ইচ্ছে ছিল একটু নিভৃতে ঘুরে বেড়াব। সময়টাও চেনা ছুটির মরসুম নয়, একেবারে ‘সঘন সজল দিন’। আষাঢ়কে সঙ্গী করেই বোঁচকা বেঁধে বেরিয়ে পড়েছিলাম মধ্যপ্রদেশের উদ্দেশে।
তবে অত বড় রাজ্য তো, সাত দিনের ছুটিতে হয় না। তাই মূল গন্তব্য ভীমবেটকা, পাঁচমারি। সঙ্গে আরও যা পথে পড়বে, তাই।
হাওড়া থেকে ভোপাল, সেখান থেকে গাড়িতে ভীমবেটকা। মধ্যপ্রদেশের রাইসিনা জেলায় ভীমবেটকা হল সভ্যতার আঁতুরঘর। তিরিশ-চল্লিশ হাজার বছরের পুরনো পাহাড়ঘেরা এই বনাঞ্চল। এখনও পর্যন্ত প্রায় আড়াইশোটি গুহা বা পাথরের খাঁজে থাকার মতো জায়গা পাওয়া গিয়েছে পুরো ভীমবেটকা চত্বর জুড়ে। তবে ইতিহাসের পাশাপাশি প্রকৃতির টানেও গিয়েছিলাম আমরা। রেললাইনের ধারে সরকারি মোটেল থেকে আলুর পরোটা, আচার, টক দই খেয়ে ঢুকলাম ভীমবেটকা। গাড়ি বহু দূরে রেখে পুরোটাই হেঁটে যেতে হয়। দু’দিকে কালচে খয়েরি পাহাড়, গাছ, পাথুরে রাস্তা দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে চোখে পড়ল প্রথম গুহা।
প্রতিটি গুহায় এক-এক রকম ছবি। ফিকে হয়ে গেলেও বেশির ভাগই দিব্যি ঠাহর করা যায়। প্রস্তর যুগের একেবারে গোড়ার দিকের ছবি। কিছু গুহাচিত্র কম করেও তিরিশ হাজার বছরের পুরনো। ২০০৩ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা পাওয়া ভীমবেটকা সভ্যতার সূচনার আগে এক আদিম সময়ে নিয়ে যায়। সামনের কিছু গুহায় সরকারের উদ্যোগে পাথরের মূর্তি বসিয়ে দেখানো হয়েছে গুহাজীবনের ছবি। সবটাই গুহায় আঁকা ছবি নির্ভর করেই। সেগুলো পেরিয়ে জঙ্গলের আরও ভিতরে ঢুকতে-ঢুকতে মনে হয়, এ পথ শুধু টেনেই নিয়ে যায়। যেমনটা গিয়েছিলাম তেমন ভাবে বোধহয় ফিরে আসা হবে না!
টুপটাপ বৃষ্টি, পাহাড়ি ঝোরা, সবুজ আরও ঘন সবুজকে সঙ্গী করে চলল হাঁটা। কোনও গাইড নেই, পথ বলে দেওয়া বা জিজ্ঞেস করার লোক নেই। একটানা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে হাঁটা। সরকারি পাহারাদার বলে দিয়েছিলেন, এখানেই পাথরের সমান্তরাল খাঁজে নাকি মৃতদেহ শুইয়ে রেখে যাওয়া হত। এক পাহাড়ে জীবন, অন্যটায় মৃত্যু, পাশাপাশি। যে পাহাড়ি গুহায় বসবাস চলত, সেখানে স্থান সঙ্কুলান না হলে সরে যেতে হত অন্য গুহায়। আবার মৃতদেহ রাখার জন্য স্থানাভাব হলেও দেহের ঠাঁই হত অন্য গুহায়। সবটাই বহমান।
প্রবেশ পথ
গুহাচিত্রের একেবারে পুরনো ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে মূলত বিশালকায় জন্তু। গন্ডার, বাইসন ইত্যাদি। বেশির ভাগই লালচে বা সবজেটে রঙের পাথর ঘষে আঁকা। আবার পরবর্তী সময়ের (মধ্য প্রস্তর যুগ) ছবিতে দল বেঁধে শিকারে যাওয়া মানুষ বা গৃহস্থালির ছবি। বোঝা যায়, দল বাঁধাটা মানুষের সহজাত। বেশ কিছু অস্ত্রের ছবিও দেখা যায়। অনেকটা ছোটবেলায় ইতিহাস বইয়ে পড়া ছবির মতো।
গুহায় আঁকা পশুদের ছবি
এতটা পড়ে হয়তো মনে হবে, নামটা ভীমবেটকা কেন!
আসলে ভীমবেটকার সঙ্গে মহাভারতের ভীমের গল্পও জড়িয়ে। কেউ বলেন, এই গুহায় ভীমের আসা-যাওয়া ছিল। ভীমের বসার জায়গা বা ‘ভীমবৈঠক’ থেকেই নাম হয়েছে ভীমবেটকা। এখান থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা দূরে পাঁচমারির পাণ্ডবগুহা বা পাঁচমারি নামের মধ্যে থাকা পঞ্চপাণ্ডবের ইঙ্গিত সেই গল্পকথাকে মান্যতাও দেয় খানিকটা।
ঘণ্টা তিনেকের হাঁটা শেষ। ফিরে এলাম প্রথম গুহায়। যেখানে বসে থাকেন সরকারি পাহারাদার। বলে দেন, সন্ধে নামার আগেই ফাঁকা হয়ে যাবে চত্বর। গরমকালে খুব বেশি হলে ছ’টা আর শীতে চারটেতেই বন্ধ হয়ে যায় পাহা়ড়। কিন্তু কোথাও তো গেট, রেলিং নেই। কেউ যদি ঢুকে পড়ে রাতে? উত্তর আসে, ‘সবাই নিজের মতো থাকে দিদি।’ সত্যিই তো, আমরা সারা দিন পাহাড় ঘুরে-ঘেঁটে দেখি, আর রাতে ঘরে ফিরি। পাহাড়ও বোধহয় তখন আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া সরিয়ে ফিরে যায় অতীত স্মৃতিতে!
ছবি: লেখক
কীভাবে যাবেন
শিপ্রা সুপার ফাস্ট বা হাওড়া-ভোপাল সাপ্তাহিক ট্রেনে পৌঁছে যাবেন ভোপাল। সেখান থেকে গাড়িতে ৪৫ কিলোমিটার গেলেই ভীমবেটকা।
কোথায় থাকবেন?
ভীমবেটকায় সেভাবে কোনও থাকার জায়গা নেই। তবে ঢোকার আগে মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের একটা ছোট্ট রেস্তরাঁ আছে (ভীমবেটকা হাইওয়ে ট্রিট), সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া যেতে পারে। তার পর ভোপাল ফিরে আসা বা পাঁচমারি যাওয়া যেতে পারে।
কখন যাবেন
যে কোনও সময়ে। তবে শীতকালে তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায় গুহা চত্বর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy