Advertisement
০২ মে ২০২৪

অমরনাথের পথে

দমফাটা চড়াই। পায়ের নীচে পিচ্ছিল বরফ। দূরে ছবির মতো সবুজ উপত্যকা। এই ভাবে দু’ দিন ধরে হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে তুষারলিঙ্গের গুহা। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তীদমফাটা চড়াই। পায়ের নীচে পিচ্ছিল বরফ। দূরে ছবির মতো সবুজ উপত্যকা। এই ভাবে দু’ দিন ধরে হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে তুষারলিঙ্গের গুহা। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

আগামী ২৯ জুন, প্রথম দিনেই অমরনাথ যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। শ্রাইনবোর্ড জানিয়েছে, সে দিনই গুহামন্দির খুলবে।

মুশকিল, শ্রাইনবোর্ডের হিসাব আর প্রকৃতির অঙ্ক মেলে না। বছর ছয়েক আগে প্রথম দিনেই হাজির হয়েছিলাম চন্দনওয়াড়িতে। পহলগাম থেকে ১৬ কিমি দূরে ছবির মতো ছোট্ট শহর। বড় বাস বা জিপ এই রাস্তায় যায় না। তাই ছোট গাড়ি। আকাশে বরফঢাকা শৃঙ্গ। নীচে ছবির মতো সবুজ উপত্যকা। ড্রাইভার এক জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখাল, ওই দূরে সানি দেওলের ‘বেতাব’ ছবির শুটিং হয়েছিল।

মন্দির খোলার কথা ঠিকই, কিন্তু দু’ দিন ধরে সেনাবাহিনী লোককে ফিরিয়ে দিচ্ছে। অমরনাথ যাত্রার বেস ক্যাম্প এই চন্দনওয়াড়ি, দু’ দিন ধরে চড়াই পেরিয়ে হাঁটলে সেই গুহামন্দির। বাঁশের কর্ডনের পাশে দাঁড়িয়ে পুলিশ-অফিসারেরা ঘনঘন ওয়াকিটকিতে কথা বলছেন, ধাক্কা মেরে জমায়েত সরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘না, আজ হবে না। ওপরে বরফ পড়ছে, রাস্তা এখনও বন্ধ।’’

দু’ দিন একই কথা শোনার পর আজ জনতার বাঁধ ভাঙল। উত্তেজিত কয়েক জন সামনে এগিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘‘হামারা লঙ্গর হ্যায়। পহেলে হম লোগোকো তো ছোড়িয়ে।’’ লঙ্গর মানে, পাহাড়ি রাস্তায় তাঁবু খাটিয়ে ওঁরা যাত্রীদের জন্য নিখরচায় থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করবেন। জম্মু ছাড়িয়ে গাড়ি উধমপুর আসতেই দেখেছিলাম, সামনে একের পর এক ট্রাক। কোথাও বেয়নেট উঁচিয়ে সেনারা, কোথাও আবার বিশাল হাতা, খুন্তি, ডেকচিসহ লঙ্গরওয়ালারা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই জম্মু-শ্রীনগর রোডে, উধমপুর এলাকাতেই নতুন এক টানেলের উদ্বোধন করেছেন। এর ফলে এ বছর থেকেই পহলগাম পাড়ি দিতে ৩১ কিমি কম ছুটতে হবে গাড়িগুলিকে। কিন্তু গাড়ির রাস্তা ওই পহলগাম, চন্দনওয়াড়ি অবধি। তার পর হেলিকপ্টার, ঘোড়া বা হাঁটা। আমার পরিকল্পনা, দু’ দিন ধরে হেঁটে যাব। আর একটা শর্টকাট রাস্তা অবশ্য আছে। শ্রীনগর থেকে গাড়িতে সোনমার্গ, সেখান থেকে বালতাল। বালতালের পাহাড়ি চড়াই ধরে হেঁটে বা ঘোড়ায় গেলে, অমরনাথ কয়েক ঘণ্টা। শ্রীনগরে এক সেনা-অফিসার জানিয়েছিলেন, ওটা মুখ্যত সেনাদের জন্য। গত কয়েক বছর ধরে যাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।

চন্দনওয়াড়ির দিকে... এখানেই ‘বেতাব’ ছবির শুটিং হয়েছিল

শর্টকাটে কে যায়? নিবেদিতা ও তাঁর শিষ্যদের নিয়ে বিবেকানন্দ এই চন্দনওয়াড়ি হয়েই অমরনাথ গিয়েছিলেন না! এ দিন সকাল আটটা থেকে পুলিশের সঙ্গে লঙ্গরওয়ালাদের তর্কাতর্কি শুরু। অতঃপর হইচই। লঙ্গরওয়ালাদের একটা ছোট্ট দল পুলিশের সঙ্গে ইচ্ছাকৃত ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল, ব্যারিকেডের ফাঁক গলে কয়েক জন চড়াইপথে ছুট। ব্যস, আমাকেই বা আর কে আটকায়?

শুরু হল চড়াই ভাঙা। রাকস্যাক গাইডের কাঁধে, পাহাড়ি পথে ততক্ষণে প্রায় দম ফাটার জোগাড়। সর্পিল পাকদণ্ডী বেয়ে প্রায় ১১ কিমি হাঁটতে-হাঁটতে প্রথমে পিসু টপের চড়াই। সেনারা মাঝে মাঝেই হাত বাড়িয়ে টেনে তুলছেন, ক্লান্তি কাটাতে বোতল থেকে জল গলায় ঢালছি, মুখে চুইং গাম।

পিসু টপের চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে এলেই এ দিন মুক্তি। তার পর বিকেলের পড়ন্ত রোদে চড়াই উৎরাই ধরে আপন মনে হাঁটা। সন্ধ্যার অন্ধকারে পাহাড়ের পাশেই নীল জলের হ্রদ। শেষনাগ! বিবেকানন্দ যাত্রাপথে এখানেই স্নান করেছিলেন না?

আর স্নান? সোয়েটার, জ্যাকেটেও তখন ঠান্ডা মানছে না, হাড়ে হি হি কাঁপন। শেষনাগের পাশে অজস্র তাঁবু, সেখানেই রাতের আশ্রয়।

আরও পড়ুন:রিভলভার পাচারও করেছেন

প্রথম দিন, ফলে টেলিফোন লাইনও পাতা হয়নি। মোবাইল কাজ করছে না। এক সেনা-অফিসারের কাছ থেকে কয়েক মিনিটের জন্য পাওয়া স্যাটেলাইট ফোনে কলকাতার সঙ্গে বার্তা-বিনিময়। ক্লান্তিতে, ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে সে রাতে খাওয়াও হয়নি। কোনও ক্রমে স্লিপিং ব্যাগে গুটিসুটি। মধ্যরাতে বোমা পড়ার মতো গুমগুম আওয়াজ। উগ্রপন্থী? এত দূরে?

অন্ধকারে ঠাহর হল, গাইডও ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে। ‘গুমা বরফ। খতরা হ্যায় সাব।’ গুমা বরফ মানে, শিলাবৃষ্টির মতো তাল-তাল বরফ। এই সশব্দ বরফ ভয়ঙ্কর। পরদিন সকালে সেনারা অস্থায়ী তাঁবুনগরী থেকে বেরোতেই দিল না। তখনও চতুর্দিক সাদা, বরফ ঝরার বিরাম নেই।

গুহার ভিতরে তুষারলিঙ্গ

আবহাওয়া একটু ভাল হতে, দুপুরবেলা বেরোনো গেল। এ দিন পেরোতে হবে ৪২৭৬ মিটার উঁচু, মহাগুনাস পাস। পিসু চড়াইয়ের থেকেও ভয়ঙ্কর।

বিপজ্জনক গুমা বরফ সে দিন যাত্রীদের একটি সুবিধে করে দিয়েছিল। পুরো বরফ কাটা হয়নি, অনেকটা ঘুরে নামতে হবে। স্লিপে চড়ার মতো আমরা একে-একে বরফের পাহাড়ে চড়ে বসলাম, এক সেনা সামনে ঠেলে দিলেন। পিচ্ছিল বরফ বেয়ে নেমে এলাম, সামনে আর একজন সেনানী। তিনি সবাইকে হাত ধরে টেনে তুললেন।

এ বারই ভারতের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য! আপন গতিতে হেঁটে চলা, দূরে সবুজ উপত্যকা, সেখানে ভেড়া চরছে। উপর থেকে খেলনার মতো লাগছে। সেখানে সরু চার-পাঁচটি জলস্রোত। এরই নাম পঞ্চতরণী। আবার বরফবৃষ্টি, আর এক তাঁবুতে রাত্রিবাস। ভোরবেলা ফের ‘বোম ভোলে’ ধ্বনিতে হাঁটা শুরু। এ বার ভিড় বাড়ছে। বালতালের পথ দিয়েও যাত্রীরা হেঁটে আসছেন। আকাশে হেলিকপ্টার, পাশে বরফগলা অমরগঙ্গার স্রোত। তাকে পাশে রেখে হাঁটতে-হাঁটতে বিশাল লাইন। এসে পড়েছি গুহার সামনে। ছোট দুই তুষারলিঙ্গ। পার্বতী আর গণেশ। একটু ভিতরে, বড়ো তুষারলিঙ্গটি। দেবাদিদেবের দর্শন এ বার সমাপ্ত!

কীভাবে যাবেন

জম্মুগামী ট্রেনে পৌঁছে যান জম্মু। সেখান থেকে বাস বা গাড়ি ভাড়া করে পহলগাম, সেখান থেকে চন্দনওয়াড়ি।

কাছাকাছি বিমানবন্দর দুটি, জম্মু ও শ্রীনগর। বিমানবন্দর থেকে গাড়ি নিয়ে চলে যান পহলগাম, সেখান থেকে চন্দনওয়াড়ি। এখান থেকে ট্রেক করে যেতে হবে গুহামন্দিরে। পহলগাম থেকে হেলিকপ্টার সার্ভিসও আছে। পঞ্চতরণী অবধি।

যাত্রার সময়: এ বছর ২৮ জুন থেকে ২১ অগস্ট।

পারমিট: জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর ব্যাঙ্ক থেকে পারমিটের ফর্ম পাবেন। জম্মু ও শ্রীনগর থেকেও পারমিট পাওয়া যায়। ১৩ বছরের কম ও ৭৫ বছরের বেশি বয়স্কদের পারমিট দেওয়া হয় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Amarnath Temple
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE