Advertisement
১১ মে ২০২৪

দত্তকুলোদ্ভব

মাইকেল মধুসূদন দত্ত। প্রাণান্তকর দারিদ্র। পরক্ষণেই বৈভবের উল্লাস! বৈপরীত্যের এত উদ্‌যাপন আর কোন জীবনে? তাঁর সাগরদাঁড়ির ভিটে দেখে এলেন শুভাশিস চক্রবর্তী কৈশোরে বাবার সঙ্গে আলবোলা টানতেন। আঠেরোতে প্রথম প্রেম কোনও এক বিধবা রমণী, নয়তো বিবাহিত নারীর সঙ্গে। বাবার ঠিক করা পাত্রীকে বিয়ে করবেন না বলেই নাকি খ্রিস্টান হন! স্কুলবেলায় হীনমন্যতা কাটাতে সেই যে বড়লোকি চাল দেখাতে শুরু করেছিলেন, পরে সেটাই তাঁর কাল হয়!

শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

কৈশোরে বাবার সঙ্গে আলবোলা টানতেন।

আঠেরোতে প্রথম প্রেম কোনও এক বিধবা রমণী, নয়তো বিবাহিত নারীর সঙ্গে। বাবার ঠিক করা পাত্রীকে বিয়ে করবেন না বলেই নাকি খ্রিস্টান হন!

স্কুলবেলায় হীনমন্যতা কাটাতে সেই যে বড়লোকি চাল দেখাতে শুরু করেছিলেন, পরে সেটাই তাঁর কাল হয়!

মৃত্যুর পর সৎকারের অভাবে পড়ে থেকে থেকে তাঁর দেহে পচন ধরে যায়।

তিনিই কি’না মাইকেল মধুসূদন দত্ত!

প্রথম প্রেমে পড়ার পর

খিদিরপুরের রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন তমলুকের রাজপরিবারের উকিল।

একটা মামলার সূত্র ধরে তাঁকে যেতে হবে তমলুকে। পুজোর সময় যাওয়া। বিশেষ একটি ঘটনায় একমাত্র পুত্র মধুর সঙ্গে তাঁর বিবাদ চলছে।

রাজনারায়ণ এতটাই বিরক্ত যে পুত্রকে বলে দিয়েছেন তাকে এ বার গ্রামের বাড়ি সাগরদাঁড়িতে গিয়ে থাকতে হবে।

উদ্বিগ্ন পিতা ছেলেকে তার কলকাতার বন্ধুদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চান। তিনি আশা করছেন এতেই মধুর ‘রোগ’ সেরে যাবে।

যে-রাতে মধুকে যশোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে, সে দিন সকালে মনমরা মধুসূদন প্রিয়তম বন্ধু গৌরদাসকে লিখলেন, ‘‘আমি যদি একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারতাম! কিন্তু আমাকে তা নিষেধ করা হয়েছে! প্রিয়, প্রিয় গৌর— প্রিয়তম বন্ধু! আমাকে ভুলে যেয়ো না!’’

কিন্তু রাজনারায়ণ মধুর মায়ের কথা ফেলতে পারলেন না। সামনেই ছেলের পরীক্ষা। এ সময় গ্রামের বাড়িতে চলে গেলে মধুর লেখাপড়ার ক্ষতি হবে খুব— জাহ্নবীদেবী স্বামীকে বোঝাতে সমর্থ হলেন বলে মধুসূদন এত বড় ভাবি বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেলেন। তাঁকে যশোর যেতে হল না।

সেপ্টেম্বরের ১৯ থেকে কলেজে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবার কথা। ২৮ তারিখ শেষ। মধু ও গৌর পরীক্ষা দিতে দিতেও আশঙ্কা করছেন বোধহয় ২৮-এর পরে যেতে হবে যশোর, কেননা, বাবা কিছুই উচ্চবাচ্য করছেন না এ নিয়ে। অবশেষে অক্টোবরের সাত তারিখে জানা গেল, যশোরে যেতে হচ্ছে না। তার বদলে যেতে হবে তমলুকে।

কলকাতায় রাজনারায়ণ দত্ত উকিল হিসেবে এখন একটি প্রতিষ্ঠিত নাম। তাঁর ওই একটি মাত্র ছেলে। ভাল ছাত্র। স্কলারশিপ পেয়েছে। ইংরেজিতে তুখড়। ডেপুটি হবার সব রকম যোগ্যতা তার আছে। কিন্তু মাঝে মধ্যেই এই আদুরে ছেলে আজব সব আচরণ করে। ছেলের সমস্যা তিনি বুঝতে পারেন না। আর পাঁচটা বাপের মতো করে তো তিনি ছেলের সঙ্গে মেশেন না। বরং তাকে বন্ধু করে নেওয়ার চেষ্টাই করেন। এমনকী মধুর বন্ধুরা পর্যন্ত এই সময়ের শিক্ষিত ছেলেপুলে হয়েও পিতা-পুত্রের সহজ এমন সম্পর্ককে উদার মনে মেনে নিতে পারে না।

কিছু দিন আগে তাঁদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত ছিল গৌরদাস আর ভোলানাথ। এই প্রথম ওরা খিদিরপুরের বাড়িতে আসবে।

হিন্দু কলেজের এই দুই ছাত্র সেজেগুজে মধুদের বাড়িতে এসে দেখে, এ কী কাণ্ড!

রাজনারায়ণ দত্ত আলবোলা টানছেন। তাঁর টানা শেষ হবার পরে তিনি নলটা এগিয়ে দিলেন মধুর দিকে। মধুও বেশ তৃপ্তির সঙ্গে তামাকের ধোঁয়া ছাড়ছে।

বিস্মিত গৌরদাস বন্ধুর কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে মধুসুদন তাকে আরও হতবাক করে দিয়ে বলেন, তাঁর পিতা এ সব বস্তাপচা নিয়মনীতি তোয়াক্কা তো করেনই না, এমনকী তারা কখনও কখনও একসঙ্গে বসে মদ্যপানও করেন।

বাপ হয়ে ছেলেকে এত বন্ধুত্ব দেবার পরেও তার এমন উদ্ভট আচরেণের কোনও ব্যাখ্যা পান না। তাই রাজনারায়ণ ঠিক করলেন এ বারে তমলুকে গিয়ে তিনি কাছ থেকে মধুকে দেখবেন, সমস্যাটা ঠিক কোথায় বোঝার চেষ্টা করবেন।

১০ অক্টোবর সপ্তমী পুজোর দিন রাজনারায়ণ নৌকো করে তমলুক যাত্রা করলেন। পৌঁছলেন ১২ তারিখ।

রাজবাড়ির নবমী পুজোর হইচই। চারপাশে যেন মেলা বসেছে। বিজয়ার শেষে হট্টগোল একটু মিটে গেলেও ১৯ অক্টোবর বুধবারে শুরু হল লক্ষ্মীপুজোর ব্যস্ততা।

রাজবাড়ি বলে কথা! কোনও কিছুই ছোট আয়োজনে হয় না। রাজনারায়ণ ছেলের সঙ্গে কথা বলার সময়টুকুও পান না। ধনী মক্কেলের পারিবারিক মজলিশেই তাঁকে সময় কাটাতে হচ্ছে।

তিনি জানতেও পারলেন না, তাঁর আঠারো বছরের পুত্র এখানে এসে প্রেমে পড়ে গিয়েছেন। পাত্রীটি জনৈকা বিধবা। কেউ কেউ বলেন বিধবা নয়, বিবাহিতা এক রমণী।

সতেরো দিনের এই তমলুক বাসে, এক রাতে, গৌরদাসকে মধু লিখলেন, ‘‘এখানে আমার একটা ছোটখাটো প্রেমের অভিজ্ঞতা হয়েছে। সুতরাং দেখতেই পাচ্ছো, বিবাগী এবং সন্ন্যাসী থেকে রাতারাতি একটা লম্পটে পরিণত হয়েছি।’’

জীবনীকারেরা বলেন, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা দেবকীর প্রতি আজীবন প্রেমমুগ্ধ ছিলেন মধুসূদন। তাঁকে পাওয়ার ইচ্ছাতেই তিনি ‘খ্রিস্টান’ হয়ে যান।

তবু হয়তো এ কথা স্মরণ করা যেতে পারে, মধুসূদন যখন খ্রিস্টান হলেন তখন দেবকীর বয়স মাত্রই পাঁচ বছর।

যা ছিল ভান, তাই হল প্রাণ

মধুর যখন দশ বছর বয়স, তাঁর পিতা তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়।

এত দিন মধুসূদন ছিলেন কলকাতা থেকে দূরে যশোরের সাগরদাঁড়ি নামে এক অজগাঁয়ের বালক।

গ্রাম থেকে হঠাৎ ছিটকে পড়লেন শহরে, প্রাথমিক উচ্ছ্বাস ও কৌতূহল কেটে গেল স্কুলে ভর্তি হবার আগেই। উপরন্তু, নতুন স্কুল জীবন তাঁর জীবনে নিয়ে এল অন্য সংকট।

বালকটি স্কুলের অন্য ছাত্রদের মতো ইংরেজিতে কথা বলতে তো পারেই না, বরং উদ্ভট যশুরে বাংলায় কী যে বলে! তা নিয়ে সহপাঠীদের হাসির খোরাক হয়।

আত্মরক্ষার জন্য মধু ধরলেন ভিন্ন পথ। তাঁর পিতা যে ধনী উকিল রাজনারায়ণ দত্ত— এ কথা তিনি মাঝে মাঝেই বলতে শুরু করেন। দামি উপহার দেন। বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন। বড়লোকি চাল দেখিয়ে হীনমন্যতা থেকে রেহাই পেতে চান।

বাল্য-কৈশোরে যা ছিল আত্মরক্ষার অস্ত্র, শেষ পর্যন্ত সেটাই দাঁড়িয়ে গেল অভ্যাসে। অকারণে অহংকারী হয়ে ওঠা। বাড়িয়ে বলা।

এই অভ্যাসেই তিনি যখন কলকাতা থেকে ‘লেডি স্টাইল’ জাহাজে করে মাদ্রাজ যাত্রা করেন, যাত্রীদের নামের তালিকায় মধুসূদন নিজেই লেখেন, ‘মি এম এম ডাট অব বিশপস কলেজ’।

জাহাজের সমস্ত শ্বেতাঙ্গ যাত্রীর মধ্যে তিনি একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ, তবু তিনি যে ফেলনা নন, তা জানানোর উদ্দেশ্যেই ‘বিশপস কলেজ’ অংশটুকু জুড়ে দেওয়া।

আবার মাদ্রাজে রেবেকাকে বিয়ে করার সময় চার্চের রেজিস্টারে মধু পিতৃপরিচয় লেখেন— ‘সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট’।

অথচ রাজনারায়ণ দত্ত আদৌ অ্যাডভোকেট ছিলেন না। কলকাতায় তখন যে প্রায় চারশো প্লিডার-উকিল ছিলেন, রাজনারায়ণ তাঁদের অন্যতম।

সাগরদাঁড়ির ভিটে

মধু হলেন মাইকেল

বিধবার সঙ্গে প্রেমের সংবাদটি রাজনারায়ণ নিশ্চয়ই পাননি। কিন্তু মধুসূদনের ‘মনে’র সমস্যাটি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন তমলুকে বসেই। তাই রাজনারায়ণ ঠিক করলেন, পুত্রের বিয়ে দেবেন।

মেয়েটি জমিদার-কন্যা। পরীর মতো তাঁর রূপ। তবে মেয়েটি যে কে, জানা যায় না।

মধুর বন্ধু গৌরদাস আর ভূদেবের বিবাহ হয়ে গেছে। পাশের বাড়ির রঙ্গলালের বিবাহ হয়েছে মাত্রই চোদ্দো বছর বয়সে। সেখানে মধু তখন উনিশ। তবু মধু বেঁকে বসলেন। এই বিবাহ তিনি কিছুতেই করবেন না। কেননা ভালবেসে বিয়ে করার আদর্শকে তিনি মনের গভীরে এমন শিকড় চারিয়ে দিয়েছিলেন যে সেখান থেকে হঠাৎ এই বিবাহ-প্রস্তাব তাঁর কাছে বজ্রপাতের মতো।

গৌরদাসকে লেখা চিঠিতে মধুসূদন লিখলেন, ‘‘এখন থেকে তিন মাস পরে আমায় বিয়ে করতে হবে— কী ভয়ানক ব্যাপার। এটা ভাবলেও আমার রক্ত শুকিয়ে যায় এবং আমার চুলগুলো সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে ওঠে। যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবার কথা, সে হল এক ধনী জমিদারের কন্যা। হতভাগিনী মেয়ে। অজ্ঞাত ভবিষ্যতের গর্ভে তার জন্যে কী দুঃখই যে জমা আছে!’’

কী করবেন মধুসূদন?

হিতাহিত না ভেবেই স্থির করে ফেললেন মুক্তির উপায়।— খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। তাতে কোনও হিন্দু পিতা তাঁর সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেবেন না। তাই বালিকা-বধূর পাণিগ্রহণ তাঁকে আর কোনও দিনই করতে হবে না।

খিদিরপুরের বাড়িতে তিনি আর থাকতে পারবেন না, এমনকী ওই পাড়াতেও কেউ তাঁকে বাড়ি ভাড়া দেবে না, সাধের হিন্দু কলেজে পড়া বন্ধ হয়ে যাবে, প্রিয় বন্ধুরা কেউ কেউ সংস্পর্শ ত্যাগ করবে— তবু মধুসূদনের চিন্তার স্রোতে এ সব কণামাত্র তরঙ্গ তুলল না।

তবে খ্রিস্টান হবার শর্ত হিসেবে মিশনারিদের কাছে তিনি দাবি করেছিলেন— তাঁকে বিলেত পাঠানো হোক, সে-শর্তে রাজি হয়ে গেলেন চার্চের কর্তৃপক্ষ।

খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষা নেবার তারিখ ঠিক হয়েছে ৯ ফেব্রুয়ারি। ২ ফেব্রুয়ারি মধূসুদন এক মোহরের বিনিময়ে ফিরিঙ্গি-ধাঁচের চুল ছাঁটলেন।

হিন্দু কলেজে এসে বন্ধু ভূদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন: ‘‘বলো কেমন হয়েছে আমার চুলের নতুন ছাঁট?’’

ভূদেবের ভাল লাগেনি। মধু ঝগড়া করলেন না। কারণ একমাত্র তিনিই জানেন আর কিছু দিন পর তিনি খ্রিস্টান হবেন, বিলেতেও যাবেন, তাই এমন সাজসজ্জা।

৩ ফেব্রুয়ারি মধু বাড়ি থেকে উধাও হলেন। পরিচিতদের মধ্যে শেষবার তাঁকে দেখেছিলেন দিগম্বর মিত্রের ছোট ভাই মাধব মিত্র।

তবে দুই দিন পর মধুর খোঁজ মিলল। তিনি আছেন ফোর্ট উইলিয়ামে। কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের একজন নামী উকিলের পুত্র এবং হিন্দু কলেজের অন্যতম সেরা ছাত্রকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা দেওয়া হবে— মিশনারিদের কাছে এটা একটা বড় জয়। কিন্তু রাজনারায়ণ যদি লাঠিয়াল পাঠান মধুকে কেড়ে নেবার জন্য? তাই দুর্গে লুকিয়ে রাখার ফন্দি। কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারছিলেন না। তবে শেষ পর্যন্ত দেখা করতে পারেন মধুর জ্যাঠতুতো ভাই প্যারীমোহন, হিন্দু কলেজের শিক্ষক রামচন্দ্র মিত্র এবং বন্ধু গৌরদাস বসাক। তাঁরা অনেক বোঝালেন। মধু অনড়।

৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধেবেলায় ওল্ড চার্চে ‘মাইকেল’ হয়ে গেলেন তিনি মধুসূদন দত্ত।

মাদ্রাজ, রেবেকার সঙ্গে মধুযাপন

প্রায় ছ’বছর কেটে গেল। মধু বুঝলেন সমাজের মার কাকে বলে! হিন্দু কলেজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, কিন্তু থাকতে পারেন না।

রাজনারায়ণ মনে মনে ভাবছেন কিছু দিন যাক, প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে ছেলেকে আবার স্বধর্মে ফিরিয়ে আনবেন।

এত কিছুর মধ্যেও মধু পড়াশুনোটা চালিয়ে যেতে চান। তাই বিশপস কলেজে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হল।

খরচপত্র রাজনারায়ণই দিচ্ছিলেন, যদিও বাপ-ছেলের মধ্যে অশান্তি লেগেই ছিল। ক’দিন বাদে তারই জেরে কলেজের শেষ বছরের পরীক্ষায় বসতে পারলেন না মধুসূদন। বাবা টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিলেন বলে কলেজ ছাড়তে হল তাঁকে।

১৮৪৮ সালের ১৮ জানুয়ারি, মঙ্গলবার লেডি সেইল নামের জাহাজটি মাদ্রাজে পৌঁছল। জাহাজ থেকে নামলেন মাইকেল মধুসূদন ডাট।

বিশপস কলেজের সহপাঠী এডবার্গ কেনেটের দাক্ষিণ্যে শিক্ষকতার চাকরি জুটল অরফ্যান অ্যাসাইলাম বয়েজ স্কুলে। নামে বয়েজ স্কুল হলেও এখানে ফিমেল অরফ্যান অ্যাসাইলামের মেয়েরাও পড়ত।

রেবেকা ম্যাকটাভিশ থাকতেন ফিমেল অ্যাসাইলামে, পড়াশুনো করতেন অরফ্যানের বয়েজ স্কুলে।

মাইকেল ছাত্রী হিসেবে এখানেই রেবেকাকে পান। শিক্ষক মধুসূদন সকলের নজর কেড়েছিলেন এবং কলেজের বার্ষিক প্রতিবেদনে তাঁর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে।

নীলনয়না শ্বেতাঙ্গিনী রেবেকার সঙ্গে তাঁর প্রণয় এবং পরিণামে পরিণয় হয়ে গেল মাত্র ছয় মাসের মধ্যে। যদিও বাধা ছিল প্রচুর।

রেবেকার পিতৃ-পরিচয় রহস্যে ঘেরা। তাঁর পিতার নাম রবার্ট টমসন, মা ক্যাথরিন টমসন। রবার্টের মৃত্যুর পর ক্যাথরিন আশ্রয় পান ডুগান্ড ম্যাকটাভিশের কাছে এবং এই পালক পিতা ম্যাকটাভিশের নামকেই রেবেকা নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। অথচ রেবেকাকে থাকতে হল অরফ্যান অ্যাসাইলামে!

তা হলে?

রেবেকা কি অনাথ ছিলেন?

বিয়ের সাড়ে তিন মাসের মাথায় রেবেকা গর্ভবতী হলেন। সংসারে যথেষ্ট অভাব। সামান্য বেতনে আর চলে না।

এমন পরিবেশে কাব্যচর্চা সহজ নয়। তবু এরই মধ্যে মাইকেল ‘ম্যাড্রাস সার্কুলার’ পত্রিকার জন্য ‘ক্যাপটিভ লেডি’ কাব্যটি লিখে ফেললেন।

ধার-দেনা করে বই ছাপিয়ে কলকাতায় পাঠালেন তিনি। বুকে আশা, কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজ এই বই গ্রহণ করবে। তাকে কবি বলে প্রতিষ্ঠা দেবে।

কার্যত বইটি বিক্রি হল মাত্র ১৮ কপি। এমনকী ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রিকায় মাইকেলকে তীব্র আক্রমণ করে রিভিউ লেখা হল, যেখানে ব্যক্তি মাইকেলকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেললেন সমালোচক। বেথুন সাহেবও কাব্য সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করলেন না। বরং লিখলেন, ‘‘...ইংরেজি চর্চার মাধ্যমে তিনি যে রুচি এবং মেধা অর্জন করেছেন, তা তাঁর নিজের ভাষার মানোন্নয়ন এবং কাব্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার কাজে ব্যয় করুন।’’

এর পর মাইকেলের কবিখ্যাতি মাদ্রাজ শহরে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, ‘রিজিয়া’ (সম্পূর্ণ করেননি), প্রথমে ‘ইউরেশিয়ান’, পরে একযোগে ‘ইস্টার্ন গার্ডিয়ান’ ও ‘মাদ্রাজ হিন্দু ক্রনিকল’ সম্পাদনা করেছেন, গ্রিক-ল্যাটিন-হিব্রু-সংস্কৃত-ইংরেজি অধ্যয়ন করছেন একদম রুটিন মেনে।

সন্তানের জন্মের পর রেবেকার স্বাস্থ্য ভেঙে গেল। স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় রেবেকা সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে গেলেন নাগপুরের দিকে।

এই প্রথম রেবেকার সঙ্গে মাইকেলের একটানা দীর্ঘ দিনের বিচ্ছেদ। সন্তানকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণা তো ছিলই— সেই সব কিছু লিপিবদ্ধ করে রাখলেন মাইকেন ‘অন দ্য ডিপারচার অব মাই ওয়াইফ অ্যান্ড চাইল্ড টু দ্য আপার প্রভিন্সেস’ নামে একটি কবিতা: ‘‘মাই হোম ইজ লোনলি— ফর আই সিক ইন ভেন/ফর দেম হু মেড ইটস স্টার-লাইট’’।

পরের বছরের গোড়ায় মা মারা গেলেন। ‘সুদূর’ মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় যাওয়ার মতো আর্থিক সংগতি না থাকলেও ঝটিকা সফরে তিনি কলকাতায় এসে বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।

জাহ্নবী দেবীর এই অকাল মৃত্যুর জন্য রাজনারায়ণ মাইকেলকেই দায়ী করে ছিলেন। মধু তাঁর পিতার মুখের ওপর বলতে পারেননি — এই মৃত্যুর জন্য রাজনারায়ণ নিজেও কম দায়ী নন। পুত্রসন্তানের আশায় তিনি আরও তিনটি বিবাহ করেছিলেন যা কম আহত করেনি জাহ্নবীকে।

নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে রেবেকার গর্ভে মাইকেলের চারটি সম্তানের জন্ম হয়েছিল। — ব্যর্থা, ফিবি, জর্জ, জেমস। দুটি মেয়ে, দুটি ছেলে। ‘চমৎকার স্ত্রী এবং চারটি সন্তানের’ সংসার যখন তিনি বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে বসছেন, তখন ১৮৫৫ লালের ১৯ ডিসেম্বর বুধবারে গৌরদাসের লেখা একটি চিঠি থেকে তিনি জানতে পারলেন বাবা রাজনারায়ণ দত্ত মারা গেছেন অন্তত এগারো মাস আগে— ‘‘সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে তোমার জ্ঞাতি ভাইয়েরা কাড়াকাড়ি করছে। তোমার দুই বিধবা মাতা বেঁচে আছেন। কিন্তু তোমার লোভী এবং স্বার্থপর আত্মীয়দের বাড়াবাড়ির জন্য তাঁরা তাঁদের মৃত স্বামীর সম্পত্তি থেকে প্রায় বঞ্চিত হয়েছেন।’’

সম্পত্তি উদ্ধারের আশা আছে জানতে পেরে মাইকেল কলকাতা যাবেন মনস্থির করে ফেললেন।

হেনরিয়েটা ও সুখের নীড়ে ঝড়

রেবেকা যখন স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় উত্তরে ভ্রমণ করতে গেছিলেন, তখনই সহকর্মী জর্জ জাইলস হোয়াইটের স্ত্রী-বিয়োগ হয়।

জর্জের তিন সন্তান। বড় মেয়ে হেনরিয়েটা, ছোট দুটি ছেলে উইলিয়াম ও আর্থার।

নিজের মাকে হারিয়ে মাইকেল জানেন জীবনে মাতৃবিয়োগের ব্যথা কতটা আহত করে, সহকর্মীর এই তিন সন্তানকে তিনি তাই বাড়তি সঙ্গ দিয়েছিলেন স্বাভাবিক কারণেই।

স্ত্রী-বিয়োগের তিন বছর পরে জর্জ হোয়াইট দ্বিতীয়বার বিবাহ করে ফেললেন ষোলো বছর বয়েসি এমিলি জেইন শর্ট নামে এক কিশোরীকে।

জর্জের বয়স তখন সাতচল্লিশ। হেনরিয়েটা সতেরো, নববধূর থেকে এক বছরের বড়। হোয়াইট পরিবারে ঝ়ড় উঠল। বিমাতার সঙ্গে হেনরিয়েটার পদে পদে অশান্তি শুরু হল— মাইকেল সহানুভূতি, দরদ দেখাতে গিয়ে হেনরিয়েটার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়লেন। তাঁদের প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হল।

পিতার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মাইকেল যখন কলকাতা যাবেন ঠিক করে ফেললেন, তার কিছু দিন আগে তাঁর ‘সুখের নীড়ে’ ভয়ঙ্কর ঝড় বয়ে গেল।

হেনরিয়েটার সঙ্গে মাইকেলের প্রেম প্লেটোনিক ছিল না। একাধিক বার তাঁদের মিলন হয়েছে। মাইকেল দিব্য একটি দ্বৈত সম্পর্ক চালাচ্ছিলেন— রেবেকার সঙ্গে দাম্পত্য, হেনরিয়েটার সঙ্গে প্রেম।

হেনরিয়েটা মাইকেলের সাহিত্যসঙ্গিনী হয়ে উঠেছিলেন, তার সঙ্গ কবি পছন্দ করতেন, তুলনায় অর্ধশিক্ষিত রেবেকা ছিলেন কবির নির্ভরতার সঙ্গী।

কবি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, রেবেকা সহস্র বাধা অগ্রাহ্য করে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে মাইকেলকে বিয়ে করেছিলেন। হেনরিয়েটা যদি মাইকেলকে বিয়ের ইচ্ছের কথা প্রকাশ করেও থাকেন, স্পষ্টবাক মাইকেল নিশ্চয়ই তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন রেবেকাকে ডিভোর্স দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

রেবেকা জানতে পেরে গিয়েছিলেন তাঁর স্বামীর নতুন প্রেমের কথা। অনুমান করা যেতে পারে, রেবেকা স্বচক্ষে, অথবা তাঁদের সন্তানদের মধ্যে কেউ একজন মাইকেল-হেনরিয়েটাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছিলেন।

এর পর পালিয়ে যাওয়া ছাড়া মধুসূদনের পক্ষে বিকল্প কোনও পথ ছিল না।

আবার কলকাতায়, হেনরিয়েটায়

কলকাতায় পালিয়ে এলেন মাইকেল।

কোনও দিন ফিরে যাননি রেবেকার কাছে, সন্তানদের কাছে।

রেবেকা তাঁকে বিবাহ-বিচ্ছেদ দেননি। হেনরিয়েটাকে বিয়ে করে সুখে সংসার করবে মাইকেল— রেবেকা তা চাননি।

মধু যখন বুঝলেন বিবাহ-বিচ্ছেদ পাবেন না, তখন হেনরিয়েটাকে কলকাতায় চলে আসতে লিখলেন।

পিতার বিনা অনুমতিতে, ছদ্মনাম নিয়ে হেনরিয়েটা কলকাতায় এলেন। মাইকেলের কলমে সৃষ্টির জোয়ার এল।

নেশাগ্রস্থের মতো মত্ত হলেন তিনি সৃষ্টির আনন্দে— ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’, ‘কৃষ্ণকুমারী’স মায়াকানন নাটক, ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’র মতো প্রহসন, ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’— পাঁচ বছরে মাইকেল বাংলা নাটক ও কাব্যকে বলতে গেলে নিস্তরঙ্গ পুষ্করিণী থেকে পরিণত করলেন মহাসমুদ্রে।

হেনরিয়েটা আর মাইকেল এক সঙ্গে ছিলেন পনেরো বছর: প্রথমে কলকাতা, পরে ইউরোপ, আবার কলকাতা। হেনরিয়েটার গর্ভে মাইকেলের চারটি সন্তান হল— শর্মিষ্ঠা, ফ্রেডরিক, অ্যালবার্ট। তৃতীয় সন্তান একটি মেয়ে সূতিকাগৃহেই মারা যায়।

যে বিদ্যাসাগরকে তিনি ‘টুলো পণ্ডিত বলে ব্যঙ্গ করতেন, সেই বিদ্যাসাগরই তাঁর পরমবন্ধু হয়ে ওঠেন। কেবল বন্ধু নয়, ‘ত্রাতা’ বলা যায় তাঁকে।

মাইকেল বিলেতে গিয়েছিলেন ব্যারিস্টার হবেন বলে। অমিতব্যয়িতা, বড়লোকি চাল দেখানো মাইকেলের বহু দিনের স্বভাব।

এ জন্য তিনি মাদ্রাজ, কলকাতা, লন্ডন, ভার্সাই কোথাও শান্তি পাননি। পাওনাদারদের অভিযোগে তাঁকে পুলিশ-থানা পর্যন্ত যেতে হয়েছে।

শেষ পর্বে, বিশেষ করে ইওরোপ বাসকালে বিদ্যাসাগর তাঁকে যে ভাবে বারবার টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন, তার তুলনা মেলা ভার।

১৮৬৬ সালের ১৭ নভেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে ব্যারিস্টারির স্বীকৃতি পান মাইকেল। এই সুখের খবর তিনি সবার আগে জানিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে: ‘‘আমি নিশ্চিত আপনি জেনে দারুণ খুশি হবেন যে, গত রাতে গ্রেজ ইন সোসাইটি আমাকে বার-এ ডেকে পাঠিয়েছিল এবং আমি অবশেষে ব্যারিস্টার হয়েছি। এর সব কিছুর জন্য আমি ঋণী প্রথমে ঈশ্বর এবং তাঁর নীচে আপনার কাছে। এবং আপনাকে আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, আমি চিরদিন আপনাকে আমার সবচেয়ে বড় উপকারী এবং সবচেয়ে খাঁটি বন্ধু বলে বিবেচনা করব। আপনি না হলে আমার যে কী হতো।... প্রিয় বিদ্যাসাগর, আপনি ছাড়া আমার কোনও বান্ধব নেই।’’

তাঁর সমাধি

চিরঘুমের দেশে

ছাত্রাবস্থায় অঙ্কে মধুসূদনের আগ্রহ ছিল না। কিন্তু ইচ্ছে করলে তিনি যে গণিতেও ভাল করতে পারতেন হিন্দু কলেজের ক্লাসে তার পরিচয় দিয়েছিলেন।

অন্য ছাত্ররা যে অঙ্ক করতে পারেনি, মধু সেই অঙ্ক করে দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন: ‘‘দেখলে তো শেক্সপিয়র ইচ্ছে করলে নিউটন হতে পারতেন, কিন্তু নিউটন ইচ্ছে করলে শেক্সপিয়র হতে পারতেন না।’’

বেহিসেবি মাইকেল জীবনের অঙ্ক কোনও দিনই মেলাতে পারেননি, ব্যারিস্টার হয়ে কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরুর আগেই হোটেলে বিলাসী জীবন কাটানো, পরিবারকে ভার্সাইতে রেখে আসার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত, ধার করে ঘি খাওয়া— এই সব কিছুই তাঁর জীবনকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।

বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে গেল এই পর্বে। ও দিকে ভার্সাইতে দারিদ্র্য পীড়িত হেনরিয়েটা মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। সন্তানদের নিয়ে কলকাতায় ফিরে এলেও তাঁদের অবস্থার কোনও উন্নতি হল না।

এক সময় মাইকেল পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহের ম্যানেজারির চাকরি নিয়ে অজ-পাড়াগাঁ কাশীপুরে গেলেন।

তবে মন্দ কপাল কবির। এই চাকরিও থাকল না। এক নাপিত রাজামশাইয়ের কান ভাঙালেন মাইকেলের নামে। ফলশ্রুতিতে প্রাণ বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে পঞ্চকোট থেকে পালাতে বাধ্য হন।

১৮৭৩ সালের মার্চ মাস নাগাদ কবির স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ে। কন্যা শর্মিষ্ঠার তখন তেরো বছর বয়স, বিয়ে দিয়ে দিলেন তার দ্বিগুণ বয়েসি এক অ্যাংলো যুবকের সঙ্গে।

মেয়ের বিয়ের পর সপরিবারে মাইকেল গেলেন উত্তরপাড়ায়— লাইব্রেরির ওপর তলায় উঠলেন, হাওড়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বদলি হয়ে আসা বালবন্ধু গৌরদাস মধুকে দেখতে যান এবং দেখতে পান — ‘‘সে তখন বিছানায় তার রোগযন্ত্রণায় হাঁপাচ্ছিল। মুখ দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিল। আর তার স্ত্রী তখন দারুণ জ্বরে মেঝেতে পড়ে ছিল।’’

পরদিন মাইকেলকে ভর্তি করানো হল আলিপুরের জেনারেল হাসপাতালে, গলার অসুখ তো ছিলই, যকৃতের সিরোসিস থেকে দেখা দিয়েছিল উদরী রোগ, হাসপাতালে কবির সঙ্গে একদিন দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর এক সময়ের মুন্সি মনিরুদ্দিন।

মাইকেল তাঁর কাছে টাকাপয়সা আছে কিনা জানতে চাইলেন। মনিরুদ্দিন বললেন, দেড় টাকা আছে। ওটাই চাইলেন মধু, তারপর তা বখশিস হিসেবে দিয়ে দিলেন তাঁর সেবারতা নার্সকে।

২৬ জুন হেনরিয়েটা মারা গেলেন। মাইকেল এই সংবাদ এক পুরনো কর্মচারীর কাছ থেকে জানতে পারলেন।

২৯ জুন রবিবার মাইকেলের অন্তিম অবস্থা ঘনিয়ে এল। বেলা দুটোর সময় চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন কবি।

পাওয়া গেল না সমাধির জায়গা

মৃত্যুর পর মাইকেলের শেষকৃত্য নিয়ে সমস্যা দেখা দিল।

কলকাতার খ্রিস্টান সমাজ তাঁকে সমাহিত করার জন্য মাত্র ছয় ফুট জায়গা ছেড়ে দিল না। কবির মরদেহে পচন ধরল।

অবশেষে এগিয়ে এলেন অ্যাংলিকান চার্চের রেভারেন্ড পিটার জন জার্বো।

বিশপের অনুমতি ছাড়াই, জার্বোর উদ্যোগে, ৩০ জুন বিকেলে, মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টারও পরে লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরস্থানে মাইকেলকে সমাধিস্থ করা হয়।

চার দিন আগে এখানেই হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। কবির কবর খোঁড়া হয় তার পাশেই।

সে দিন ভক্ত ও বন্ধুবান্ধব মিলে উপস্থিত ছিলেন প্রায় এক হাজার মানুষ। কিন্তু একদিন শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় নিজের গ্রন্থ উৎসর্গ করে যাঁদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত করে গেলেন, সেই ভিড়ে ছিলেন না তাঁদের একজনও।

ঋণ: আশার ছলনে ভুলি (গোলাম মুরশিদ), অহর্নিশ (মেঘনাদ বধ ১৫০ ক্রোড়পত্র), সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

শ্রীমধুসূদন

•আট-নয় বছর বয়েসে গ্রামেই মধুসূদনকে ফার্সি শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। মধুসূদন দ্রুত এই ভাষা শিখে নেন। সেই সঙ্গে গজল শেখেন। পরে হিন্দু কলেজের বন্ধুদের তিনি গজল শোনাতেন।

•১৮৪১ সালের শেষ দিকে হিন্দু কলেজে মধুসূদন একটি হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করেন। যা টিকে ছিল তিন থেকে চার মাস।

•হিন্দু কলেজে বাংলা পড়াতেন রামতনু লাহিড়ী। তাঁর পটলডাঙ্গার বাড়িতে মধুসূদন সহ অন্য ছাত্ররা নিয়মিত যাতায়াত করতেন। এই আড্ডাতেই মধুসূদন অনর্গল মিল্টন ও শেক্সপিয়র থেকে আবৃত্তি করতেন।

•খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করার আগে হিন্দু কলেজের শেষ পরীক্ষায় মধুসূদন পেয়েছিলেন পঞ্চাশের মধ্যে তিরিশ। তিনি অষ্টম হয়েছিলেন। প্রথম হয়েছিলেন গোবিন্দ দত্ত, তিনি পেয়েছিলেন উনপঞ্চাশ। দ্বিতীয় হয়েছিলেন প্যারীচরণ সরকার। পেয়েছিলেন সাতচল্লিশ।

•ধর্মান্তরের সন্ধ্যায় চার্চে গাইবার জন্য মধু নিজেই একটি ‘হিম’, অর্থাৎ রচনা করেছিলেন।

•‘মেঘনাদবধ কাব্য’ উৎসর্গ করেছিলেন দিগম্বর মিত্রকে। তিনি মধুসূদনকে বিদেশে প্রতিশ্রুতি মতো টাকা পাঠাননি, ফলে মধুসূদন বিপদে পড়েছিলেন।

•ব্যারিস্টারি পড়বার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন ‘গ্রেজ ইন কলেজ’-এ। সেখানে ভর্তির রেজিস্টারে নিজের বয়স লিখেছিলেন ৩১। অথচ তাঁর তখন বয়স ছিল ৩৮।

•মাদ্রাজ থেকে মাইকেল কলকাতা চলে আসেন মিস্টার হোল্ট ছদ্মনামে। সকলের ধারণা, রেবেকার চোখে ধুলো দিতে তিনি এই নাম নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে এই নামে ঠাট্টা করে ডেকেছিলেন জাহাজের কর্মীরা এবং তারাই রিপোর্টে মধুসূদনের নাম মিস্টার হোল্ট করে দিয়েছিলেন।

•১৮৭২ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে মাইকেল পুরুলিয়া যান। একটি মামলার কারণে। বরাকর থেকে পুরুলিয়া ৪২ মাইল পথ তাঁকে পালকিতে যেতে হয়। যাত্রা পথে দেখেছিলেন পরেশনাথ পাহাড়। একটি সনেটে এই পাহাড়ের কথা তিনি উল্লেখ করেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE