Advertisement
১০ মে ২০২৪

তিনি ছিলেন আমাদের বড়বাবু

স্মৃতিচারণায় ‘শ্রীরঙ্গম’-এ নাট্টাচার্য শিশির ভাদুড়ীর অনুগামী অনিল মুখোপাধ্যায়স্মৃতিচারণায় ‘শ্রীরঙ্গম’-এ নাট্টাচার্য শিশির ভাদুড়ীর অনুগামী অনিল মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৭ ১০:৪০
Share: Save:

তখন খুব শিশির ভাদুড়ীর নামে নিন্দামন্দ শুনতাম। লোকটা নাকি মাতাল। দাম্ভিক।

সময়টা ১৯৩৯-৪০। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আমি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। মুর্শিদাবাদের কল্যাণপুরে আমার গ্রামের বাড়ি ছেড়ে সদ্য কলকাতায় পা দিয়েছি।

শ্রীরঙ্গম-এ তখন শিশির ভাদুড়ী থিয়েটার করেন। ওঁকে দেখতে এতই শখ যে, অনেকটা হেঁটে শ্রীরঙ্গম চলে গেলাম।

সেই প্রথম ওঁকে মঞ্চে দেখা। ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে। গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে। কাত্যায়ন, নরেশ মিত্র। চন্দ্রগুপ্ত, ছবি বিশ্বাস। মূরা, প্রভাদেবী। চাণক্য, শিশিরকুমার ভাদুড়ী। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ঝোঁক চেপে গেল, আমায় ওঁর দলে যোগ দিতেই হবে।

দেশগাঁয়ে থিয়েটার পালা করেছি। শহরে এসেও তার শখ যাওয়ার নয়। সে সময় অভিনেতা কমল মিত্র একটা অ্যামেচার থিয়েটারে আমার অভিনয় দেখে বললেন, ‘‘আপনার গলাটি তো বেশ। সুন্দর চেহারা। থিয়েটার করেন না কেন?’’ সুযোগ পেয়ে আমি আমার শখের কথা পাড়লাম।

উনি একটা চিঠি লিখে দিলেন শিশিরবাবুকে। শ্রীরঙ্গম-এ গিয়ে গায়ক-অভিনেতা গণেশ শর্মার হাতে চিঠি ধরাতেই বললেন, ‘‘কাল আসুন। একটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্থ করে আসবেন।

‘‘এক রাত্তিরে গোটা কবিতা মুখস্থ! কেন বই দেখে বললে চলবে না?’’

বললেন, ‘‘না।’’

প্রাণপণে ‘সুপ্রভাত’টা মুখস্থ করে গেলাম। ‘রুদ্র তোমার দারুণ দীপ্তি/এসেছে দুয়ার ভেদিয়া’।

পরদিন তো গেছি। সামনে শিশির ভাদুড়ী। কবিতা বলা শুরু করলাম। একটু বাদে দেখি, উনি শুনতে-শুনতে একটু দুলছেন। হঠাৎ ‘অর্ঘ্য’ শব্দটা বলতে গিয়ে উচ্চারণ-দোষে ‘ওর্ঘ্য’ বলে ফেলেছি। প্রচণ্ড রেগে গেলেন, ‘‘আহ্হ! ওর্ঘ্য আবার কী!’’

শেষে দলে যেতে বললেন। শুরু হল ‘শ্রীরঙ্গম’-এ যাওয়া। কিন্তু প্রথমে হতাশই হলাম। ভেবেছি ঢুকেই নায়ক গোছের কিছু একটা রোল পাব। কোথায় কী! তবু রিহার্সালে যেতাম। যাঁদের ‘পার্ট’ থাকত, তাঁরা স্টেজের উপরে, যাঁদের নেই তাঁরা নীচে। তার মধ্যেই ‘রঘুবীর’ নাটকে ওঁর অভিনয়। দর্শকদের কাউকে দেখি, হল থেকে বেরিয়ে ঘাড়ে মাথায় জল দিচ্ছে।

এক সন্ধেবেলা ডাকলেন, ‘‘কাল একটু সকাল-সকাল আসতে পারবে? অফিস কামাই কোরো না কিন্তু। এমনিই তো পয়সা দিতে পারি নে, চাকরি গেলে খাবে কী?’’

আমার তখন চাকরি জুটমিলে। ফাঁক বুঝে গেলাম। বললেন, ‘‘শোনো, ‘চিরকুমার সভা’ করব। তোমাকে পূর্ণ হতে হবে। একটা কেতাব কিনে পড়ে ফেলো।’’ বই নয়, বলতেন ‘কেতাব’।

কাস্টিং হয়ে গেল। অহীন্দ্র চৌধুরী, চন্দ্রবাবু। অক্ষয়, নীতীশ মুখোপাধ্যায়। নির্মলা, সরযূবালা। রসিক শিশির ভাদুড়ী। এই দলে আমি! এমনিই বেশ ঘাবড়ে গেলাম। তার উপর সবাই এসে যত ‘পূর্ণ কে’ ‘পূর্ণ কে’ বলে আমায় খোঁজে, আমি ততই গুটিয়ে যাই। তার উপর শুনলাম, অহীনবাবু অতিথি শিল্পী বলে রিহার্সালে আসবেন না। তিনি নাকি আবার ইচ্ছে হলেই মাথায় চাঁটা মারেন। শিশির ভাদুড়ী তত দিনে হয়ে উঠেছেন আমার ‘বড়বাবু’। বললেন, ‘‘কিছু মনে কোরো না। আর কিছু বলেও ফেলো না যেন।’’

প্রফুল্ল নাটকে

অভিনয় করলাম। চাঁটা মেরে অহীনবাবু মাথায় ‘ফুঁ’ দিলেন। দর্শক হাসল। আমি আবিষ্কার করলাম ওঁর ‘পায়োরিয়া’ আছে। থিয়েটার কিন্তু দাঁড়িয়ে গেল। এর পর আমায় একে একে ‘প্রফুল্ল’য় সুরেশ, ‘বলিদান’-এ কিশোর, ‘শেষরক্ষা’য় বিনোদ করতে ডাকলেন বড়বাবু। বুঝলাম, ধীরে ধীরে আমি ওঁর স্নেহের ছায়া পাচ্ছি।

সিল্কের একটা লুঙ্গি, ফুল পাঞ্জাবি, বুকের এক ধারে বোতাম লাগানো শার্ট। এই ছিল ওঁর রিহার্সাল দেওয়ার পোশাক। এক বার বললেন, ‘‘আচ্ছা, তোমার হাইট কত হবে বলো তো?’’

‘‘কী জানি, বোধহয় পাঁচ-আট কি সাড়ে আট!’’ বললেন, ‘‘আচ্ছা, পাশে দাঁড়াও তো, আমি তো বেশ বেঁটে।’’ সেই শুনে কাছে দাঁড়ানো নিভাননীর কী হাসি, ‘‘বুড়োটা কী করছে দ্যাখো!’’

বড়বাবুকে বললাম, ‘‘পৃথিবীর যত বিখ্যাত অভিনেতা তাঁদের বেশির ভাগই কিন্তু খর্বকায়,’’ বলে ক’জন বিখ্যাত বিদেশি অভিনেতার নাম বললাম। শুনে বললেন, ‘‘গিরিশচন্দ্র কিন্তু ছ’ফুট! তার সঙ্গে ওই চোখ, ওই গলা!’’ গিরিশ ঘোষকে নিয়ে কী যে শ্রদ্ধা ছিল ওঁর!

‘প্রফুল্ল’ হচ্ছে। বড়বাবু যোগেশ। আমি হয়েছি সুরেশ। একদিন বললাম, ‘‘এর চেয়ে মহৎ অভিনয় কল্পনাও করতে পারি না।’’ বললেন, ‘‘গিরিশবাবুকে দেখলে এ কথা বলতে না।’’

একদিন বললাম, ‘‘অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, না কি গিরিশ ঘোষ, আপনার কাছে কে বড় অভিনেতা?’’ বললেন, ‘‘অর্ধেন্দু বড় অভিনেতা, কিন্তু চরিত্র বিশ্লেষণে গিরিশ অনেক এগিয়ে। কেন জানো? শোনো, তবে। ধরো ‘বলিদান’। মেয়ের বাপ জলে ডুবে আত্মহত্যা করছে। অর্ধেন্দু নিজে কাঁদছে। দর্শককে কাঁদাচ্ছে। গিরিশ কিন্তু কাঁদে না। আসলে যে কাঁদে, সে আত্মহত্যা করতে পারে না!’’

ওঁর শেখানোর কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা ছিল না। কেবল বলতেন, পড়ো। পড়ো। পড়ো। অভিনয়ের মূল শক্তি হল কল্পনা। একমাত্র সৎ সাহিত্যই পারে কল্পনাকে আরও বাড়িয়ে দিতে।

আর এক বারের কথা। ঠিক করলেন, ‘বিসর্জন’ করবেন। হঠাৎ একদিন বললেন, ‘‘আচ্ছা, জয়সিংহ তো আজন্ম ‘বলি’ দেখে আসছে। সে কী করে ‘পশুবলি’ দেখে বলে, করুণায় কাঁদে প্রাণ মানুষের, দয়া নাই বিশ্বজননীর!’’ শুনে সত্যিই খটকা লাগল। বড়বাবু বললেন, ‘‘কিন্তু একটা যুক্তি তো রাখতে হবে, কেন জয়সিংহর মন কেঁদে উঠল। হতে পারে, অপর্ণার আকুল হাহাকার দেখে।’’ অভিনেত্রী গীতা দে-কে দিয়ে সেই কান্নাটাই কাঁদিয়েছিলেন তিনি।

‘বিসর্জন’-এর কথাতেই মনে পড়ল, রবীন্দ্রনাথ একবার এসেছিলেন ‘সীতা’ দেখতে। নাটক শেষে নাট্যকার যোগেশ চৌধুরীর পাশে দাঁড়িয়ে কবির কথা আজও মনে পড়ে, ‘‘সীতা নাটক নিয়ে কিচ্ছু বলার নেই। কিন্তু শি‌শিরের প্রয়োগনৈপুণ্যে আমার শ্রদ্ধা এল।’’

ওঁর শেষ অভিনয়ের কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না। ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছি, উদ্‌ভ্রান্তের মতো হাঁটতে হাঁটতে। বড়বাবু এর পর কোনও দিন আর মঞ্চে উঠবেন না!

‘শ্রীরঙ্গম’ ভেঙে গেল। উনি চলে গেলেন সিঁথিতে। ভাইদের কাছে। শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে তাঁর যে বইয়ের আলমারিগুলো ছিল, সেগুলো সবই বরানগরের বাড়িতে তাঁর দোতলার শোওয়ার ঘরে রাখতে পেরেছিলেন। তাঁর পড়ার কোনও অসুবিধে হয়নি। শিশিরকুমার ‘সানডে টাইমস’ কাগজের রবিবারের সংখ্যাটি নিয়মিত পড়তেন। ভারতের বাইরে বিদেশে কী হচ্ছে নিয়মিত তার খবর রাখতেন। ব্রেখটের নাটক কীভাবে অভিনয় হচ্ছে জেনে তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘‘দর্শকের সঙ্গে ইন্টিমেসি নিয়ে আমাদের থিয়েটারে আমরা অনেক আগেই কাজ করেছি। যেমন ‘আলমগীর’-এ কিছুটা আর রবীন্দ্রনাথের ‘শেষরক্ষা’ নাটকের অভিনয়ে দর্শকের ইন্টিমেসি তো ভীষণ ভাবে ছিল। তখন কিন্তু ব্রেখট সাহেব মিউনিখে ডাক্তারি পড়ছেন।’’

‘আলমগীর’ শিশির ভাদুড়ী

শ্রীরঙ্গমের অভিনয় পালা শেষ হওয়ার পর বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মতো আর একটি ঘটনা আছে। বাংলা নাট্যের সহজ এবং অনাড়ম্বর পরিবেশনে বড়বাবুর খুব আগ্রহ ছিল। সেই জন্যই তিনি সোমেন ঠাকুরের সাহায্যে শ্রীঅঙ্গনম নামে একটি সংগঠন সৃষ্টি করেন। এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথের ‘রথের রশি’ অভিনয় করা করা মনস্থ করেন। কিন্তু এই সব করার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।

প্রায়ই ওঁর বরানগরের বাড়িতে যেতাম। অনেক কথা হত। একদিন ভাই তারাকুমার বললেন, ‘‘আচ্ছা, কোনও দিন ইবসেন করতে ইচ্ছে করেনি?’’

উত্তরে বললেন, ‘‘কেন নয়! ‘পিপলস এনিমি’। কিন্তু অনুবাদ করে নয়। এ দেশের স্বেচ্ছাচার, দুর্নীতিকে সামনে রেখে। আর ইচ্ছে করে, ‘মাস্টার বিল্ডার’ করতে। ওই যে চার্চ তৈরি করা মানুষটি শেষ জীবনে হিল্ডার অনুরোধে আবারও চার্চ গড়ে, উঁচু টাওয়ারে উঠে পুরনো দিনের মতো অভিবাদন নিতে গিয়ে মারা যায়, এর মধ্যে একটা রূপক আছে। হিল্ডা আসলে তাঁর যৌবন। সবারই যৌবন একটা সময় চলে যায়। সেটা মেনেও নিতে হয়। মাস্টার বিল্ডার মানতে পারেনি!’’

শুনতে শুনতে কেবলই ভাবছিলাম, বড়বাবু কি নিজের জীবনলিপি উচ্চারণ করছেন! তাঁর অনুভব, তাঁর ক্ষরণ, তাঁর দহনের দিনগুলি...

অনুলিখন: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sisir Bhaduri Actor Theatre
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE