Advertisement
০৭ মে ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

যৌনতার ধারণা বদলে দিতে চেয়েছেন

গোলাপ। শব্দটা অবধারিত ভাবে অনুষঙ্গ নিয়ে আসে গাঢ় লাল বা গোলাপি রঙের বহুপাপড়ির ফুলটিকে। কিন্তু কেন লাল? সত্যি, গোলাপকে সব সময় লালই হতে হবে কেন? এই প্রশ্ন থেকেই উপন্যাসের শুরু। ভিন্নতা, যৌন পছন্দের ক্ষেত্রে।

যশোধরা রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

সকাল-বিকেল টেলিভিশনে নানাবিধ খাট ভাঙার কথা শুনি। নানা আশ্চর্য নামের ক্যাপসুল বাজারে ঘুরে বেড়ায়, কোনওটা ‘এম’ মানে মেল, কোনওটা ‘এফ’ মানে ফিমেলদের জন্য। ওগুলো সেবন করতে উদ্দীপিত করা হয় জনগণকে। মনে পড়ে, এমনই তো হত হাতুড়ে ডাক্তারদের হ্যান্ডবিল। ছোটবেলায় দেখতাম, মানে বুঝতাম না। এখন আর হ্যান্ডবিল লাগে না, টিভিতে টাকা দিলেই বিজ্ঞাপন। সে-সব ওষুধের নামগুলো শুনলেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়। কেমন যেন অ্যাটম বোমের চুবড়ির কথা মনে হয়।

এই ২০১৫-তেও আমাদের মানসিকতার খোপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অন্ধকার, ঝুলপড়া, সবচেয়ে অগম্য স্থান যৌনতার খুপরি ঘরটা। এক দিকে যুগসঞ্চিত নিরিমিষ, ডেটল-ধোয়া পবিত্রতার ধারণা। মধ্যবিত্তের তথাকথিত ‘ভদ্র’ মানসকে যা পরিচ্ছন্ন, স্যানিটাইজড করে রেখেছে এতটাই, যে ইংরিজিতে ছাড়া তাঁরা প্রস্রাব-পায়খানা-ঋতুস্রাব-গর্ভপাতের কথা এমনকী ডাক্তারদেরও বলতে পারেন না। এই সব বিষয়ে লেখালেখি দেখলেও স্কুল বালক-বালিকার ভয়ারিজম বা বালখিল্যসুলভ আকর্ষণের সঙ্গে একটা মানসিক বিকর্ষণ কাজ করে। অন্য দিকে বাঁধভাঙা উল্লাসে ততটা-ভদ্র-হওয়ার-দায়-নেই এমন সমাজে চলে যৌন অভীপ্সার টানাপড়েন, যার মধ্যে, অর্থনৈতিক কারণেই অবৈজ্ঞানিক হাতুড়েপনা বিপদ ডেকে আনে স্বাস্থ্য-শরীরে। এই বিন্দু থেকে যৌনতার ওপর অনেকটা স্বচ্ছ নির্মোহ আলো ফেলা উপন্যাস হয়ে এসেছে হলদে গোলাপ। প্রাথমিক ভাবে, তৃতীয় লিঙ্গ, ভিন্ন যৌন পছন্দ, রূপান্তরকামিতা এই সবটাকে ধরে কয়েকটি মানুষের স্বপ্ন-আশাআকাঙ্ক্ষা।

হলদে গোলাপ, স্বপ্নময় চক্রবর্তী। দে’জ, ৫০০.০০

গোলাপ। শব্দটা অবধারিত ভাবে অনুষঙ্গ নিয়ে আসে গাঢ় লাল বা গোলাপি রঙের বহুপাপড়ির ফুলটিকে। কিন্তু কেন লাল? সত্যি, গোলাপকে সব সময় লালই হতে হবে কেন? এই প্রশ্ন থেকেই উপন্যাসের শুরু। ভিন্নতা, যৌন পছন্দের ক্ষেত্রে। দু’হাজার পরবর্তী বহু বিতর্কের মতোই একটা চালু বিতর্ক এই ভিন যৌনতা। ঋতুপর্ণ ঘোষ বা সোমনাথ মানবী মুখোপাধ্যায়। বার বার নানা ব্যক্তিকেন্দ্রিক চর্চা থেকে শুরু করে, নৈর্ব্যক্তিক আলোচনাতেও এসে পড়ছে সাম্প্রতিক বেশ কিছু এল জি বি টি অধিকার নিয়ে সোচ্চার গোষ্ঠীর আন্দোলনের নিরিখে। সম্প্রতি, রাষ্ট্রীয় অনুমোদন এসেছে এই ‘ভিন যৌনতার’ পরিচিতিতে, ভারতীয় পাসপোর্টের অ্যাপ্লিকেশনে লেখা হচ্ছে নারী অথবা পুরুষের বাইরেও নিজের অন্য একটা যৌন পরিচয়, ট্রান্স-জেন্ডার।

তৃতীয় লিঙ্গকে এতটা সহজে স্বীকৃতি দেয়নি এই সমাজ। সাদা-কালো, ভাল-খারাপ জাতীয় আর এক দ্বৈততা, নারী-পুরুষ দ্বৈততায় বাঁধা পড়া সমাজ। তাই, গোলাপকে কেন হতে হবে লালই, এটাই ছিল বিপরীতলিঙ্গকামী মানুষদের, অর্থাৎ রূপান্তরকামীদের নাড়া দেওয়া প্রশ্ন। গোলাপ তো সাদা বা হলুদও হতে পারে। হলদে গোলাপ উপন্যাসের কাহিনি, যদি আদৌ কাহিনি ফর্মে বা নির্মিতিতে লেখক তা বেঁধে থাকেন, তা হলেও তা এত বেশি তরল (সদর্থে) ফর্ম যে, যে-কোনও মুহূর্তেই তা প্রবন্ধ নিবন্ধ বা ইন্টারভিউ বা কবিতার দিকে গড়িয়ে যেতে পারে। তথাপি গদ্যকারের দায়পূরণে গল্পের একটা রেখা আছেই, যা শুরু ১৯৯৫-এ। একটি ‘বৈপ্লবিক’ কার্যক্রম থেকে। আকাশবাণীতে কাজের সূত্রে কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র অনিকেত শুরু করেন এক রেডিয়ো প্রোগ্রাম ‘সন্ধিক্ষণ’। যেখানে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করা হবে শ্রোতাবন্ধুদের নানা সমস্যার, যার উত্তর অন্যান্য বিজ্ঞানভিত্তিক অনুষ্ঠানে তাঁরা পান না। কেননা, বিষয়গুলো আপাত নিষিদ্ধ। কেননা বিষয়গুলো উচ্চারণ করার অদৃশ্য বন্ধনী আছে আমাদের মুখে। বিষয়গুলি যৌনতা সম্পর্কিত।

এই অনুষ্ঠানের হাত ধরে, যে ভাবে ঢাকনা খুলতে থাকে ‘গোপন’ বিষয় সম্বন্ধে মূলত রেডিয়োর শ্রোতা ও তার অতিরিক্ত যে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বলয়ের মনোভাব, পাশাপাশি তৈরি হয় একটি খোঁজ। একটি সন্ধান। সেটা প্রয়োজনভিত্তিক, কেননা বহু প্রশ্নে আসতে থাকে লিঙ্গপরিবর্তনকামীদের সমস্যার কথা।

ফলত উপন্যাসের ধারক অনিকেতের যাত্রা এক থেকে একাধিক লিঙ্গপরিবর্তনকামীর গোষ্ঠীর দিকে। এই সন্ধানের ইতিবৃত্তই হলদে গোলাপ। মেনস্ট্রিম মিডিয়াতে, লাল বেলুনের হৃদয় চিহ্নের ভ্যালেন্টাইন যে-ভাবে দাগড়া করে দেগে দিতে চায় নারী-পুরুষ এই দ্বৈততার প্রেমসম্বন্ধকে, যা যৌনতা সম্বন্ধে বেশ কিছু ভুল ধারণাকেও সজীব রাখে, আর চাঙ্গা করে দেয় হাতুড়ে ডাক্তারদের ব্যবসাগুলোকে, সেখান থেকে সরিয়ে আনতে চায় হলদে গোলাপ-এর যৌনতা সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক বীক্ষণ।

সেই ইতিহাস থেকে হাঁটা শুরু হয় কাহিনির মূল চরিত্র অনিকেতের। আর যত সে নতুন নতুন জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয়, ধীরে ধীরে ঢুকে যায় অন্য এক কথনবিশ্বে। সেই কথনবিশ্ব সমাজের সুশান্ত সুভদ্রদের ভাষা নয়। তার তলার পরতের জার্গন বা পরিভাষা। যে পরিভাষায় প্রতিটি মানুষের যৌন চরিত্র এবং বিশেষত হিজড়ে-রূপান্তরকামী-সমকামীদের বিভিন্ন চিহ্ন আছে, আছে নানান পরিচয়। ভাষার দিক থেকে এযাবৎকালের সব শুচিবায়ুগ্রস্ততা ওড়ানো এ উপন্যাসে, পরিতোষ নামের সেই মেয়ে হতে চাওয়া ‘পরি’-র গল্প আছে, আছে হিজড়ে হয়ে ওঠা ‘দুলালি’র গল্প, হিজড়ে সমাজের খুঁটিনাটি আছে, আছে ছেলে হতে চাওয়া অ্যাথলিট মেয়ে তৃপ্তির কথাও। আর আছে মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের ধরি মাছ–না ছুঁই পানি যৌন সংবেদনের কথা। অনুপুঙ্খতায়। আছে অনেক কবিতা। স্বপ্ন। আছে জীবন্ত একটা জীবনের কথা। যা এই সময়ের।

এযাবৎ প্রকাশিত কোনও বাংলা উপন্যাস এই বিষয়কে এ ভাবে আক্রমণ করেনি, এত দিনে বাংলা উপন্যাস প্রাপ্তবয়স্ক হল। এটা বলতে পারতাম, যদি না জানতাম, এই প্রাপ্তবয়স্কতার অল্পবিস্তর উদাহরণ আমাদের সাহিত্য-এলাকায় আগেও ছিল। এক ধাক্কায় অনেকটা প্রাপ্তবয়স্কতা এসেছিল পঞ্চাশের দশকের কবি-লেখকদের হাতে। কবিতা সিংহের পৌরুষ উপন্যাসটিকে আমরা ভুলব না। একটি কাঠ-কাঠ, যেন বা পুরুষালি, নারী। আর এক ‘মেয়েলি’ পুরুষ। এক হিজড়া। এরাই ছিল সে উপন্যাসের কেন্দ্রে। সেই সত্তর দশকের অপরিণত বাঙালি পাঠকমনে কী ঢেউ তুলেছিল উপন্যাসটি, ভাবতে বিস্ময় হয়। সেই একই সময় সমরেশ বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়রাও যৌন ট্যাবু ভাঙছিলেন। অপ্রাপ্তবয়স্কতা কোনও দিন বাংলা সাহিত্যকে ছেলেভুলনো ছড়া বানিয়ে রাখেনি।

তথাপি বলতেই হয়, যৌনতা-প্রসঙ্গ নিয়ে খোলামেলা কলমের পরিসর এই এক বইতেই অনেক যোজন পর্যন্ত বাড়িয়ে নিয়েছেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী। আলাদা সারিতে, আলাদা ব্র্যাকেটে তুলে দিয়েছেন বাংলার লেখালেখিকে, ভাষার ভদ্র-শুচিতা নিয়ে বায়ুগ্রস্ত পরিমণ্ডল থেকে বার করে এনে, এই এক বই দিয়ে। গোটা বিশ্বসাহিত্যে এক জন হেনরি মিলার, তাঁর ট্রপিক অফ ক্যানসার দিয়ে, বা রোজি ক্রুসিফিকশন দিয়ে, ব্যক্তির ভেতরে ঢুকে তার যৌনচেতনা ও স্বচেতনাকে ফালা-ফালা করে, ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সমাজের ওপর টিপ্পনি দিয়ে, এমনকী নারীবাদীদের বিশ্লেষণী তিরও হজম করেছিলেন। বিশ্লেষণী ক্ষুরধার গদ্য অনেক সময় পাঠককে নিয়েও মশকরা করেছে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুবিমল মিশ্র, নবারুণ ভট্টাচার্যর লেখায়। তাঁরা স্বঘোষিত ভাবেই ছিলেন ‘অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট’। সেখানে অনেকটাই সাবজেক্টিভ বা মন্ময় বীক্ষণ আছে আর্থ-সামাজিকতার, এবং মনস্তত্ত্বের, যৌনতা যার অবশ্যম্ভাবী অংশ। কিন্তু স্বপ্নময়ের এই লেখা প্রথম লাইন থেকে ব্যক্তির বিস্ফার নয়, বরঞ্চ সমষ্টি হিসেবে বাঙালিকে ধরে তার ভেতরের নানা দ্বিচারিতার ওপরই, ভিক্টোরীয়-রাবীন্দ্রিক মূল্যবোধের মুখোশে থাকা অবদমনের খোপ থেকে বের করে এনে আলো ফেলা শুরু করেছেন স্বপ্নময়। করেছেন তাঁর প্রায়-জার্নালিস্টিক এক ধরনের আশ্চর্য গদ্য দিয়ে, যার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, ‘নির্মিত’ বলে মনে না হওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা। দক্ষতায় ঝকঝকে এই অবলীলতা পড়তে পড়তে প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, কী এক আজব গসাগু কষেছেন স্বপ্নময় তাঁর পাঠকমনের। যে কোনও বয়সি, যে-কোনও সময়ের, যে-কোনও সামাজিক শ্রেণির মানুষের উপযোগী একটা জলজ্যান্ত বাংলা ভাষায়, আপাত-ট্যাবু বিষয়গুলো ঝরঝর করে তাঁর কলম থেকে আসে আড্ডাঘরের কথ্যরীতিতে।

যখন ধারাবাহিক ভাবে এ উপন্যাস বেরিয়ে চলেছিল, তখন এই লেখাকে ঘিরে পাঠকের প্রতিক্রিয়া আমার মনে আছে। তার অনেকটাই এক উপন্যাসের এক চরিত্র শুক্লার মতো, যারা সহজেই বলতে পারেন ‘ছি ছি, এসব কথা মুখে আনতে লজ্জা করল না তোমার?’ খারাপ লাগে, কিন্তু লুকিয়ে পড়ে নিতেও ভাল লাগে এই নিষিদ্ধ বিষয়। এই বাধাগুলি ভাঙাটাই একটা উদ্দেশ্য হতে পারে এই উপন্যাসের। কলমে আটকায় না কিছুই, এতটাই নির্বাধ এই লেখনশৈলী, যা নিজেই হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের অনেক কলমের আড় ভেঙে দেওয়ার নির্দেশিকা। ক্রমশই যেখানে সমাজ থেকে ‘ট্যাবু’ বিষয় ধরে টান দেওয়ার একটা প্রত্যক্ষ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে ক্রমশই, নানা অঞ্চল থেকে অন্ধকারের ওপর আলো ফেলার সদর্থক কাজ করে চলা হচ্ছে, সেখানে এই বই পরবর্তী লেখক পাঠককে হাত ধরে টেনে তুলবে অনেক দূর।

এর পরেও যদি কেউ প্রশ্ন করেন, বুঝলাম অতি উঁচু দরের সাহিত্য, কিন্তু আশু কী লাভ হবে এই বই পড়ে? বলব, আপনি নারী পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গ, যা-ই হোন, আপনার যৌন সমস্যাগুলিকে নিয়ে কথা বলতে হয়তো সাহায্য করবে এই বই। আর এ বার থেকে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো নারীপোশাকের পুরুষদের, যাঁদের হিজড়ে বলে ডাকি, তাঁরা টাকা চাইলে মুখ ঘুরিয়ে নেবেন না হয়তো। এখন দেখছি, সেই সব মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছি আমিও, ওঁদের অনেক বেশি চেনা মনে হচ্ছে বলেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE