Advertisement
১১ মে ২০২৪

মৃত্যু সত্য মাঝে

কৃষ্ণনগর থিয়াস-এর রবীন্দ্রনাট্য ‘বিসর্জন’-এর আধুনিক মঞ্চ ভাষ্য। দেখে এলেন আশিস চট্টোপাধ্যায় নাটক সাহিত্য কিনা সে বিষয়ে তর্ক অনেক। রবীন্দ্রনাথের লেখা গীতিনাট্য ও কাব্যনাট্য সাহিত্যবিচারে উৎকৃষ্ট হলেও চেনা ছকের নাট্যলক্ষণ সেখানে অনুপস্থিত। কিন্তু ‘রাজা ও রানি’ থেকে প্রচলিত নাট্যরীতি অনুসরণ করে রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলি নাটক লিখেছেন। এই ধারার অন্যতম রচনা ‘বিসর্জন’।

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

নাটক সাহিত্য কিনা সে বিষয়ে তর্ক অনেক। রবীন্দ্রনাথের লেখা গীতিনাট্য ও কাব্যনাট্য সাহিত্যবিচারে উৎকৃষ্ট হলেও চেনা ছকের নাট্যলক্ষণ সেখানে অনুপস্থিত। কিন্তু ‘রাজা ও রানি’ থেকে প্রচলিত নাট্যরীতি অনুসরণ করে রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলি নাটক লিখেছেন। এই ধারার অন্যতম রচনা ‘বিসর্জন’। ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের মূল কাহিনিকে নাটকের ছকে লিখে অনবদ্য এই নাটক সৃষ্টি করলেন তিনি।তবে ১৮৯০ সালে লেখা পাঁচ অঙ্কের এই নাটকে প্রচলিত রীতি অনুসৃত হলেও তৎকালীন সাধারণ মঞ্চঘেঁষা নাটক থেকে তার পার্থক্য ছিল অনেক। বর্তমান সময়ে বহু স্বনামখ্যাত নাট্য দল নানান আঙ্গিকে কলকাতার নাট্যমঞ্চে বিসর্জন অভিনয় করেছেন। জেলার দলগুলিও সেখানে পিছিয়ে নেই। তারই প্রতিফলন দেখা গেল কৃষ্ণনগর থিয়াস-এর সাম্প্রতিক এই উপস্থাপনায়।এখানে নির্দেশক ভাস্কর সেনগুপ্ত নাট্য বিন্যাসে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। মূল টেক্সটকে বিকৃত না করেই সমসময়ের একটি ইঙ্গিত রেখেছেন নাটকে। উল্লেখযোগ্য হল, চরিত্রগুলির মঞ্চে কোনও নাম নেই। কথোপকথনেই শুধু বোঝা যায় কে রঘুপতি, কেই বা রাজা নক্ষত্র রায়। মূল কাহিনিতে জয় সিংহের আত্মহত্যার ফলে রঘুপতির দাম্ভিকতা খসে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল পালিত পুত্রের প্রতি স্নেহ। এখানে নির্দেশক বর্তমান সময়টাকেই আত্মহত্যাপ্রবণ বলে নির্দেশ করেছেন।মৃত্যু অমোঘ হলেও বিশ্বজুড়ে বাড়তে থাকা রক্তপাত আর হত্যালীলায় বর্শার ফলা থাকে উর্ধ্বগামী। ‘মৃত্যু সত্য মাঝে’ নামকরণ তাই সার্থক মনে হয়। অভিনয়ে নজর কাড়েন রঘুপতি চরিত্রে সুমন গোস্বামী। বিসর্জন নাট্য প্রয়োজনায় এই চরিত্রটি সাধারণত খুব টিপিক্যাল ভাবে আসে। এখানে চরিত্রটি স্বাভাবিক অথচ টগবগে ঘোড়া। ভাল অভিনয় করেছেন প্রতীক সাহা (জয় সিংহ), রাজা (রবীন্দ্রনাথ সরেন), রাজভ্রাতা (রাজীব ঘোষ)। বিশেষ একটি চরিত্রে ন্যান্সি রায় উল্লেখযোগ্য। মৌসুমি গোস্বামীর আবহসৃজন দৃশ্যগুলির হাহাকার ফুটিয়ে তোলে। তন্ময় সেনের আলো মঞ্চ মায়াসৃষ্টিতে সক্ষম। ছবি: অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়

থামেনি প্রতিবাদী কণ্ঠ

‘কোজাগরী’ নাটকে। লিখছেন পিয়ালী দাস

বেলঘরিয়া অভিমুখ’-এর প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হল ‘কোজাগরী’ নাটকটি। হাওয়ার্ড ফাস্ট এর উপন্যাস ‘সাইলাস টিম্বারম্যান’ অবলম্বনে। নির্দেশনায় কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। নিশ্চিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত, একজন সাধারণ মানুষের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর গল্পই এ নাটকের মূল উপজীব্য। বনসংরক্ষণের প্রতিবাদে একটি চুক্তিতে সই করায় জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে অধ্যাপক শৈলেশ (অশোক মজুমদার) কাষ্ঠের। তবুও প্রতিবাদী কণ্ঠ থেমে থাকে না। যার প্রতিবাদ প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে, অরণ্য সংরক্ষণের পক্ষে। কলেজের অধ্যক্ষ (শান্তনু সাহা) শৈলেশকে বার বার সাবধান করে দেন ‘সিলেবাসের মধ্যে থাকুন’ কথার মধ্য দিয়ে। এক সময়ে ভয়ে গুটিয়ে গেলেও প্রতিবাদেই শৈলেশ অটল থাকেন শেষ পর্যন্ত। এভাবেই একে একে তিনি পাশে পেয়ে যান সমমনস্ক অফিস কলিগ, পরিবার এবং কিছু গুণমুগ্ধ ছাত্রকেও। তবুও পরিণতিতে রাজনৈতিক মদতে এক রাতে শৈলেশবাবুকে থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। উপযুক্ত মঞ্চসজ্জা, আলোর ব্যবহার, ঘটনা পরম্পরার যথাযথ দৃশ্যায়ন নাটকটিকে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে নিয়ে যায় পরিণতির দিকে। আবার নাটকের মঞ্চ এক সময় হয়ে ওঠে কলেজ ক্যাম্পাসের প্রতিবাদী মঞ্চ। দর্শকাসন থেকে ছাত্ররা উঠে প্রতিবাদে সামিল হয়। এই দৃশ্যে দর্শক এবং অভিনেতাদের মধ্যেকার ক্ষীণ দূরত্ব যেন ঘুচে যায়। এই নির্মাণ পদ্ধতিতে নির্দেশক কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়। ভাল লাগে নাটকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের (সঙ্গীত পরিচালনা-শুভদীপ গুহ) ব্যবহার। শৈলেশ চরিত্রটিকে সঠিক রূপদান করেছেন অশোক মজুমদার। প্রশংসনীয় উজান চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিবাদী ছাত্র তীর্থ চরিত্রটি। এছাড়াও শৈলেশের স্ত্রী ময়ূরী (জয়তী চক্রবর্তী), প্রফেসর বিনায়ক সেন (জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়), শর্মিষ্ঠা রায় (সুপ্রিয়া রায়চৌধুরী), লীলাময় গঙ্গোপাধ্যায় (কল্যাণব্রত ঘোষ মজুমদার) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

প্রত্যাশায় ঘাটতি

‘নটী কিরণশশী’ নাটকে। দেখলেন মনসিজ মজুমদার

অন্য থিয়েটারের নতুন নাটক ‘নটী কিরণশশী’র (রচনাঃ উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, পরি: বিভাস চক্রবর্তী) কাহিনির উৎস বিমল করের ছোটগল্প ‘পিঙ্গলার প্রেম’।

গ্রামের নাট্যদল তাদের নাটকে নায়িকার অভিনয় করার জন্যে নিয়ে এসেছে শহরের বিখ্যাত নটী সুন্দরী কিরণশশীকে। গ্রামের তরুণ অভিনেতা মৃগাঙ্ক আকৃষ্ট হয় তার প্রতি। কিরণও নবীন যুবাকে প্রশ্রয় দিয়ে শহরে নিয়ে আসে এবং তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু ঈর্ষান্বিত হয় শহরের নাট্যকোম্পানির মালিক, নাট্যকার ও পরিচালক ভুবনমোহন। যার সঙ্গে গ্রামের বালিকাবধূ কিরণ ঘর ছেড়েছিল ছয় মাসের শিশুসন্তানকে ফেলে রেখে। ভুবনের নতুন নাটকে কিরণ ও মৃগাঙ্ক নায়ক-নায়িকার মহড়া দেয়। শেষ অঙ্কে আবিষ্কৃত এই প্রেমিক জুটি গ্রিক ট্র্যাজেডি ‘রাজা অয়দিপাউস’-এর নায়ক-নায়িকার মতো। শুধু নাটকে নয়, জীবনেও। কিরণ আত্মহত্যা করে।

জীবনের সঙ্গে নাটকের মিশেল এই প্রযোজনার অন্যতম আবেদন। কিন্তু অনেক কুশীলবের ভিড়ে এবং মঞ্চের মধ্যে মঞ্চের বর্ণবহুল বিচিত্র বিন্যাসে ট্র্যাজেডি-সুলভ ঋজুতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন করেনি নাটক। যদিও জোরালো অভিঘাতের অভাব ঘটেনি।

সময়ের প্রেক্ষিত রচনার তাগিদে কিছু চরিত্রের আমদানি নেহাতই আরোপিত বলে মনে হয়। যেমন, নারী-ভূমিকায় পুরুষ অভিনেতার চরিত্রটি। অভিনয় রীতিতে কালের ব্যঞ্জনা থাকলেও নাটকের শেষে অতি-অভিনয়ের প্রবণতা প্রযোজনাকে প্রত্যাশা-জাগানো স্তরে তুলতে পারেনি।

সবচেয়ে কুশলী অভিনয় শ্যামল চক্রবর্তীর ভুবনমোহন, যার ব্যক্তিগত ঈর্ষা-বিপন্নতা চমৎকার নাটকীয় অভিব্যক্তি পেয়েছে। সেজুঁতি মুখোপাধ্যায়ের কিরণশশী খুবই ব্যক্তিত্ব-ঋদ্ধ অভিনয় কিন্তু তার জীবনের ট্র্যাজেডির সঙ্গে নাটকের ট্র্যাজেডিকে সুষ্ঠু ছন্দে মেলাতে পারেনি। প্রতীক দত্তের ভালোমানুষ অথচ উচ্চাশী, প্রতিভাবান। কোনও জটিলতায় জড়িয়ে পড়তে না-চাওয়া মৃগাঙ্ককে নাটকের শেষেও মনে থাকে। কারণ, নটীর পরিচিতি প্রকাশে ও তার আত্মহত্যায় কিরণের সঙ্গে তার তীব্র প্রেম সম্পর্কের যে জটিল করুণ পরিণতি ঘটে তা যেন তাকে স্পর্শ করে না!

রাজবাড়ির পরিণতি

‘স্বজন’ নাটকে তারই পুনরাবৃত্তি

সম্প্রতি ‘এবং নান্দীক’এর প্রযোজনায় এবং ইন্দ্রনীলের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হল ‘স্বজন’। নাট্যকার চিরন্তন চক্রবর্তীর এই নাটক সহজ সরল পটভূমির ঘেরাটোপে সূক্ষ্ম অনুভূতির অভিনয় নির্ভর কাহিনি।

জমিদার গিন্নি সুধাময়ী (জয়া চৌধুরী)র স্নেহ-ছায়ায় বড় হয়ে ওঠা সপ্রতিভ যুবক অভিজাত (শুভায়ন রায়) জানতে পারে সে আদিত্য মল্লিকের অবৈধ সন্তান। ক্ষোভে ও হতাশায় সে ঠাঁই নেয় রেললাইনের ধারে এক ঝুপড়িতে। নেশাতেও ডুবতে থাকে। বহুকাল আগেই মল্লিক পরিবারের ছোট ছেলে আদিত্য মল্লিক (দ্বৈত ভূমিকায় শুভায়ন) বড় ভাই জমিদার ধীরেন মল্লিক (বাবু কর্মকার)-এর সঙ্গে মতদ্বৈতার কারণে গৃহত্যাগী হয়ে অন্যত্র সংসার বাঁধেন। এখন উকিলের চিঠি পেয়ে মৃত আদিত্যর স্ত্রী মায়া (সঙ্গীতা রায়) ও কন্যা দিয়া (স্নেহা চট্টোপাধ্যায়) প্রথম এই বাড়িতে আসতেই সম্পত্তি নিয়ে বচসা মনোমালিন্য শুরু হয়।

নাটক নতুন মোড় নেয়। দর্শকদের মধ্যেও দেখা দেয় টানটান উত্তেজনা। প্রত্যেকের অভিনয় এতটাই নিখুঁত যে, প্রতিটি চরিত্রই নাটকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠে। পরিচালনার গুণে রেললাইন সংলগ্ন সৃষ্ট মুহূর্ত বহু কাল মনে থাকবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগ নাটকের মান বাড়িয়েছে। তবে বেশি নজর কেড়েছে মঞ্চে ঠাকুরদালানের ভাবনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE