আসানসোল চর্যাপদ-এর প্রযোজনায় সম্প্রতি মঞ্চস্থ হল ‘লজ্জা’ নাটকটি। নির্দেশনায় রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী। লজ্জা-কে নাটক না বলে বাস্তব ঘটনার কিছু ঝলক বলাই ভাল। পরিচালকের কথায় এটি একটি ‘ডকু থিয়েটার’। মঞ্চে ‘ফ্ল্যাশ নিউজ’-এর মতো কতগুলো সংবাদের শিরোনাম উঠে আসে পর পর। তবে সেই শিরোনামে উঠে আসে শুধুই নারীরা। তাদের মিলও এক জায়গায়, সকলেই ধর্ষিতা। হোক না শিশু, হোক না নাবালিকা, হোক না যুবতী কিংবা প্রৌঢ়া। আর যেখানে গিয়ে এক হয়ে যায় নদিয়ার ধানতলা থেকে কালিম্পং, মণিপুর, রানাঘাট, ডানকুনি, পটনা, পার্কস্ট্রিট কিংবা দিল্লির নির্ভয়ারা।
যে সমাজ নারীকে পোশাক পরাতে ব্যস্ত, কঠিন অনুশাসনে রাখতে ব্যস্ত, সে সমাজই তাঁকে প্রতি মুহূর্তে অনাবৃত করছে! ধর্ষণ করছে! যে ধর্ষণ শুধুই শারীরিক নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি মানসিক ও সামাজিক সম্মানহানির।
এ নাটক ধর্ষকাম পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বুকে অনেক প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। সে কারণে নাটকটি দেখার পরেও ভাবনার স্রোত বন্ধ থাকে না। যে ভাবনা প্রতি মুহূর্তে পুরুষের হিংস্রতা থেকে নারীদের নিজেকে সুরক্ষিত রাখার। অপর দিকে পুরুষের চেতনা জাগরণের।
লজ্জা নাটকটি কিন্তু বিনোদন দেয় না। কতগুলো কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায় দর্শকদের। নারী কি এতই সহজলভ্য? শুধুই নরম মাংসপিণ্ড কিংবা খেয়ালের ভোগ্যবস্তু? নারীদের সামাজিক অবস্থানের বাস্তবচিত্রের মঞ্চায়নে পরিচালক রুদ্রর সচেতন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। নাট্য নির্মাণে তিনি কোনও দৃশ্যে আবার ব্যঙ্গ-কৌতুকেরও আশ্রয় নিয়েছেন। যখন দেখানো হয় — এক ধর্ষিতা থানায় অভিযোগ করতে গেলে তাকে আরও একবার ধর্ষণের শিকার হতে হয় মানসিকভাবে। পুলিশ ঘটনার হুবহু বর্ণনা শুনতে চায়, ঠিক কী ভাবে ধর্ষণ করেছে? কেমন লেগেছে ... শুধু তাই নয়, নাটকের কিছু সংলাপ পুরুষ দর্শকদেরও হুলের মতো বিদ্ধ করে। যখন বলা হয় — ‘আপনারা বুকে হাত রেখে বলুন তো, আজকেও এখানে আশার আগে আপনাদের মধ্যে একজনও নারীর দিকে অশালীনভাবে তাকাননি? তার শরীরটা মনে মনে কামনা করেননি’? কিংবা এই উচ্চারণ – ‘আপনার সন্তান, আপনার বাড়ির বাবা-কাকা-জ্যাঠা-দাদা-আত্মীয়-প্রতিবেশী কেউ ধর্ষণ করতেই পারেন না! তবে ধর্ষক কারা?
নাটকের মঞ্চসজ্জাও বেশ অর্থবহ। মঞ্চজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে একগুচ্ছ মুখোশ। কোনওটা সাদা-কালো কিংবা কোনওটা শুধুই কালো। মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে সহাবস্থান করা মুখ আর মুখোশের এ যেন এক জ্বলন্ত চিত্র।
সেটে স্থান পাওয়া নারীর প্রতীক চিহ্নটাও পুরুষের প্রতীক চিহ্নের অনেকটা নীচে অবস্থান করে। যা অর্থবহ। আলোর ব্যবহার (শান্তু ভট্টাচার্য) এবং কস্টিউম (সায়ন্তি চট্টোপাধ্যায়) ও প্রশংসনীয়।
শেষ দৃশ্যে নারী নয়, সমস্ত পুরুষ অভিনেতা মুখে কালি মেখে নেয়। কারণ এ লজ্জা নারীর নয়, পুরুষের। যারা আজও নারীকে নিরাপত্তা দিতে শেখেনি, সেই পুরুষদের। সর্বোপরি এ লজ্জা মনুষ্যত্বের। সে কারণে এ লজ্জার অংশীদার হতে হয় দর্শকদেরও।
‘লজ্জা’ রক্তক্ষরণ ঘটায় চেতনায়। এই নির্মাণে নাটকটি রঙ্গ-মঞ্চের বেড়াজাল ভেঙে নারী জীবনের কঠিন সত্যকে ছুঁয়ে যায়। এখানেই সফল পরিচালক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy