দখলের লড়াইয়ে। যে জন্য, আমি সেন্টার ফরোয়ার্ড হওয়া সত্ত্বেও আমাকে ম্যাচের পর ম্যাচ প্রায় সব কোচ ডিফেন্সেও কাজে লাগিয়েছেন। প্রদীপদা যে কত বার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছেন, বড়েমিঞাঁ, তুমহারা ফুটবল মে পাওয়ার সে জাদা হ্যায় সোচ!’’
সেই ‘সোচ’-ও পঁচাত্তরে আকবর, লতিফুদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে ইস্টবেঙ্গল ছাড়ার সময় হারিয়ে ফেলেছিলেন হাবিব। চল্লিশ বছর পর সেই ‘ভুল’ এই প্রথম অকপটে স্বীকার করলেন তিনি!
(চলবে পরের শনিবার)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy