Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ঘুম নিয়ে সমস্যা?

অনিদ্রা জন্ম দেয় বহু রোগের। সেই সব সমস্যার সমাধান নিয়ে কথা বললেন ইএনটি এবং স্লিপ স্পেশ্যালিস্ট ডা. দীপঙ্কর দত্তঅনিদ্রা জন্ম দেয় বহু রোগের। সেই সব সমস্যার সমাধান নিয়ে কথা বললেন ইএনটি এবং স্লিপ স্পেশ্যালিস্ট ডা. দীপঙ্কর দত্ত

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৭ ০১:০১
Share: Save:

ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি এসো / খাট নাই পালং নাই চোখ পেতে বসো / বাটাভরা পান দেব গাল পুরে খাও / খোকার চোখে ঘুম নাই ঘুম দিয়ে যাও।।

সত্যি ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি আছে কি না জানা নেই, কিন্তু ‘খোকার চোখে ঘুম নেই’ এই সমস্যা এখন আর খোকার মধ্যে আটকে নেই। আট থেকে আশি, প্রায় প্রত্যেকটা মানুষেরই সমস্যা। বিছানায় শুয়েও ঘুম আসতে চায় না, শরীর বেজায় ক্লান্ত, কিন্তু তাতেও ঘুম আসে না, অনেক রাত অবধি পেঁচার মতো জেগে থাকতে হয়... এক দিকে যেমন এই অভিযোগের তালিকা ক্রমবর্ধমান, তেমন অন্য দিকে চিন্তামুক্ত হয়ে ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোনো মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে।

কিন্তু কেন এই সমস্যা? এই সমস্যা থেকে কি মুক্তি পাওয়া সম্ভব, না কি অনিদ্রা জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে?

উত্তর দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করি, কতক্ষণ ঘুম একজন মানুষের দরকার? ছয়, আট, না সাত ঘণ্টা? এর কোনওটাই নয়! একজন মানুষ যতটা ঘুমোনোর পর তরতাজা অনুভব করেন, ততটাই তাঁর দরকার। প্রতিটি মানুষের বায়োলজিক্যাল ক্লক আলাদা। অনেকেই বলেন, শরীর বেশ ক্লান্ত থাকলেও ঘুম আসতে চায় না। এ ক্ষেত্রে বলি, ফিলিং স্লিপি এবং ফিলিং টার্য়াড এক কথা নয়। প্রচণ্ড ক্লান্ত থাকলে ঘুম নাও আসতে পারে। সেটা অস্বাভাবিক নয়। সেই সময় হয়তো স্নানটান সেরে আপনার ইচ্ছে হতে পারে রিল্যাক্স করে বসে টিভি দেখতে বা গান শুনতে। কিন্তু বাইরে গিয়ে শপিং করতে ইচ্ছে করবে না। আবার চোখ জুড়ে ঘুম আসা মানেই কিন্তু ক্লান্ত থাকা নয়।

কেউ বেজায় নাক ডেকে ঘুমোলে আমরা মনে করি, সে আরামসে ঘুমোচ্ছে। ধারণাটা ভুল। নাক ডাকার ফলে শরীরে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। শুনলে হয়তো অবাক হবেন, প্রায় ৮৮ রকমের স্লিপিং ডিসঅর্ডার প্রবলেম আছে। এখানে সব ক’টির কথা বলার পরিসর নেই। মোদ্দা কথা, ঘুম না আসার পিছনে একাধিক কারণ আছে।

অনিদ্রার জন্য মানসিক কারণও দায়ী। মন চিন্তামুক্ত না থাকলে ঘুম আসা কঠিন। আজকের ইঁদুরদৌড়ের জীবনে চিন্তামুক্ত মন কল্পনা করা কঠিন।

নাইট শিফটে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের ঘুমোনোর সমস্যা বেশি হয়। যাঁরা ওভারনাইট কাজ করার জন্য সকালে বাড়ি ফিরে গিয়ে ঘুমোন, তাঁরা ছোট থেকে বড় হয়েছেন রাতে ঘুমিয়ে। এ ক্ষেত্রে শরীর রাতারাতি ঘুমোনোর অভ্যেসটা বদলে ফেলতে পারে না। ফলে অনিদ্রার সমস্যা হয়। এর চেয়েও মারাত্মক যাঁরা মাসে কিছুদিন রাতে কাজ করেন আবার শিফ্‌ট বদলে সকালে করেন। এতে কিছু দিন সকালে ঘুমের অভ্যেস হতে না হতে আবার বদলে যায়।

রাত জেগে অনেকে পড়াশোনা বা কাজ করেন, রাত জেগে থাকার জন্য ঘনঘন সিগারেট বা কফি খান। সিগারেট ও কফি বা ক্যাফিন জাতীয় জিনিস ঘুম না আসার মোক্ষম দাওয়াই। সুতরাং ভাল ঘুমের ইচ্ছে থাকলে, আগে এই দুটো শত্রুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করুন।

ঘুম নিয়ে সমস্যা এখন বিশ্ব জুড়ে। এই নিয়ে সচেতনতাও গড়ে উঠেছে এবং উঠছেও। প্রতি বছর মার্চ মাসে একটি দিন ‘ওয়ার্ল্ড স্লিপ ডে’ পালিত হয়। এই বছর পালিত হয়েছে ১৭ মার্চ। ঘুম নিয়ে প্রতি বছর পৃথিবীর কোনও না কোনও একটি দেশে বছরে একটা সামিট হয়। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ডাক্তাররা আসেন এবং এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। পৃথিবীর কতজন মানুষ অনিদ্রায় জর্জরিত তার একটা হিসেব মেলে এই আলোচনা থেকে। সুনিদ্রার দিশা নিয়েও ডাক্তারদের চিন্তা-ভাবনা এখানে আলোচিত হয়।

দীর্ঘদিনের অনিদ্রার সমস্যা জন্ম দেয় ওবেসিটি, হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস, ত্বকের সমস্যা, হজমের সমস্যা এবং অবশ্যই মানসিক অবসাদের। আগেই বলেছি, নাক ডাকা ভাল ঘুমের জন্য একটা বিরাট সমস্যা। মানুষ তখনই নাক ডাকে, যখন তার শরীরের মধ্য দিয়ে অক্সিজেন স্মুদলি চলাচল করতে পারে না। কম অক্সিজেনের জন্য হঠাৎ করে শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ঘুম ভেঙে যায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য। আমরা হয়তো অনেকেই লক্ষ করেছি, যাঁরা নাক ডাকেন তাঁরা হঠাৎ করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য জেগে গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। একে স্লিপ অ্যাপনিয়া বলে। ব্যাপারটা মোটেও হাসির নয়। যাঁরা অতিরিক্ত নাক ডাকেন তাঁদের জানাই, চিকিৎসার মাধ্যমে নাক ডাকার সমস্যা দূর করা সম্ভব। অতএব অতিরিক্ত নাক ডাকার সমস্যা থাকলে দেরি না করে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। কারণ স্লিপ অ্যাপনিয়া হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ।

অনিদ্রা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করে সমস্যা বাড়াবেন না। কারণ অনিদ্রা থেকে সুনিদ্রায় আসার অনেকগুলো পথও আছে। সেগুলো মেনে চললে সুফল পাওয়া যায়। একটি স্লিপিং ডায়েরি তৈরি করুন। ডায়েরিতে বা খাতায় প্রতিদিন লিখে রাখুন আপনি কখন ঘুমোতে যাচ্ছেন, বিছানায় শোওয়ার পর কখন আপনার ঘুম এল, কতক্ষণ ঘুমোলেন, কোনও স্বপ্ন দেখলেন কি না, রাতে কতবার ঘুম ভেঙেছে। এই রকম একটা ডায়েরি মেনটেন করলে ডাক্তারের পক্ষে চিকিৎসা করতে সুবিধে হয়।

শোওয়ার ঘরের বিছানা ব্যবহার করুন শুধু মাত্র ঘুমোনোর জন্যই। বিছানায় বসে খাওয়া, কাগজ পড়া বা টিভি দেখা নয়। বিছানার চাদরের সঙ্গে আপনার ত্বক যদি অভ্যস্ত হয়ে যায়, তা হলে ঘুম আসতে সময় লাগে। এই জন্য বাচ্চাদের ছোট থেকে অভ্যেস করান টেবিলে বসে পড়াশোনা করার। ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়ার। বিছানায় না বসে মাটিতে বসে খেলা করার অভ্যেস করাতে পারলে ভাল। বেডরুমে উজ্জ্বল আলো এবং ঘড়ি না থাকাই ভাল। কারণ, সময় দেখে ঘুমোতে যাওয়া মোটেও ভাল অভ্যেস নয়। পরিষ্কার বিছানার চাদর ও বালিশের খোল ব্যবহার করুন।

দেরি করে ডিনার করা ঘুম না আসার অন্যতম কারণ। খাওয়ার দু’ঘণ্টা পরে ঘুমোতে যাওয়া উচিত। বিশেষ করে রাতে ড্রিংক করার অভ্যেস থাকলে, তিন ঘণ্টা পরে ঘুমোতে যাওয়া উচিত। অনিদ্রার সমস্যা থাকলে পার্টিতে তাড়াতাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার চেষ্টা করুন।

ঘুম না এলে ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়ে মুঠো-মুঠো ঘুমের ওষুধ খাবেন না। অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ শরীরের পক্ষে বিপজ্জনক।

ঘুম না এলে গল্পের বই পড়া যেতে পারে। মিউজিক শোনা যেতে পারে। তবে অবশ্যই কম ভলিউমে।

ভ্রামরী প্রাণায়াম, মেডিটেশন এবং যোগ ব্যায়াম ভাল ঘুমের জন্য বেশ উপকারী। নিয়মিত অভ্যেস করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।

ভাল করে বেঁচে থাকার জন্য ঘুম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাই দীর্ঘদিন কেউ যদি অনিদ্রার জন্য কষ্ট পান, তা হলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

অনুলিখন: ঊর্মি নাথ

মডেল: ত্বরিতা

মেকআপ: অভিজিৎ পাল

পোশাক: ওয়েস্ট সাইড, ক্যামাক স্ট্রিট

লোকেশন: অওরিস, রবিনসন স্ট্রিট

ছবি: শুভজিৎ শীল

শুটিং কো-অর্ডিনেটর: ঈপ্সিতা বসু

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Insomnia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE